১. নতুন রুবাইয়াত
মুস্তাফা জামান আব্বাসী
‘রুবাই’ শব্দটি পারস্য ভাষার। সেখান থেকে রুবাইয়াত অথবা রুবায়াত, কয়েকটি রুবায়াতের সমষ্টি, যাতে চারটি লাইন আছে। রুবাইয়াতে ওমর খাইয়াম অনুবাদ করেছেন ইংরেজিতে এডওয়ার্ড ফিটসজেরাল্ড, যাতে ওমর খাইয়াম বিশ^বিখ্যাত হয়েছেন। তার সবক’টি অনুবাদ বিশে^ সাড়া জাগিয়েছে। আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম সেই একই পদ্ধতিতে রুবাইয়াতে ওমর খাইয়ামের অনুবাদ করেছেন। রুবাই এক বচন, রুবাইয়াত বহুবচন। যদিও ছোট আকারের কবিতা, তবু এর মধ্যেই প্রস্ফুটিত গোলাপের বাগিচা। এর আঙ্গিক, মাত্রা, ছন্দ ও শিল্প সমৃদ্ধ জ্যোতির্ময় ভাষা একে দিয়েছে অনুপম সৃষ্টি উৎকর্ষ। বাংলায় ইদানিং কিছু রুবাইয়াতের স্রষ্টার নাম পাওয়া যায়। এরা: মোসলেম উদ্দিন, আবদুস সাদেক ও কাবেদুল ইসলাম।
সম্প্রতি আমার হাতে এসেছে ‘রুবাইয়াত-ই-গাজী আবদুল্লাহেল বাকী’। তার ১৫৭০ টি রুবাইয়াত আমার সামনে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করার পর আমার মনে হল স্বয়ং নজরুল আবার আবির্ভূত অথবা ওমর খাইয়াম নবরূপে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছেন। এর বিষয়বস্তু ভালবাসা, প্রেম, সঙ্গিরা প্রেমের সাকী। ইরানের আবহাওয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সাজুয্য নেই তা ঠিক নয়। যখন ইরানে যাই তখন সেখানে যেমন হাসনু হেনা পেয়েছি, তেমনি পেয়েছি নানা বর্ণের নানা গন্ধের গোলাপের বাগান। যেন শেষ হতে চায় না। আরও পেয়েছি সেই পাখিদের, যাদের শীষ আমরা পাই বাংলাদেশে, যেমন বুলবুলি অথবা কৃষ্ণ কোকিল। অনেকে শরাবপায়ী, কিন্তু এই শরাব প্রেমের। রবের সাথে নিঘুম প্রিয়ার সহজেই দেখা হয়ে যায়। যে জ্যোতির অনুসন্ধান প্রকৃতিতে তা এসে যায় আশেকের জ্যোতির অয়নে।
রুবাইগুলো একদিনে পড়ার মত করে লেখা হয়নি। কারণ এর মেজাজ একেকটির একেক রকম। যে প্রেমিক নয়, তার কাছে এই পঙক্তিগুলোর মূল্য তেমন হবে না। মাঝখানে অনেক ছবি আছে, যে ছবিগুলো অশ্রুজলের, লাল গোলাপের ও সমুদ্রের লবণাক্ত পানির। উদাহরণ দিতে গেলে অনেক দেয়া যাবে। তাতে পাতা ভরবে। উদ্দেশ্য, শ্রোতাদের আকৃষ্ট করা, তাই কয়েকটি এখানে উদ্ধৃতি করছি।
ঠোঁটটি রাঙা মধুর রঙে প্রদায়িনী মানস সাকী,
হই যে আমি পরকীয় মানব স্বভাব দেয় যে ফাঁকি।
শরাব পানে মশগুল আমি, তোমার মঞ্জিল কোন সুদূর,
বিশে^ আমি বেওয়ারিশ তাই, নিত্য দয়াল প্রভুর ডাকি।
শেষ রুবাই প্রভুর পানেই:
মাফ করে দাও মহান খোদা, অধম বাকীর এই আরজ,
কবুল করে নাও এ সিজ্দা, কর আমার দিল সহজ।
তোমার পথেই চালাও মোরে, পাপী আমি দীন ফকির,
পারিনি যে করতে পালন তোমার আদেশ সব ফরজ।
(মুস্তাফা জামান আব্বাসী : সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তি)
২. বাংলা সাহিত্যে মৌলিক রুবাই
অধ্যাপক নৃপেন্দ্রলাল দাশ
গাজী আবদুল্লাহেল বাকী রচিত রুবাইগুলি বাংলা সাসঙ্গ সমজদার। ওমর খৈয়ামের খ্যাত কীর্তি রোবায়েত তার প্রেরণার উৎস মূল হলেও তিনি স্বকীয় সৃজনধর্মকে এই রুবাই রচনায় বহমান রেখেছেন। বাকী সাহেবের সাফল্য হচ্ছে বিষয়ের বহুমাত্রিকতা। তার রুবাই নানা বিষয় প্রকরণকে ধারণ করে রেখেছে। নিসর্গ, স্বদেশ, আত্মচেতনা ও অসীমতার এক লাবন্যময় প্রকাশ দেখা যায় তার এই বৈচিত্রময় ফুলের চাষে। ফার্সি রুবাই হচ্ছে চার পংক্তির, তৃতীয় চরণ অমল; প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ পংক্তির ছন্দ মিল আলাদা আঙ্গিকরূপে বিশ্বসাহিত্যে মৌল নান্দনিকতাকে প্রকাশ করেছে। বাকী হচ্ছেন সেই শৈলীরই বিনীত বাসিন্দা।
গাজী আবদুল্লাহেল বাকীর বিপুলায়তন বই ‘রুবাইয়াত-ই-গাজী আবদুল্লাহেল বাকী’ একজন নিবিড় পাঠকের চিরসঙ্গী হওয়ার যোগ্যতা রেখেই সৃজিত হয়েছে। তার রস প্রকাশ, তার বাণীভঙ্গি, তার ছন্দশাসন–সবই পরিশীলিত। তার শুদ্ধতম রুবাই খৈয়ামের মনের জগতকে স্পর্শ করেছে। বহুভাষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলী কাজী নজরুল ইসলামের ওমর খৈয়াম এর অনুবাদ পড়ে লিখেছিলেন, “কাজীর অনুবাদ সকল অনুবাদের কাজী”। বর্তমান দৃষ্টিকোণ থেকে তাই এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে গাজীর মৌলিক রুবাইয়াত, সকল রুবাইয়াতের গাজী। এ কথাও বলা যায়, সকল রুবাই থেকে বাকীর রুবাই বেশী বাহাদুর এবং তার এই মৌলিক সৃজনকর্ম বাংলা সাহিত্যের এক নন্দনতাত্মিক নতুন সংযোজন। যাহোক, পাঠক যুক্ত হবেন, প্রীত হবেন। বাকীর কয়েকটি রুবাই আমরা আস্বাদন করতে পারি।
১.
প্রিয়ার সাথে প্রেম করিতে হরিষ লাগে অন্তরেতে,
প্রিয়া আমার ফুলের ডালা সুবাস ছড়ায় জীবন স্রোতে।
জোছনা রাতে বর্ষাজলে নাইছি যখন অঙ্গ মেলে,
এমন দৃশ্য দেখতে ব্যাকুল সৃষ্টি সকল পুলকেতে। (রুবাই নং: ৩৩)
২.
শ্যামল বাংলা রূপের ঝলক দেখতে কেন পাই না আর,
মানবতায় ভর করেছে সন্ত্রাসী আর হিংসাচার।
নর পিশাচ উঠছে হেসে বাড়ছে ধারা চোখের জল,
কোথায় বিচার শক্ত শাসন রুখবে কে ঐ দানব-নার? (রুবাই নং: ১৪৭)
৩.
ঊষার কোলে রবি যেমন চমক দিয়ে দোল দোলায়,
প্রিয়ার হাতের অঙ্গুরিটি তেমনি সাজে মন ভোলায়।
পান্না-চুনি, হীরা মানিক কোন অরণি অঙ্গে তায়,
পরশ পেয়ে জীবন তাদের হর্ষ পুলক সুর উছলায়। (রুবাই নং: ২৮৩)
সংকলিত রুবাই হয়ত প্রতিনিধি স্থানীয় নয়। আমার ব্যক্তি রুচির পছন্দ থেকেই নির্বাচন করা। এতে স্পষ্ট হবে একজন রসভোক্তা পাঠকের রুচি ও আস্বাদ। কবি বাকীর রুবাইগুলির সারল্যও আমাকে মুগ্ধ করেছে। পা-িত্যকে লুকিয়ে সৃষ্টিকলাকে প্রকাশ করা মেধাবীজনেরই কাজ। সে কাজে তিনি সিদ্ধি লাভ করেছেন। তার কাব্য শক্তিকে সালাম জানাই। তিনি অপ্রসন্ন হবেন, নয়তো বলতাম জোর গলায়–লাল সালাম। লোভ সামলাতে না পেরে আরেকটি রুবাই উল্লেখ করলাম।
পাপশালা আর পুণ্যশালা পাশাপাশি বিরাজ করে,
পথ সীমাহীন দুয়ের মাঝে হাঁটলে পরে ফুরায় না’রে।
শরাবদানি আর মদ-অলস ধারণ করে দেহের নেশা,
প্রেমের ভালে চাহনি হেনে কান্দে আঁখি জারে জারে। (রুবাই নং: ৬৪০)
বহুলভাবে পঠিত হোক বাকীর রুবাইয়াত, এটাই আমার একান্ত অভিপ্সা।
(অধ্যাপক নৃপেন্দ্রলাল দাশ একজন বিশিষ্ট কবি, লেখক, গবেষক, মরমীবাদে বিশেষভাবে জ্ঞানী, সত্যানুসন্ধানী ও সওর এর বেশী পুস্তকের রচয়িতা)