মঞ্চটা প্রস্তুতই ছিল ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর। সে মঞ্চে তো জ্বলে উঠতে পারলেনই না, ছিলেন বড্ড বিবর্ণও। ফ্রেদেরিকো কিয়েসার সুবাদে চেষ্টা অবশ্য করেছিল জুভেন্তাস, তবে কাজে আসেনি সেটা। প্রথম লেগে ২-১ গোলে হারের পর ফিরতি লেগে ৩-২ গোলের জয়েও কাজ হয়নি তাদের। প্রতিপক্ষের মাঠে বেশি গোলের সুবাদে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে গেছে পোর্তো, ফিরিয়ে এনেছে ১৬ বছর আগের জোসে মরিনিও-যুগের স্মৃতিও।
প্রতিপক্ষের মাঠ থেকে নিয়ে আসা একটা ‘অ্যাওয়ে গোল’, নিজেদের মাঠে পোর্তোর বিপক্ষে কখনো না হারার ইতিহাস আর দলে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর উপস্থিতি; জুভেন্তাসের পক্ষে কথা বলছিল যেন সবকিছুই। তবে পোর্তো সেসবকে ভয় পেলে তবে তো? ম্যাচের প্রথম ২৫ মিনিটে জুভেন্তাস গোলমুখে সাতটা শট নিয়ে জানান দিচ্ছিল, ‘ড্র নয়, জিততেই এসেছি’!
ততক্ষণে অবশ্য পুরো লড়াই মিলিয়ে ৩-১ গোলে এগিয়ে গেছে দলটা। প্রথম লেগে যে একটা ‘অ্যাওয়ে গোল’ হজম করেছিল, শোধবোধ হয়ে গিয়েছিল সেটাও। প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে মাঠে নামলে বড় দায়িত্ব থাকে রক্ষণের কাঁধেও। কিন্তু জুভেন্তাস সেটা পারল কই? ১৬ মিনিটে বক্সে একটা অপ্রয়োজনীয় ফাউল করে প্রতিপক্ষকে পেনাল্টি ‘উপহার’ দিয়ে বসেন মাসিহ দেমিরাল। সেখান থেকে সার্জিও অলিভিয়েরার গোল।
জুভেন্তাসের তখন প্রয়োজন বেড়ে দাঁড়িয়েছিল কমপক্ষে দুটো গোলে। তবে প্রথমার্ধে যেভাবে প্রতিপক্ষ বিপদসীমার আশেপাশে গেলেই ঝাপসা হয়ে আসছিল জুভেন্তাসের আক্রমণ, তাতে কাজটা কঠিনই মনে হচ্ছিল।
প্রথমার্ধে প্রতিপক্ষ বক্সের আশেপাশে পেপেদের কড়া প্রহরায় ডালপালা গজাতে পারেনি জুভেন্তাস। তবে বিরতির পর পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। প্রতিপক্ষ রক্ষণের পেছনে ফাঁকা জায়গায় প্রবেশাধিকার আদায় করে নিতে থাকেন রোনালদো-কিয়েসারা, ক্রসেও আসতে থাকে বেশ পরিপক্বতার ছাপ। তাতেই মেলে প্রথম গোল। মাঝমাঠের কাছ থেকে লিওনার্দো বনুচ্চির বাড়ানো লম্বা বল রিসিভ করলেও ঠিকঠাক আয়ত্বে আনতে পারেননি রোনালদো, তবে তার আগেই কিয়েসার দারুণ এক প্লেসমেন্টে করা গোল জুভেন্তাসে ফেরায় মহামূল্য লড়াকু মনোভাবটা।
এরপর দুই মিনিটের ব্যবধানে দুটো হলুদ কার্ড দেখে পোর্তোকে বিপদেই ফেলে দিয়েছিলেন মেহদি তারেমি। এরপর ডান পাশ থেকে হুয়ান কুয়াদ্রাদোর ক্রসে মাথা ছুঁইয়ে যখন কিয়েসা করলেন দ্বিতীয় গোলটা, দশ জনের পোর্তোর বিপক্ষে ইতালিয়ান চ্যাম্পিয়নদের জয়টাকেই মনে হচ্ছিল ভবিতব্য। সেটা হয়েও যেত, যদি ৭৮ মিনিটে রোনালদো শটটা রাখতে পারতেন লক্ষ্যে, কিংবা যোগ করা সময়ের প্রথম মিনিটে আলভারো মোরাতার গোলটা বাতিল না হতো অফসাইডের খড়গে। কিছুটা দুর্ভাগ্যও ছিল পিরলোর দলের। নাহয় নিয়মিত সময়ের অন্তিম মুহূর্তে হুয়ান কুয়াদ্রাদোর শটটা কেন প্রতিহত হবে বারপোস্টে!
দুই লেগ মিলিয়ে ৩-৩ সমতা থাকায় খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। যেখানে শুরু থেকেই পেপের নেতৃত্বে আঁটসাঁট ছিল পোর্তো রক্ষণ, ঠিক যেমনটা থাকত ১৬ বছর আগে মরিনিও-যুগে। পুরো ম্যাচে পোর্তো রক্ষণকে জমাট রাখতে সহায়তা করেছেন পেপে, তাতে বোতলবন্দি ছিলেন তার সাবেক দুই রিয়াল মাদ্রিদ সতীর্থ রোনালদো ও মোরাতা। নিজেও পুরো ম্যাচে ১৭ বার দলকে রক্ষা করেছেন বল বিপদমুক্ত করে। তাতে অতিরিক্ত সময়ের প্রথম ভাগটাও পার হয় গোলশূন্যভাবে।
খেলা যখন টাইব্রেকারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখনই জুভেন্তাস কফিনে শেষ পেরেকটা ঠোকেন প্রথম গোলটি করা সার্জিও অলিভিয়েরা। ৩০ গজ দূর থেকে ফ্রি কিকে বল মারেন রক্ষণ দেয়ালের নিচ দিয়ে। রোনালদোর পায়ের মাঝ দিয়ে গিয়ে গোলরক্ষক ভয়চেখ সজ্যাসনিকে ফাঁকি দিয়ে বলটা জড়ায় জালে। ৪-৩ গোলে পিছিয়ে পরার ঠিক পরমুহূর্তেই আদ্রিয়েন র্যাবিওর কল্যাণে জবাবটা দিয়েছিল জুভেন্তাস। তবে অ্যাওয়ে গোল নিয়মে পিছিয়ে থাকায় দলটার প্রয়োজন ছিল আরো একটি গোল। তার দেখা আর মেলেনি রোনালদোদের।
ফলে টানা দ্বিতীয় মৌসুমে ‘অ্যাওয়ে গোল’ নিয়মে বিদায় নেয় জুভেন্তাস। আর পোর্তো ১৬ বছর পর ‘প্রথম লেগের জয়’ কাজে লাগিয়ে উঠে যায় পরের রাউন্ডে। মরিনিওর অধীনে সে বছর দলটা জিতেছিল চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা। এরপর থেকে যতবারই শেষ আটে খেলেছে দলটি, প্রথম লেগে হয় হেরেছে, নাহয় ড্র করেছে দলটি, জয় পায়নি কখনো! জুভেন্তাসকে দুই লেগে যেভাবে দমিয়ে রেখেছে, তাতে পাওয়া আত্মবিশ্বাসটা কাজে লাগিয়ে সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি নিশ্চিতভাবেই চাইবে পর্তুগীজ চ্যাম্পিয়নরা।
আরেক পর্তুগীজ রোনালদোর অবশ্য রাতটা মোটেও সুখের হচ্ছে না। তাকে দলে কেন ভিড়িয়েছিল জুভেন্তাস তা নিয়েই শেষ কিছু দিনে প্রশ্ন উঠছে ঢের। পোর্তোর বিপক্ষে এমন পারফর্ম্যান্সের পর যে তা আরো বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য!
খুলনা গেজেট/কেএম