খুলনা, বাংলাদেশ | ১২ ফাল্গুন, ১৪৩১ | ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

Breaking News

  পদত্যাগ করলেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম
  জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম লিভ টু আপিলের অনুমতি পাবেন কিনা, শুনানি আগামীকাল
  তৎকালীন সরকারের যোগসাজশেই বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা, সঠিক তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য উন্মোচিত হবে : মির্জা ফখরুল

শম্বুক গতিতে চলছে প্রতাপনগরের ক্ষতিগ্রস্ত ভেড়িবাঁধ সংস্কার কাজ

রুহুল কুদ্দুস, সাতক্ষীরা

সাতক্ষীরার প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাহুনিয়া ভাঙ্গন পয়েন্টে স্কেভেটর মেশিনে মাটি ফেলা হচ্ছে।
সাতক্ষীরার প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাহুনিয়া ভাঙ্গন পয়েন্টে স্কেভেটর মেশিনে মাটি ফেলা হচ্ছে।

সুপার সাইক্লোন আম্পানে ভেঙ্গে যাওয়া সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাহুনিয়া, চাকলা ও হরিষখালি ভেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংষ্কার কাজ চলেছে শম্বুক গতিতে। বাঁধ নির্মানের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা ঠিকাদারের কাছ থেকে ঠিকমত মজুরির টাকা না পেয়ে কাজ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। ফলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ভেড়িবাঁধের কাজ শেষ হওয়া নিয়ে শংকা দেখা দিয়েছে। একইভাবে ঠিকাদারের গাফিলতির কারণে ভেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ হচ্ছে ধীর গতিতে এমন অভিযোগ স্থানীয় জনপ্রতিনিধির।

স্থানীয়রা জানান, ২০২০ সালের ২০ মে সুপার সাইক্লোন আম্পানের আঘাতে কপোতাক্ষ নদ ও খোলপেটুয়া নদীর প্রবল জোয়ারের তোড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ভেড়িবাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হয় প্রতাপনগর ও শ্রীউলা ইউনিয়নের গ্রামের পর গ্রাম। গাছপালা, ঘরবাড়ি, বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙ্গে ও দুমড়ে মুচড়ে পড়ে। ফসলের ক্ষেত, মাছের ঘের ভেসে যায়। ডুবে যায় ইটভাটা। বিধ্বস্ত জনপদে পরিণত হয় আশাশুনির প্রতাপনগর ও শ্রীউলা ইউনিয়নের প্রায় ৪০টি গ্রাম। বন্যায় গৃহহারা হয়ে অসংখ্য মানুষ আশ্রয় নেয় সাইক্লোন শেল্টার, উচু স্থান ও বেড়িবাঁধের উপর। উটু স্থান ও বাঁধের উপর টোং ঘর বেঁধে এই শীতে বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধি ও শিশুদের নিয়ে অসহায় পরিবার গুলো মানবেতর জীবন যাপন করছে।

স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, আম্পান ঝড়ের আঘাতে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, বাঁধ ভেঙ্গে হয় তার শতগুণ। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আগে থেকেই কুড়িকাহুনিয়া লঞ্চ ঘাটের দক্ষিণপাশের ভেড়িবাঁধটি খুবই জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় ছিল। এখানে প্রতি বছরই বাঁধ ভেঙ্গে প্রতাপনগর ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। ভাঙ্গনের পর বাঁধ রক্ষার্থে সংস্কার কাজ করা হলেও তা টেকসই না হওয়ায় এলাকার মানুষ প্রতিনিয়ত আতঙ্কের মধ্যে জীবন যাপন করে আসছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের অঘাতে ভেঙ্গে যাওয়া ভেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংষ্কার কাজ এখনো শেষ না হওয়ায় প্রতাপনগর ও শ্রীউলা ইউনিয়নের প্লাবিত এলাকায় নিয়মিত চলছে জোয়ার ভাটা।

এদিকে প্রতাপনগর ও শ্রীউলা ইউনিয়নে ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয় গত ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ঠিকাদার প্রতাপনগরের কুড়িকাহুনিয়া, চাকলা ও শ্রীউলার হাজরাখালী এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো সংস্কারের কাজ করছেন। ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ সংষ্কার কাজ শুরু হওয়ায় স্বস্তি ফিরে আসে বানভাসি মানুষের মাঝে।

আম্পানের আঘাতে যারা বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন তারাও নিজ ভিটায় ফিরতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আশায় বুক বেধেছিল গৃহহারা এসব মানুষ গুলো। কিন্তু বাঁধ নির্মাণ কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে গাফিলতির কারনে প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাহুনিয়া, চাকলা ও হরিষখালি বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংষ্কার কাজ চলেছে সম্ভুক গতিতে। নির্মাণ কাজে অদূরদর্শিতার কারনে ভাঙ্গন পয়েন্টে ক্লোজার দিতে পারছেন না তারা। এছাড়া বাঁধ নির্মানের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা ঠিকাদারের কাছ থেকে ঠিকমত মজুরির টাকা না পেয়ে কাজ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। যে কারনে বাব বার পিছিয়ে যাচ্ছে বাঁধের কাজ। ফলে আরো প্রলম্বিত হচ্ছে বানভাসি মানুষের ঘরে ফেরার আশা। বাঁধ মেরামতের কাজ সম্পূর্ন শেষ না হওয়ায় প্লাবিত এলাকায় এখনো চলছে জোয়ার ভাটা।

প্রতাপনগরের কুড়িকাহুনিয়ায় বাঁধ নির্মাণ কাজে যাওয়া শ্রমিক বিছট গ্রামের সাহেব আলী জানান, প্রতিদিন আমাদের মাটি কাটা শ্রমিকদের খোরাকি বাবদ একশ’ টাকা করে দেয়ার কথা। বাকি টাকা পরে এক সাথে দেয়া হবে। কিন্তু ঠিকাদারের লোক ২/৩ দিন পর পর আমাদের একশ’ করে টাকা দেয়। তাহলে আমরা কি খেয়ে কাজ করবো। খাওয়ার টাকা ঠিকমত না পেয়ে আমরা কাজ ছেড়ে চলে এসেছি। একই কথা জানালেন শ্রমকি সোহাগ, রশিদ, সুলতান ও আলমগীর। পাবনার একটি দল সেখানে কাজ করছে। বাকিরা সবাই চলে গেছে বলে জানান তারা।

প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ জাকির হোসেন জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপরিকল্পিত কাজের কারণে কপোতাক্ষ নদ ও খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ বারবার ভাঙ্গছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে পাউবো’র ভেড়িবাঁধের আটটি পয়েন্ট ভেঙ্গে প্লাবিত হয়ে ইউনিয়নের মানুষ সহায়-সম্বল হারিয়েছে। আশ্রয়হীন হয়েছে নয়শ’ ৬০ পরিবার। গত ছয় মাস ধরে তারা আশ্রয় কেন্দ্রে ও ভেড়িবাঁধের উপর টোং ঘর বেধে মানবেতর জীবন যাপন করছে। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়োজিত ঠিকাদারের গাফিলতি কারনে বাঁধের কাজ দ্রুত শেষ না হওয়ায় আমার ইউনিয়নের গৃহহারা মানুষ গুলো ঘরে ফিরতে পারছেনা ।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, হরিষখালি পয়েন্ট একটি ক্লোজার নির্মাণ শেষ হলেও বাকিটা হচ্ছে না। কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তার ইচ্ছা মত অপরিকল্পিতভাবে কাজ করায় বিলম্বিত হচ্ছে বাঁধের নির্মাণ কাজ। একই অবস্থা চাকলায়। ফলে এখনো ওইসব এলাকায় জোয়ার ভাটা চলছে। এছাড়া কুড়িকাহুনিয়া পয়েন্টে নিয়োজিত ঠিকাদার শ্রকিদের টাকা ঠিকমত পরিশোধ না করায় কাজ চলছে ধীর গতিতে।

অধিকাংশ শ্রমিকরা টাকা না পেয়ে ১/২ দিন কাজ করে চলে যাচ্ছে। বাঁধ নির্মাণ কাজ তত্ত্বাবধানে থাকা সেনাবাহিনীকে বিষয়টি অবহিত করা হলেও তাঁরা বলছেন,“আমাদের দায়িত্ব কাজ সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা তা বুঝে নেয়া”। ফলে কতদিন নাগাদ যে কাজ শেষ হবে তা বলা মুশকিল। চলতি শুস্ক মৌসুমের মধ্যে কুড়িকাহুনিয়া, হরিষখালি ও চাকলার বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ না হলে প্রতাপনগর ইউনিয়নকে আরো রক্ষা করা যাবে না। তিনি দ্রুত বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

পাউবো বিভাগ-২ এর সেকশনাল অফিসার (এসও) আলমগীর হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তান্ডবে আশাশুনির ভেঙ্গে যাওয়া পাউবো’র ২৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ৪টি পয়েন্টে বাঁধ সংষ্কারের কাজ তত্ত্বাবধান করছে সেনাবাহিনী। এর মধ্যে প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাহুনিয়া ও চাকলা এবং শ্রীউলার হাজরাখালি বেড়িবাঁধ রয়েছে। প্রতাপনগরের হরিষখালিতে একটি ক্লোজারের কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। আরেকটি ক্লোজারের কাজ শীঘ্রেই শেষ হবে। কুড়িকাহুনিয়া ও চাকলার বাঁধ নির্মাণ কাজ চলছে। আমরা কাজে নিয়োজিত ঠিকারকে বলেছি দ্রুত কাজ শেষ করতে। চলতি শুস্ক মৌসুমের মধ্যেই এসব কাজ শেষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মীর আলিফ রেজা সুপার সাইক্লোন আম্পানের তান্ডবে ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা দিয়ে জানান, ২০ মে রাতে সুপার সাইক্লোন আম্পানের তান্ডবে পাউবো’র তথ্যমতে আশাশুনি উপজেলার প্রায় ২৪ কি.মি. নদীর ভেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

প্রলয়ঙ্করী ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে প্রতাপনগর ইউনিয়নে চাকলা, কোলা হিজলিয়া, নাকনা, কুড়িকাহুনিয়া, রুইয়ারবিল, সুভদ্রাকাটিসহ বিভিন্ন এলাকা কপোতাক্ষ নদের বাঁধ ভেঙ্গে পুরো ইউনিয়ন পানিতে তলিয়ে যায়। শ্রীউলার হাজরাখালি বাঁধ ভেঙ্গে ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম প্লাবিত হয়। ঝড় বা বন্যায় ১৫ হাজার ৮০০ নারী, ২৫ হাজার ২০০ পুরুষ, ৩ হাজার ১০০ শিশু ও ৮৩৫ জন প্রতিবন্ধী বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়।

তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শ্রীউলার হাজরাখালি, প্রতাপনগরের কুড়িকাহুনিয়া ও চাকলা পয়েন্টে বাঁধ সংস্কার কাজ শুরু করেছেন। দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সংস্কার কাজ। ইতিমধ্যে দৃশ্যমান হচ্ছে ভেড়িবাঁধ। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে এসব বাঁধের কাজ শেষ হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!