আজ শঙ্খ ঘোষের বিদায়ের দিনে কিছু কথা লেখার চেষ্টা করবো হয়তো কথাগুলো লক্ষ বার উচ্চারিত। তবু তার কথাগুলো, ভাবনাগুলোকে নিয়মিত ভাবে চর্চার মধ্যেই রাখা জরুরী।বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলায় জন্ম ১৯৩২ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি, বিদায় নিয়েছিলেন ২১ এপ্রিল, ২০২১ পশ্চিমবঙ্গে কলকাতায় । বিদায় নিয়েছিলেন লিখলাম বটে, তবে তার মত মানুষরা কি আসলে আদৌ ‘বিদায়’ নেন কখনো? বোধহয় না ।
‘প্রহরীর মতো জেগে’ থাকেন মানুষের চলার পথে অজস্র বাঁকের মুখে উত্তরণের বা পথ চলার নানান ফলপ্রসু পরামর্শ নিয়ে। তাই ওনার বিদায় কখনোই স্থায়ী বিদায় হয়ে উঠবে না, চারদিকের নির্লিপ্তি আর আত্মসর্বস্বতার মধ্যেও তিনি থেকে যাবেন অজস্র শব্দের মধ্যে পরিপূর্ণ প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের ভাষায় (শঙ্খ ঘোষ সম্পর্কে বলেছেন), “তাঁর যে মনীষার ঘরানা, সেটা বহুল শিকড়িত। তাঁর অধ্যাপনায় যে পরিশীলিত পারমিতা – এ সবই ছিল একেবারে আলাদা ….।
বেপথুমান ঝাউবন, সেও একটা আলোকরশ্মি খোঁজে, একটা আলো খোঁজে, যার সম্পাতে ঝোড়ো হাওয়ার যে্ মঞ্জিরা- শুধু শোনা যায়, দেখাও যায় – সেরকমই একজন কবি ছিলেন এই শঙ্খ ঘোষ এবং এখনো আছেন”(১)। ‘দিনগুলি রাতগুলি’ কাব্যগ্রন্থ দিয়ে বাংলা সাহিত্যের কবিতার অঙ্গনে আত্মপ্রকাশ করেই চিরকালীন আসনে স্থায়ী স্থান করে নিয়েছেন। বুদ্ধদেব বন্ধ্যোপাধ্যায় (শঙ্খ ঘোষের কবিতাসম্ভার সম্পর্কে মূল্যায়ণ ) এর মতে, “সময়ানুগ হয়েও কবিতা রয়ে যাবে সময়ের সীমানা ছাড়িয়ে, অতীত পা ছড়িয়ে বসবে বর্তমানে কিংবা বর্তমান উঠে বসবে ভবিষ্যতের কোলে”।
তার প্রবন্ধ মানেই সেখানে তাঁর বলবার ভঙ্গীতে সবসময় যুক্তিসাম্য বজায় থাকবে । ব্যক্তিসমালোচনার ঝোঁক তাঁর মধ্যে একেবারেই ছিল না । নিবিড় পাঠের অভিজ্ঞতার ঝুলি ব্যবহার করে যুক্তি ও তথ্যকে ব্যবহার করে লিখে গেছেন একের পর এক মননশীল প্রবন্ধ । বিনম্র ভঙ্গিতে অথচ দৃঢ ভাবে বলার ধরনটি রপ্ত করেছিলেন অসম্ভব মুন্সিয়ানায় । সমস্ত মতকে শুনে বুঝে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে নিজের বক্তব্যকে দাঁড় করাতেন এক সাম্যের জায়গায়। যেমন, ‘দেখার দৃষ্টিতে’ তিনি ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে লিখেছেন – ফ্যাসিবাদ আমাদের স্বভাবের একটা অনিয়ন্ত্রিত চিৎকার।
অজস্র কালজয়ী কবিতায় তিনি বারবার দেশের সঙ্কটের মূহুর্তে প্রতিবাদী ভূমিকা নিয়েছেন। সব দেশেই পরিবর্তনের লড়াইয়ে, সঙ্কটে কবি, লেখক, সংস্কৃতি কর্মীদের ওপরেও প্রবল চাপ সৃষ্টি করে, অত্যাচার নামিয়ে আনে শাসক – এটাই ইতিহাস বলে। শুধুমাত্র দৈনন্দিন কাজের সাথে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে যুক্ত অ্যাকটিভিষ্টরা সব দেশে সব কালেই তাদের একক প্রচেষ্টাতে দেশের মূল পরিবর্তন আনতে পারেন না, সাহায্য লাগে কবি, লেখক, বুদ্ধিজীবিদের । এটা প্রমাণিত সত্য, যে সমাজে কবি, লেখক, বুদ্ধিজীবিরা অবহেলিত বা উপেক্ষিত বা আতঙ্কগ্রস্থ বোধ করেন, সেই সমাজ সব সময় পিছনের দিকেই এগিয়ে চলে । এটা যারা বোঝেন না, শুধুমাত্র সংখ্যা বাড়ানোতেই মন দেন, তাদের দুর্গ আকারে বড় হলেও যখন হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পরে, গ্রামের ভাষায় বলতে হয় ‘সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালানোর লোক তাদের থাকে না ‘।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পিছিয়ে যান নি কখনো । এটাই তার অনন্যতা । বাড়িয়ে দিয়েছেন শাসকের উদ্দেশ্যে নির্মম ও নির্মেদ শব্দমালা । ‘রাজনৈতিক’ বৃত্তে এসেও কখনো কখনো শব্দ নিক্ষেপ করেছেন যা ক্রমে ক্রমে বুঁদবুঁদ থেকে ঢেউয়ের আকার নিয়েছে । সভ্যতা, গণতন্ত্র আক্রান্ত হয়েছে বোধ করলেই তাঁর কলম ছুটতে শুরু করেছে বারবার । জীবনে অজস্ৰ পুরস্কার পেয়েছেন, কিন্তু পুরষ্কার বা পদের মোহে আটকে থাকেন নি ।
‘নিরপেক্ষ কবি’ আড়ালেও নিজেকে আড়াল রাখার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেন নি । কেউ কেউ আসেন পৃথিবীতে, যারা নির্লিপ্ত ভাবে না বেঁচে পথ চলার প্রতিটি বাঁকে সমাজকে আর দেশকে দিতে আসেন। এই ধরনের মানুষ ছিলেন শঙ্খ ঘোষ । সমাজে অবদান রেখেছেন একেবারে নিজের ছন্দে, নিজস্ব প্রকরণে, নিজের শর্তে। কোন রাজনৈতিক শৃঙ্খলাতে আবদ্ধ না করেও, কোনো ভানের আড়ালে নিজেকে না রেখেও, এমনকি রাজরোষের সম্ভাবনা সত্ত্বেও রাজশক্তিকে তোয়াক্কা না করেই তিনি মানুষকে লড়াই করতে পথ দেখিয়েছেন বারবার । লিখেছেন – ‘বেঁচে থাকলেই বাঁচা সহজ, / মরলে মৃত্যু সুনির্ঘাত…’। তিনি চলার পথ নির্দেশ দেন এভাবে – ‘রাস্তা কেউ দেবে না, রাস্তা করে নিন / মশাই দেখছি ভীষণ শৌখিন’। শাসকদের চিরন্তন রূপ নিঁখুত ভাবে ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতায় – “আমি তো আমার শপথ রেখেছি / অক্ষরে অক্ষরে / যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন/ দিয়েছি নরক করে। /দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল/ অন্যে কবে না কথা…”।
পরিবর্তনের লড়াইটা যে দীর্ঘমেয়াদী সেটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন। তোষামোদে ব্যস্ত রাজকবি হতে চান নি। সেই অপরাধে নোংরা আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে বারবার। তাও থামানো যায় নি তার কলম । রাজরোষকে নির্লিপ্ততায় উপেক্ষা করেছেন । “তাঁর কবিতা কখনো শ্লোগানের পর্যায়ে নেমে আসে নি যেমন, তেমনি এতটা উচ্চমার্গের হয়ে ওঠেনি যে সাধারণের বোধগম্যতা হারিয়েছে। এখানেই তাঁর অনন্যতা”(২)।
তথ্যসূত্রঃ (১) অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, যে স্তব্ধতা সত্যকাম এবং বিপ্লবী, নতুন কবিসম্মেলন, চতুর্দশ বর্ষ, ষষ্ঠ সংখ্যা, ফেব্রুয়ারী, ২০১৮, পৃ-৭
(২) ড. বিশ্বম্ভর মন্ডল, ‘প্রতিবাদে অনন্য কবি শঙ্খ’, নতুন চিঠি, বর্ধমান, ১৩ মে, ২০২১, পৃ-৩-৪
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত।