বদলে গেছে গত ১৩ বছরের সেই চিত্র। দেশের প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। নেই লোডশেডিংয়ের ভয়াবহ সেই যন্ত্রণা। মাত্র এক দশক আগেও দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ ছিলেন বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে। শহরে-গ্রামে সবখানে ছিল ভয়াবহ লোডশেডিং। এখন বদলে যাওয়া চিত্রের সুফল ভোগ করছেন দেশের মানুষ। আজ দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সোমবার (২১ মার্চ) সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার পায়রায় পৌঁছাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের দেশের সবচেয়ে বড় ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন করবেন। একই সঙ্গে দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দেবেন তিনি।
বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎ সুবিধা প্রাপ্ত জনগোষ্ঠী ছিল ৪৭ শতাংশ। গত ১৩ বছরে ৫৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে এখন শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছেন। সম্ভাব্য সব এলাকায় সঞ্চালন লাইন স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে সরকার। একেবারের দুর্গম এলাকাগুলোতে সোলার প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে।
২০০৯ সালে গ্রাহক সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৮ লাখ। গত ১৩ বছরে ৩ কোটি ১৩ লাখ বেড়ে বর্তমানে বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা হয়েছে ৪ কোটি ২১ লাখ। ২০০৯ সালে দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট, বর্তমানে এ ক্ষমতা ২৫ হাজার ৫১৪ মেগাওয়াট (ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্যসহ)।
২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছিল ২৭টি, বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ১৫০ টি। ১৩ হাজার ২১৯ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে।
২০০৯ সালে বিদ্যুতের বিতরণ লাইন ছিল ২ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার, বর্তমানে ৬ লাখ ২১ হাজার কিলোমিটার সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। দুর্গম এলাকার মানুষকে বিদ্যুতের আওতায় আনতে ৬০ লাখ সোলার প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে।
করোনা মহামারি শুরুর পর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার বাইরে দেশের অন্য কোথাও এটিই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম সফর। এদিন প্রধানমন্ত্রী পায়রা তাপ বিদ্যুকেন্দ্র পরিদর্শন এবং এর নাম ফলক উন্মোচন করবেন। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন উপলক্ষে ১৩২০টি পায়রা ওড়ানো হবে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমন উপলক্ষে নানা আয়োজনের মধ্যে সবার নজর কেড়েছে তাকে বরণ করতে বর্ণিল সাজে সাজানো ২০০ নৌকা। কোল জেটিতে রঙিন পাল তোলা এসব নৌকা থেকে পতাকা নাড়িয়ে এবং সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানানো হবে।
পটুয়াখালীতে প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মধ্যে বইছে খুশির জোয়ার। এ উপলক্ষে রঙিন সাজে সজ্জিত করা হয়েছে পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র এলাকাসহ জেলার রাস্তা-ঘাট, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সরকারের বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন মেগা প্রকল্প এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে বাহারি রং, আলোকসজ্জা ও ব্যানার ফেস্টুনে সাজানো হয়েছে।
কলাপাড়ার ধানখালীর পায়রাতে নির্মিত সর্বাধুনিক আলট্রা সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির কয়লা ভিত্তিক এ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালুর মধ্য দিয়ে ২০২০ সালেই বাংলাদেশ আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল ক্লাবে প্রবেশ করে। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে বাংলাদেশ বিশ্বের ১৩তম দেশ; এশিয়ায় সপ্তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ছাড়া শুধু ভারতে এ ধরনের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে।
৬৬০ মেগাওয়াট করে দুই ইউনিট মিলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ৬৬০ মেগাওয়াটের প্রথম ইউনিটটি উৎপাদনে আসে ২০২০ সালের মে মাসের ১৫ তারিখে। সমান ক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে আসে একই বছরের ৮ ডিসেম্বর। তবে সঞ্চালন অবকাঠামো নির্মাণ শেষ না হওয়ায় কেন্দ্রটি থেকে ক্ষমতার চেয়ে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকানায় যৌথভাবে রয়েছে বাংলাদেশ ও চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)। বাংলাদেশের নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (এনডাব্লিউপিজিসিএল) ও চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইমপোর্ট করপোরেশনের (সিএমসি) সমান অংশীদারিত্বে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছে।
শতভাগ বিদ্যুতায়ন প্রসঙ্গে সম্প্রতি গণভবনে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে আমরা শতভাগ বিদ্যুৎ দিয়েছি। যেসব জায়গায় গ্রিড লাইন নেই সেখানে সোলার প্যানেল দিয়েছি। খুঁটে খুঁটে বের করছি, কোন জায়গায় নেই। সর্বশেষ পেলাম গঙ্গাছড়াতে ৭০টি বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। সেখানে আমি সোলার প্যানেল করে দিয়েছি। এখন কিন্তু শতভাগ বিদ্যুৎ হয়ে গেছে আমাদের দেশে। যেটা আমাদের টার্গেট ছিল।
তিনি বলেন, কিছু কিছু দ্বীপ অঞ্চল, সাবমেরিন ক্যাবল দিয়ে লাইন নিয়ে গেছি, যেমন সন্দীপে নিয়ে গেছি, ভোলার কিছু অঞ্চল, তাছাড়া বেশির ভাগ স্থানে সোলার প্যানেল দিচ্ছি। গ্রিড লাইন আরও তৈরি করছি, যাতে আরও সুষ্ঠু ভাবে বিদ্যুৎ দিতে পারি।
রোববার (২০ মার্চ) বিকেলে পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিদর্শনকালে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সাংবাদিকদের বলেন, সময়ের আগে কাজ শেষ হয়ে গেছে। করোনা বাস্তবতার কারণে প্রধানমন্ত্রী এখন উদ্বোধন করছেন।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শতভাগ বিদ্যুতায়ন ঘোষণা করবেন। প্রধানমন্ত্রী মুজিব বর্ষে সবাইকে বিদ্যুৎ দিতে চেয়েছিলেন, দিয়ে ফেলেছি।
পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিসিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ এম খোরশেদুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন উপলক্ষে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। উদ্বোধনের পরই প্রধানমন্ত্রী দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দেবেন।
পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আফম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, আবারও প্রমাণ হয়েছে আওয়ামী লীগ যে কথা দেয়, তা রাখে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও নতুন নতুন সঞ্চালন লাইন স্থাপন এবং একেবারে দুর্গম এলাকায় সোলার প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমে সরকার দেশের সব মানুষকে বিদ্যুতের আওতায় এনেছে। সোমবার প্রধানমন্ত্রী শতভাগ বিদ্যুতায়ন ঘোষণা করবেন।