পবিত্র রমজানের প্রস্তুতি একটু করে যেন শুরু হয়ে গেছে। কারণ রোজার শুরু হতে আর বেশি বাকি নেই। বছরের এই একটি মাস হলো সংযমের। সাধারণের জন্য মেনে চলা সহজ হলেও ডায়াবেটিস রোগীরা পড়েন দ্বিধাদ্বন্দ্বে। রোজা রাখতে পারবেন কি না বা রোজা রাখতে হলে বিশেষ কোনো সতর্কতা আছে কি না তা নিয়ে চিন্তিত হন তারা।
ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যার সঙ্গে খাদ্য ব্যবস্থাপনা ও জীবনমানের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। খাবারের ক্ষেত্রে একজন ডায়াবেটিস রোগীকে অনেক নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। সেইসঙ্গে করতে হয় সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপন।
রমজানে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে অনেকগুলো পরিবর্তন ঘটে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটে খাবারের ধরন ও খাবার গ্রহণের সময়ের ক্ষেত্রে। তবে বিশেষ কিছু সতর্কতা ও নিয়ম মেনে চললে একজন ডায়াবেটিস রোগীও নিশ্চিন্তে রোজা রাখতে পারেন।
ঝুঁকির মাত্রার ওপর ভিত্তি করে ডায়াবেটিস রোগীদের ৪টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-
১। লো রিস্ক গ্রুপ
২। মডারেট রিস্ক গ্রুপ
৩। হাই রিস্ক গ্রুপ
৪। ভেরি হাই রিস্ক গ্রুপ
খাদ্য ব্যবস্থাপনা, ওষুধ বা ইনসুলিনের মাধ্যমে যাদের ডায়াবেটিস বা রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে থাকে তাদের লো ও মডারেট রিস্ক গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ডায়াবেটিসের পাশাপাশি যারা অতিবৃদ্ধ ও নানান রোগে আক্রান্ত (কিডনিজনিত রোগে আক্রান্ত; হার্ট এটাক ও স্ট্রোকের শিকার হয়েছেন; ঘন ঘন রক্তের গ্লুকোজ কমে ও বাড়ে; যথাক্রমে হাইপো ও হাইপারগ্লাইসেমিক হবার প্রবণতা রয়েছে) তাদের হাই ও ভেরি হাই রিস্ক গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
লো ও মডারেট রিস্ক গ্রুপের ডায়াবেটিস রোগীরা রমজানের শুরুতে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে কোনো ধরনের জটিলতা ছাড়াই রোজা রাখতে পারেন। অপরদিকে হাই ও ভেরি হাই রিস্ক গ্রুপের রোগীদের একজন চিকিৎসক ও একজন পুষ্টিবিদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে থেকেই রোজা রাখতে হবে।
রোজা পালনে কী ঝুঁকি রয়েছে
সতর্কতা অবলম্বন না করলে রোজার সময় ডায়াবেটিস রোগীদের বেশকিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন-
১। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়ে যেতে পারে, রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন।
২। ভুল খাদ্যাভ্যাসের কারণে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে হাইপারগ্লাইসেমিয়া হয়ে যেতে পারে।
৩। কিটো এসিডোসিস বা হাইপার অসমোলার স্টেট হতে পারে।
৪। খুব কম পরিমাণে পানি বা ফ্লুইড জাতীয় খাবার খেলে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা এবং সেইসঙ্গে থ্রম্বোসিস ঘটতে পারে।
রোজা পালনে ঝুঁকিপূর্ণ কারা?
১। ঘন ঘন হাইপো ও হাইপার গ্লাইসেমিক ডায়াবেটিক রোগী।
২। অনিয়ন্ত্রিত টাইপ-১ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিক রোগী।
৩। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস রোগী।
৪। অতিবৃদ্ধ ডায়াবেটিক রোগী।
৫। দীর্ঘমেয়াদী কিডনি জটিলতা (বিশেষ করে স্টেজ ৩, ৪, ৫) বা ডায়ালাইসিস রোগী।
৬। মারাত্মক সংক্রমণ, ক্যান্সার, যক্ষ্মা রোগী।
৭। দিনে একের অধিক ইনসুলিন নেন যারা।
এছাড়া হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, অধিক কায়িক পরিশ্রমকারী ডায়াবেটিস রোগীদের রোজা রাখার ক্ষেত্রে খুব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা
পবিত্র রমজানে খাবার খাওয়ার সময়সূচী পরিবর্তিত হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই ওষুধ ও ইনসুলিনের মাত্রা ও সময়সূচীও পরিবর্তিত হয়। এর মধ্যে কোনো অনিয়ম হলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অনেক কমে বা বেড়ে যেতে পারে। তাই কোনো ডায়াবেটিস রোগী রোজা রাখতে চাইলে তাকে খাদ্য ব্যবস্থাপনায় অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে। এক্ষেত্রে করণীয় হলো-
১। সেহরির শেষ সময়ের অল্প কিছুক্ষণ আগে খাবার গ্রহণ করতে হবে।
২। সেহরিতে লাল চালের ভাত, লাল আটার রুটি বা চিড়া বা ওটস, দুধ, কলা, মাছ, মাংস, সবজি, ডাল রাখার চেষ্টা করতে হবে।
৩। ইফতারে অতিরিক্ত ভাজাপোড়া খাবার, মিষ্টি ও চর্বি জাতীয় খাবার গ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে।
৪। ইফতার শুরু করতে পারেন নবীজী (সঃ) এর সুন্নাহ্ ১টি খেজুর দিয়ে। এছাড়া কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স যুক্ত ফল, ফলের জুস, টক দই, ডাবের পানি, চিড়া, একটা ছোট চাপা কলা, কাবাব, রুটি ইত্যাদি খেতে পারেন।
৫। ডায়াবেটিক রোগীদের পর্যাপ্ত পানি ও পুষ্টিকর তরল খাবার খেতে হবে, যেন পানিশূন্যতায় না ভোগেন।
৬। রাতে হালকা খাবার যেমন- স্যুপ, লাল আটার রুটি, মাছ বা মাংস, ওটস, চিড়া খেতে পারেন।
৭। সেহরিতে অবশ্যই চেষ্টা করুন লাল আটার ভাত বা রুটি খেতে। সাথে রাখুন মাছ বা মাংস, সবজি, ডাল। এক গ্লাস দুধ খেতে পারেন, যা সারাদিন আপনাকে কর্মক্ষম রাখতে সাহায্য করবে।
রমজানে একজন ডায়াবেটিক রোগী সেহরি, ইফতার, রাতের খাবারে কী খাবেন তার একটি তালিকা দেওয়া হলো-
সেহরি
ভাত- ১ থেকে ১.৫ কাপ
মাছ বা মাংস- মাঝারি মাপের ১ টুকরা
সবজি- ১.৫ থেকে ২ কাপ (আলু ও মিষ্টি কুমড়া বাদে)
ডাল-১ কাপ (মাঝারি ঘন)
দুধ- ১ গ্লাস (২৫০ মিলি)।
ইফতার
খেজুর- ১ দিন পর পর ১টি (কিডনিজনিত সমস্যা থাকলে খেজুর এড়িয়ে চলবেন)
ছোলা- আধা কাপ
মুড়ি- আধা কাপ
ফল- যেকোনো টক ফল বা ফলের জুস, ডাবের পানি
টক দই- আধা কাপ
মাঝে মাঝে বাসায় রান্না করা চটপটি বা হালিম খেতে পারেন ১ কাপের মতো।
রাতের খাবার
লাল আটার রুটি- মাঝারি সাইজের ২টি (পাতলা)
মাছ বা মাংস- ১ টুকরা (মাঝারি সাইজ)
সবজি মিক্সড সবজি- ১.৫ থেকে ২ কাপ (মিষ্টি কুমড়া ও আলু বাদে)
ডাল- ১ কাপ (মাঝারি ঘন)।
(রোগী ভেদে পরিমাণ ভিন্ন হবে। তাই একজন অভিজ্ঞ পুষ্টিবিদের পরামর্শ মতো রমজানের দৈনিক খাদ্যতালিকা তৈরি করে নেওয়া উচিত।)
ওষুধ ও ইনসুলিন
রোজা শুরুর আগেই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে ওষুধের মাত্রা ও সময়সূচী সমন্বয় করে নিতে হবে। যারা ওষুধ খান তারা সকালের ডোজ ইফতারের শুরুতে এবং রাতের ডোজটি অর্ধেক পরিমাণে সেহরির আধা ঘণ্টা আগে খাবেন। যারা ইনসুলিন নেন, তারা সকালের ইনসুলিন ডোজটি ইফতারের আগে আর রাতের ডোজটি কিছুটা কমিয়ে সেহরির আধা ঘণ্টা আগে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গ্রহণ করবেন।
হাঁটা ও ব্যায়াম
রোজা রেখে দিনের বেলা অতিরিক্ত হাঁটা বা যেকোনো ভারী কায়িক পরিশ্রম না করাই ভালো। ৫ ওয়াক্ত নামাজ ও সময় নিয়ে তারাবীহ নামাজ আদায় করা রমজানে শারীরিক ব্যায়ামের বিকল্প হিসেবে কাজ করে।
মনে রাখা জরুরি
১। রোজা রেখে কখনোই আগের মাত্রায় ওষুধ বা ইনসুলিন নেবেন না। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজে নিজে ওষুধ বা ইনসুলিন সমন্বয় করবেন না। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
২। রোজায় ক্যালরি ঠিক রেখে শুধু খাদ্য উপাদান ও খাওয়ার সময় পরিবর্তিত হবে।
৩। ইফতারে অতিভোজন এবং সেহরিতে অল্পভোজন থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে।
৪। সেহরিতে কোনো অবস্থায়ই না খেয়ে বা সামান্য কিছু খেয়ে রোজা রাখা যাবে না।
৫। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে সাড়ে ৭টা, বিকাল ৪টা থেকে সাড়ে ৪টা, ইফতারের ঠিক আগে এবং ইফতারের ঠিক ২ ঘণ্টা পরে গ্লুকোমিটারে রক্তের গ্লুকোজ লেভেলের চার্ট বানিয়ে ফেলতে হবে। কোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে বা রক্তের গ্লুকোজ লেভেলে অসামঞ্জস্য দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। রক্তের গ্লুকোজ লেভেল কমে ৩.৯ মিলিমোল/লিটারের নিচে এসে রোগী হাইপো হয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে কখনোই মুখে চিনির পানি বা অন্য কিছু খাওয়াতে যাবেন না। এক্ষেত্রে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
লেখক: পুষ্টিবিদ, লিভ হেলদি বিডি।
খুলনা গেজেট/কেএ