মিয়ানমারে সহিংসতার অবসান এবং দেশটির ক্ষমতাচ্যুত নেত্রী অং সান সু চিসহ সব রাজবন্দির মুক্তির আহ্বান জানিয়ে গত ৭৪ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিষয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।
বুধবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য যুক্তরাজ্যের আনা এই প্রস্তাব ১২-০ ভোটে গৃহীত হয়েছে। এতে রোহিঙ্গা সঙ্কটের নেপথ্যের সব কারণ চিহ্নিত এবং তাদের নিরাপদ, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবসনের অনুকূল পরিবেশ তৈরির আহ্বানও জানানো হয়েছে।
গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন মিয়ানমারের নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয় দেশটি সামরিক বাহিনী। অভ্যুত্থানের পরপরই সু চিসহ তার দলের জ্যেষ্ঠ অনেক নেতা, সরকারি উচ্চপদস্থ বিভিন্ন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে জান্তা সরকার।
এরপর থেকেই দেশটিতে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করে আসছেন দেশটির গণতন্ত্রকামী হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক। জান্তা সরকার ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন ও গণতন্ত্রকামীদের বিক্ষোভ গুঁড়িয়ে দিতে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার ও বলপ্রয়োগ করছে বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশগুলোর তিনমাস ধরে আলোচনার পর বুধবার ১২-০ ভোটে যে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছে, সেটি উপস্থাপন করেছিল যুক্তরাজ্য। এই প্রস্তাবের বিপক্ষে কোনও সদস্য ভোট দেয়নি। এমনকি নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী কোনও সদস্যও ভেটো দেয়নি। তবে ১৫ সদস্য দেশের মধ্যে চীন, ভারত ও রাশিয়া ভোটদানে বিরত ছিল।
ব্রিটেনের উপস্থাপিত প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর জাতিসংঘে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত বারবারা উডওয়ার্ড বলেছেন, ‘আমরা আজ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে একটি দ্ব্যর্থহীন বার্তা দিয়েছি। এ নিয়ে তাদের কোনও সন্দেহ থাকা উচিত নয়। আমরা আশা করছি, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এই প্রস্তাব পরিপূর্ণ রূপে বাস্তবায়ন করবে।’
১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদে উডওয়ার্ড বলেছেন, ‘আমরা মিয়ানমারের জনগণের কাছেও একটি পরিষ্কার বার্তা পাঠিয়েছি। আমরা তাদের অধিকার, তাদের ইচ্ছা এবং তাদের স্বার্থের জায়গাগুলোতে উন্নতি চাই।’
মিয়ানমারের সংকট কীভাবে মোকাবিলা করা যায় তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিভক্তি রয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে। মিয়ানমারের অন্যতম ঘনিষ্ঠ দুই মিত্র চীন এবং রাশিয়া দেশটির বিরুদ্ধে যেকোনও ধরনের শক্তিশালী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আসছে। বুধবার যে ভোটাভুটি হয়েছে, তাতে অংশ নেয়নি চীন, রাশিয়া ও ভারত।
ভোটের পর নিরাপত্তা পরিষদকে জাতিসংঘের রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং জুন বলেছেন, ‘এই বিষয়ে চীনের এখনও উদ্বেগ আছে। এই সংকটের দ্রুত কোনও সমাধান নেই… শেষ পর্যন্ত এর সমাধান সঠিকভাবে করা যাবে কি না, তা কেবল মিয়ানমারের ওপরই নির্ভর করছে।’
তিনি বলেছেন, চীন চেয়েছিল নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের বিষয়ে প্রস্তাব নয়; বরং একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি গ্রহণ করুক।
জাতিসংঘে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া বলেছেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখে না মস্কো। যে কারণে মস্কো বিশ্বাস করে, মিয়ানমারের এই সমস্যায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জড়িয়ে পড়া উচিত নয়।
তবে মিয়ানমারের বিষয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গ্রহীত প্রস্তাবে স্বাগত জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, সংকট মোকাবিলা এবং বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে বার্মার সামরিক শাসনের ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়ন ও সহিংসতার অবসান ঘটাতে এটি নিরাপত্তা পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ।
প্রথম পদক্ষেপ
২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের কয়েকটি পুলিশ চৌকি ও সেনা ছাউনিতে হামলা চালায় দেশটির সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। এই হামলার পর আরাকানের সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগসহ ভয়াবহ নিপীড়ন শুরু করেন দেশটির সামরিক বাহিনী।
মিয়ানমারের সৈন্যদের নিপীড়ন থেকে বাঁচতে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা সেখান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। দেশটির সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান ‘গণহত্যা’র অভিপ্রায়ে চালানো হয়েছিল বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর এবারই প্রথম জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এই সংকটের বিষয়ে কোনও প্রস্তাব গৃহীত হলো।
যদিও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছে। দেশটি বলছে, পুলিশ চৌকিতে হামলা চালানো বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে বৈধ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।
মিয়ানমারের বিষয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাবনার ওপর আলোচনা শুরু হয়েছিল গত সেপ্টেম্বরে। খসড়া প্রস্তাবনায় মিয়ানমারে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ এবং সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুঁশিয়ারির কথা উল্লেখ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে প্রস্তাব থেকে এসব ভাষা মুছে ফেলা হয়েছে বলে দাবি করেছে রয়টার্স।
নতুন প্রস্তাবে মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার পর আরোপিত জরুরি অবস্থা এখনও জারি থাকায় ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করা হয়েছে। আর এই জরুরি অবস্থা দেশটির সাধারণ জনগণের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে উল্লেখ করে প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে।
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনা ‘দৃঢ়ভাবে এবং অবিলম্বে’ বাস্তবায়নের আহ্বানও জানানো হয়েছে নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবে। পাশাপাশি গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়া সমুন্নত রাখতে এবং জনগণের ইচ্ছা ও স্বার্থ অনুযায়ী গঠনমূলক সংলাপের আহ্বানও জানিয়েছে নিরাপত্তা পরিষদ।
মিয়ানমারের বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদে এর আগে সর্বশেষ প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। ওই সময় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তৎকালীন বার্মা, বর্তমান মিয়ানমারকে বৈশ্বিক এই সংস্থার সদস্য হিসাবে স্বীকৃতির জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল।
জাতিসংঘে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত কিয়াও মো তুনকে কিছুদিন আগে বহিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছে জান্তা সরকার। কিন্তু কিয়াও মো তুন এখনও জাতিসংঘে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছেন বলে জানিয়েছেন।
মিয়ানমারের এই রাষ্ট্রদূত বলেছেন, আমরা একেবারে পরিষ্কার যে, এটি কেবল প্রথম একটি পদক্ষেপ। জাতীয় ঐক্যের সরকার এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে সামরিক জান্তা ও তাদের অপরাধের অবসান নিশ্চিত করতে আরও শক্তিশালী পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানায়।
খুলনা গেজেট/ বিএমএস