খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ পৌষ, ১৪৩১ | ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ব্রাজিলে দুর্ঘটনায় বাসে আগুন, পুড়ে নিহত ৩৮

রাহুগ্রাাস (পর্ব ০৯)

গৌরাঙ্গ নন্দী

গ্রামে-গঞ্জে এখন কাজ কমে গেছে। দিনমজুরির কাজ নেই বললেই চলে। কাজ যা কিছু তা ওই চিংড়ি- ঘেরকে কেন্দ্র করে। প্রধানত: চিংড়ি ঘের পাহারা দেওয়া; আর গোণের সময় চিংড়ি ধরা ও বিক্রি করা। এসব কাজে লোক কম লাগে। তাছাড়া চিংড়ি ঘের মালিকরা স্থানীয়দের এসব কাজে লাগায় না। এ কাজে শহর বা অন্যান্য এলাকার মানুষদের নিয়ে আসে। স্থানীয়রা চিংড়ি ঘের করতে দিতে চায়নি, তাই ঘের-মালিকরা স্থানীয়দের শত্রæ মনে করে। গ্রামে এখন নতুন পেশাজীবী গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে-পোনাজীবী। এরা চিংড়ি পোনা ধরে, বিক্রি করে। পাশাপাশি অনেকেই চিংড়ি কেনাবেচার কাজও শুরু করেছে। এতে টাকা লাগে। শিবু’র টাকা নেই। ব্যবসার জন্যে ঝুঁকি নিতে হয়, তা সে নিতে পারে না। ভয় পায়। যদি সে হেরে যায়, যা আছে সেটুকুও যদি হারিয়ে ফেলে। এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে নদীতে ভাটার টান শুরু হলেই সে তেকোণা জালটি নিয়ে নদীর দিকে রওনা দেয়। সেই সময়েই অনিতার ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর। ‘আজ কিন্তু জল আনতি হবেনে। মনে থাহে যেনো।’

ওই আর এক ফ্যাসাদ। খাওয়ার জল পাওয়া যায় না। শিবু তার জন্মের পর থেকেই দেখছে, ঘরের কোণে চাল বরাবর একটি বড় মাইঠ। বৃষ্টি হলে চাল থেকে গড়িয়ে পড়া জল ওই মাইঠে জমা হয়। ওই জমা জলই তারা পান করে। অবশ্য, তাতে খুব বেশীদিন চলে না। আবার মাসখানেক পরেই ওই জলে পোকা দেখা দেয়। এ কারণে ফিটকিরি দেওয়া হয়। দুই-তিন মাস এই জলে প্রয়োজন মিটলেও বছরের বাকী সময়ের জন্যে পুকুরের জলই ভরসা। সরকারের উদ্যোগে বড় বড় পুকুর কাটা হয়। পাশে মÐলদের বাড়িতেও পুকুর ছিল। স্কুলেও বড় পুকুর ছিল। ওইসব পুকুরে গরু যাতে নামতে না পারে সেকারণে পাড় ছিল উঁচু। কোন মানুষকে ¯œান করতেও দেওয়া হতো না। কেউ কখনও ¯œান করলেও সাবান ব্যবহার করা ছিল একদম নিষিদ্ধ। কিন্তু সেইসব পুকুরগুলোও আজ চিংড়িচাষীদের দখলে। সরকারের পক্ষ হতে সরকারি পুকুর লিজ নিয়ে চিংড়ি চাষীরা তাতে চিংড়ি চাষ শুরু করেছে। স্কুলের পুকুরটি এখনও টিকে আছে। সেখান থেকেই গ্রামের মানুষ খাওয়ার জল সংগ্রহ করে। তারাও সংগ্রহ করে। পাড়ার বৌ-ঝিরা বিকেল বেলায় দল বেঁধে সেখান থেকে জল আনে। কলসি কাঁখে করে মেয়েরা সারিবদ্ধভাবে জল আনে। অনিতাও আনে। কিন্তু আজ কি হলো, বুঝা গেলো না। অবশ্য, মাঝে মাঝেই সে বলে, ‘জল আনতি হবে।’ আজও সে জল আনার কথা বলে। তাহলে কি তার শরীর খারাপ।

শিবু একদÐ ভাবে। অনিতার শরীর খারাপ কি-না, জানতে চাইবে। আবার ভাবে, না, দরকার নেই। কিছু জানতে চাইলেই যদি অনিতা রেগে যায়। কি দরকার, শুধুশুধি মুখ কালা-কালি করার। অশান্তি যতো এড়ানো যায়, ততোই ভালো। শিবু বাড়ি থেকে বেরোয়। সেই সময়েই বাড়ির দিকে আসে সমীরণ। সমীরণ শিবুকে বলে, ‘দাদা, তুমি কি পোনা ধরতি যাচ্ছ?’ শিবু মাথা নেড়ে জবাব দিয়ে এগোয়। সমীরণ বাড়ির মধ্যে যায়। আজকাল সমীরণকে দেখলে সে কেন যেন বিরক্ত হয়। সমীরণদের অবস্থা ভালো। নিজেদের জমিতেই এখন চিংড়ি ঘের করে। হাতে বেশ নগদ টাকা। সে আবার চিংড়ির কেনা-বেচা করে। ছোট ছোট ঘের মালিকদের কাছ থেকে চিংড়ি কেনে। কামারখোলা বাজারে একটি ঘর নিয়েছে। তাতে দু’জন কর্মচারী খাটে। আর সে ঘুরে ঘুরে চিংড়ি কেনা-বেচার তদারকি করে। ইদানিং সে এ বাড়িতে বেশ আসে। সমীরণের উপস্থিতিতে অনিতা বেশ খুশী হয়। মেয়েটাও বেশ আহলাদিত হয়। ওর জন্যে প্রায়ই টুকিটাকি নানা কিছু কিনে নিয়ে আসে।

শিবু কিছু একটায় ধাক্কা খায়, হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল। নিজেকে সামলে নেয়। দেখে, সে নদীর কুলে চলে এসেছে। নিজেকে সামলে নিতে না পারলে নদীতেও পড়ে যেতে পারতো। ধীরে-সামলে নদীতে নামে। তবে জাল টানায় সে মনোযোগী হতে পারে না। এক অস্থিরতা পেয়ে বসে তার মধ্যে। এভাবেই প্রায় ঘন্টাখানেক কেটে যায়। জাল ছেঁকে দেখে মাত্র গোটা চারেক চিংড়ি পোনা ধরা পড়েছে। এতে মেজাজটি বিগড়ে যায়। জাল গুছিয়ে নিয়ে শিবু বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে বাড়ি পৌঁছায়। বাড়ির বাইরে থেকেই সে অনিতা এবং সমীরণের হাসির শব্দ শুনতে পায়, সে থমকে দাঁড়ায়। কি যেন ভাবে। জালটি বাইরের এক কোণে রাখে। আবারও নি:শব্দে বাড়ি হতে বের হয়ে যায়। অনিতা বা সমীরণ জানতে পারে না, শিবু বাড়ি এসে তাদের কথাবার্তা শুনে আবারও নীরবে ফিরে চলে গেছে।

পথিমধ্যে দেখা হয় পরিমলের সাথে। পরিমল বলে, ‘শিবু দা বনে যাবা মাছ ধরতি। ওই, মাছ মানেতো চিংড়ির পোনা; যাবা ধরতি। মাত্র চারদিন। তারপরই চলে আসবো। আমার নৌকায় হারানের যাওয়ার কথা ছিল; কিন্তু হঠাৎ করেই বলছে, ও যাবে না; কি যেন অসুবিধা। তুমি গেলি বড্ড ভালো হয়।’

শিবু বিনা বাক্য ব্যয়ে পরিমলের সাথে যেতে রাজি হয়। শিবু কি কোন কিছু হতে পালাচ্ছে? তা কেন! বনেতো সে আগেও গেছে। তবে এভাবে প্রস্তুতিহীনভাবে, কাউকে না জানিয়ে সে কোনদিন যায়নি। আজ কেন জানি, বাড়ির কাউকে না জানিয়েই চুপিচুপি সে বনে চলে যায়। প্রকৃতপক্ষে, সে যেন কাউকে এড়াতে চাইছে। কারও কাছ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চাইছে। দূরে থেকে কি কোন সমস্যার সমাধান হয়। হোক বা না হোক, তার ভালো লাগছে না, সে দূরে যাবে, তাই কাজের সুযোগে বনে চলে যাওয়া।

দু’দিকের বড় বাইন গাছগুলো খালটির উপর যেন ছায়া দিয়ে রেখেছে। মা যেমন তাকে সবসময় আঁচলের তলায় রাখতো। দূরে দূরে দু’-একটি সুন্দরী গাছ। তার আগামরা। নদীর ধার দিয়ে ছোট ছোট গাছের সারি বেশী। একটি ধুন্দল গাছ চোখে পড়ে। গাছটি ছোট, এ কারণেই হয়তো টিকে আছে। ধুন্দল গাছে ভালো ফার্ণিচার তৈরি হয় বলে এই গাছ আর নেই বললেই চলে। চুরি হয়েছে। যাদের ক্ষমতা আছে, তারা বনে ঢোকে, আর গাছ কেটে নিয়ে চলে যায়। বন রক্ষায় নিয়োজিতরা তাদের কিছু বলতে পারে না। বন-কর্মীদের হাতের বন্দুকের চেয়ে ওই চোরেদের হাতিয়ার অনেক বেশী আধুনিক, তারা ক্ষমতাশালীও। কিছু বললেই তার চাকুরিক্ষেত্রেই বিপদ হতে পারে।

শিবুকে গম্ভীর হয়ে বসে থাকতে দেখে পরিমল বলে ওঠে, ‘এই শিবে দা, কি হলো তোমার। বনের মধ্যি আইসে তোমার কি আবার বৌদির কথা মনে পড়লো। আর, তোমারে নিয়ে পারা যায় না। তুমি কি বৌদিরে ছাড়া এক রাত্রিও বাইরে থাকতি পারো না।’

‘এই পরিমল তুই থাম।’ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে ওঠে শিবু। তপন দেখে-শুনে পরিমলের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, ‘এই তোর সবসময় উল্টোপাল্টা কথা ক্যান। তুইতো আমারে কলি, শিবু দা’ এক কথায় রাজি হইছে। আসতি না চালি কি কেউ এক কথায় রাজি হয়। প্যাটের জ¦ালা বড় জ¦ালা, বুঝলি। ভালো ভালো কথা অনেকেই বলতি পারে, কিন্তু খাতি কি কেউ দেয়। খাওয়ার তা নিজিগি জোগাড় করতি হয়। ওই দ্যাহোনা, চিংড়ির ফলন ভালো নেই; আবার সবাই ধান চাষে ফিরতি চাচ্ছে।’

শিবু বলে, আমাদের এখানকার মানুষেরা কোনদিনই চিংড়ি চাষ করতি চায়নি। কিন্তু বাধা দিতিও পারেনি। টাউনির লোকেরা আইসে চিংড়ি চাষ শুরু করে।

তপন বলে, এহোনত এই গ্রামের মানুষরা চিংড়ি চাষ করে। আর ওই মাথায় আছে হামিদ সাহেব। তবে গ্রামের মানুষগুলো আর ভালো নেই, গ্রামের মানুষগুলোও চিংড়ি চাষ করতি চায় না। কি এইরেই বা চাষ করবে! ধান হয় না। খাওয়ার জলের সংকট। চিংড়ির টাহায়তো আর সব হয় না। চালির দাম বাড়তিছে হু হু করে।

পরিমল বলে, হুমম, সেদিন বাজারে চেয়ারম্যান বলতিছিল, সারা বিশে্ব ই না-কি খাদ্যশস্যের সংকট দেখা দিছে। এই কারণে দাম বাড়তিছে।

এই তুই আবার বিশ^ নিয়ে পইড়ে মরলি কেন? আমরা আদার ব্যাপারি, জাহাজের খোঁজ নিয়ে কি করবো। রতন বলে ওঠে। পরিমলও পাল্টা জবাব দেয়, ওরে একটা দেশের সাথে আর একটা দেশের সম্পর্কতো আছে। আমাইগেতো চাল আমদানি করতি হয়। এবার না-কি আমাইগে সরকার চাল আমদানি করতি পারতিছে না। আশেপাশের কোন দেশ না-কি আমাইগে কাছে চাল বিক্রি করবে না।

কোন দেশের উদ্বৃত্ত থাকলি, তাই বিক্রি করে। হয়তো সেইসব দেশের উদ্বৃত্ত নেই, তাই বিক্রি করবে না। আগেতো নিজের দেশের প্রয়োজনের কথা, পরে বিক্রি। শিবু বেশ ধীরে-সুস্থে বলে, চিংড়ি চাষীরা কইছিল, চিংড়ি বেইচে ডলার আনবে; সেই ডলার দিয়ে প্রয়োজনে চাল কেনবে। কিন্তু এহোন তা পারতিছে না। প্রয়োজনে যে, টাহা থাকলিও কিছু পাওয়া যায় না, তাতো এখন দেহা যাচ্ছে। আর খাওয়ার জলের কষ্টতো সীমাহীন।

খাওয়ার জলের কথা মনে পড়তেই শিবুর মনটি চঞ্চল হয়ে ওঠে। অনিতা বলেছিল, আজ খাওয়ার জল আনতে হবে। হায়, একে না বলে-কয়ে বনে চলে আসা; তারপর জল না আনা। সকলেতো কষ্ট পাবে। কি এক বেদনায় নিজেই যেন মিইয়ে যায়। হঠাৎ কি হলো তার, এভাবে চলে আসতে হলো। বলে-কয়ে, জল এনে দিয়েইতো আসতে পারতো। আচমকাই ঝোঁকের মাথায় এ কাজটি করা ঠিক হলো না।

আগে এলাকায় শুধুমাত্র আমন ধান উৎপাদিত হতো। আর কিছু না হোক, তাতে ঘরে ধান থাকতো। সারা বছর খাওয়ার নিশ্চয়তা ছিল। অন্য কিছুর পয়সা জোগাড় করতে না পারলেও শুধুমাত্র নুন জোগাড় করেই ভাইটেল চলের মিষ্টি ভাত খাওয়া চলতো। আহা, সকাল বেলায় ফেনা ভাতের সাথে তেঁতুল গুড়, এক অপূর্ব স্বাদের খাবার। শিবুর মুখে যেন কবেকার সেই সকাল বেলার খাবারের স্বাদ এখনও লেগে আছে। এখন কিছু মানুষের হাতে নগদ টাকা এসেছে ঠিকই, কিন্তু খাওয়ার নিশ্চয়তাটুকু চলে গিয়েছে। আর শিবুদের মতো মানুষদের অবস্থা আরও খারাপ। নিজেদের জমি বলতে নেই, যা আছে, তাতে না করা যায় ধানের ফসল, না করা যায় চিংড়ি চাষ। কথায় আছে না, মরতি মরণ শানাইদারের। যতো জ¦ালা, গরীব মানুষের। তবে এবারের উপলব্ধিটা অন্যরকম। টাকা থাকলেও প্রয়োজনীয় পণ্য কেনা যায় না। সরকারের কাছে টাকা ছিল, কিন্তু কোন দেশ থেকেই চাল কিনতে পারেনি। তাহলে কি, টাকা থাকলেই সবসময় সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না। নিজের ভাবনায় বিস্মিত হয় শিবু।

এলাকার মানুষেরা এসব কারণে সিদ্ধান্ত নিয়েছে চিংড়ি চাষ আর করবে না। এলাকার প্রায় সকল চিংড়ি চাষীরা একমত। খাবারের নিশ্চয়তা চাই। এ কারণে সকলেই ধানের উৎপাদন করতে চায়। নোনার কারণে পুড়ে যাওয়া জমিতে ফলন ভালো হবে না বলে আলোচনা চলছে। কিন্তু মানুষ এক, দুই বছর এই ক্ষতি মেনে নিতেও রাজি। এক, দুই বছর কম উৎপাদন হলেও পরবর্তীতে ভালো ফলন হবে। তবে কোনভাবেই চিংড়ি চাষ হতে সরতে চাইছিলেন না শহরবাসী-চিংড়ি-চাষী হামিদ সাহেব। ভদ্রাপাড়ের পশ্চিম দিকে বন অফিসের পাশে বিশাল এলাকাজুড়ে তার চিংড়ি ঘের। গ্রামবাসী তার কাছ থেকে ঠিকমতো হারির টাকাও পায় না। এই নিয়ে ক্ষুব্ধতা ছিল। আর ২০০৮ সালের দুনিয়াজোড়া খাদ্য সংকটের ফলে ধান উৎপাদনের প্রতি মানুষের আকর্ষণ ওই মানুষটির প্রতি বিরূপতা আরও বাড়িয়ে তোলে।

একদিন তপন মÐলদের একটি গরু খাবারের সন্ধানে হামিদ সাহেবের চিংড়ি ঘেরের বাসার কাছে চলে যায়। খাবার কিছু পেয়েছিল কি-না, তা বুঝা যায়নি; তবে হামিদ সাহেবের ঘের-কর্মচারীরা গরুটাকে বেদম পিটিয়ে আটকে রাখে। গরু অবলা প্রাণী। এমনিতেই এলাকায় গরু নেই বললেই চলে। আগে বিলে গরু অবাধে চরে বেড়াতে পারতো, বিশেষত: ধান উঠে যাওয়ার পর বিল ফাঁকা থাকতো। এখনতো প্রায় সারাবছরই নোনা পানিতে বিল টই-টম্বুর। এ কারণে পোষা প্রাণী গরুর আকাল। শিশুদের জন্যেও দুধ মেলে না। যা দু-একজনের আছে, তা প্রায় তোলা খাবারের জোগান দিতে হয়। সেদিন কোনভাবে তপন মÐলের ডেরা থেকে গরুটা চলে গিয়েছিল, আর পড়বিতো পড় মালির ঘাড়ে – ওই চিংড়ি-ঘের মালিক হামিদ সাহেবের ডেরাতেই হামলে পরতে হলো।

তপন গরুটি ফেরত পাওয়ার জন্যে তাদের ওখানে গেলে ঘের কর্মচারীরা তার উপর খুবই চোটপাট করে। গরুতো ফেরত দেয় না, উপরন্তু ওই গরু বিক্রি করে দেওয়া হবে বলে তাকে শাসায়। কেন তাদের ক্ষতি করা হলো! কি ক্ষতি তা যদিও পরিস্কার নয়। তপন মনোবেদনা নিয়ে ঘেরের বাড়ি হতে ফিরে আসে। এই কথাটি এক এক করে বাজারের লোকের মধ্যে ছড়ায়; পরবর্তীতে গ্রামের লোকের মাঝেও তা ছড়ায়। গ্রামবাসী এমনিতেই হামিদ সাহেবের উপর ক্ষুব্ধ ছিল, আর তার সাথে গরু আটকে রাখার ঘটনায় ক্ষুব্ধতা বাড়ে। ঠিক যেন, দেয়াশলাই কাঠির বারুদে ছোয়া লাগা। অমনি দপ করে জ¦লে ওঠার মতোই এলাকার মানুষ ফুঁসে ওঠে। সমবেতরা হামিদের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে শুরু করে। মুহূর্তেই শ্লোগানধারীরা ওই ঘেরের দিকে চলতে শুরু করে। মিছিল এগোয়, লোকজনও বাড়তে থাকে। তাতে উত্তেজনা ক্রমশ: বৃদ্ধি পায়। উত্তেজিত মিছিলকারীরা এগিয়ে গিয়ে ঘেরের বাসায় হামলা করে। দু’জন ঘের কর্মচারীকে তারা উত্তম-মধ্যম দেয়। ওই সময়ে ঘের মালিক হামিদ সাহেবও নাকি সেখানে ছিল, তাকেও নাকি উত্তেজিতরা দু’-এক ঘা বসিয়ে দেয়। অবশ্য, এসব নিয়ে ভিন্নমত আছে। তবে হামিদ সাহেব সেদিন নিজেকে রক্ষা করতে ঘের ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল, এটি সত্যি। এতে তাৎক্ষণিকভাবে তপন যেমন গরু ফেরত পায়, তেমনি হামিদ সাহেবের পালিয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে চিংড়ি ঘেরটিও উঠে যায়। তিনি আর সেখানে চিংড়ি চাষ করতে আসেননি।

শিবুর চোখের সামনে পঁচিশ-ত্রিশ বছরকালের মধ্যেকার ব্যবধান ধরা পড়ে। শুরুতে এই চিংড়িচাষীরা এলাকার মানুষের উপর হামলে পড়েছে, দখল-দমন-হত্যা-লুট কি-ই-না করেছে; আর এখন এলাকার মানুষ সেই চিংড়িচাষীদের উপর হামলে পড়ে এলাকাছাড়া করছে। অবশ্য, শুরুর দিককার চিংড়িচাষীরা অনেক আগে থেকেই এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছে। সময়ের সাথে সাথেই চিংড়ি চাষী পাল্টেছে, মানুষের মনোভাবও পাল্টেছে। ক’দিন পরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে প্রার্থীরাও এলাকাবাসীর দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রতিশ্রæতি দিয়েছে, এই এলাকায় আর নোনা পানির চিংড়ি চাষ হবে না।

কতো কিছুই পাল্টে গেছে, এই সময়ে। এখানকার বসতির শুরুতে এলাবাসীর সাথে নোনা জলের যুদ্ধ ছিল। নোনা জল রুখে তারা ফসল ফলাতো। সরকারের চেষ্টায় নোনা জল আটকে দিলো। এলাকায় গড়ে উঠলো মিষ্টি জলের পরিবেশ, আবার চিংড়ি চাষের ফলে চারিদিকে শুধু নোনা আর নোনা। এতে মাছ গেলো, ধান গেলো, খাওয়ার জল গেলো, মানুষের মধ্যে সম্প্রীতিও গেলো। কৃষক জেলে হলো। বাঁধের ভাঙ্গনও বাড়ছে। যারা চিংড়ি চাষ করে আয় করলো; তারা কেউই বাঁধ সুরক্ষায় একটি টাকাও খাটালো না। সরকারও তাদের কিছু বললো না। বাঁধের বাইরে, নদীর পাড়ে অনেক খালি জায়গা ছিল, এখন ভাঙতে ভাঙতে সেই জমি নদীতে চলে গিয়েছে। এখন জোয়ারের জল বাঁধের উপর আছড়ে পড়ে; বাঁধ ভাঙ্গে। আর সবাই পাউবোকে গালাগালি করে। তারা দেখেও দেখে না। তাদের হাতে টাকা থাকলে বাঁধের টুকটাক কাজ করে। সরকারের নাকি টাকা নেই বাঁধ বাঁধার, তাই দাতাদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে। তারা দিলে বাঁধ হবে; কিন্তু চিংড়ি চাষীরা, যারা বাঁধের ক্ষতি করলো, তারা পগাড় পার। তবে অনেকের হাতে নগদ টাকা হয়েছে। কিছু মানুষ ধনী হয়েছে। আর অনেক মানুষই এই চিংড়ির সাথে, পোনা ধরা, পোনার ব্যবসা করা, চিংড়ি কেনা-বেচা করার কাজে জড়িয়ে গেছে। (চলবে)

খুলনা গেজেট/ টি আই




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!