খুলনা, বাংলাদেশ | ৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২১ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

রাহুগ্রাস (পর্ব ১১)

গৌরাঙ্গ নন্দী

বছর বছর সাংবাদিকরা আসে। বিশেষ করে এপ্রিল-মে মাসে। ঝড়ের মাস। আইলা আছড়ে পড়ে গ্রাম থেকে শিবুদের উৎখাত করেছিল মে মাসে। সাংবাদিকরা ছবি তোলে। সাক্ষাৎকার নেয়। নানাজনের সাথে কথা বলে। পত্রিকায় খবর বেরোয় জালিয়াখালি পূর্বপাড়াটি বিলীন হয়ে গিয়েছে। চলে গিয়েছে ঢাকির পেটে। এলাকার মানচিত্র পাল্টে গেছে। ওই গ্রামের মানুষেরা এখনও বাঁধের উপর ঝুপড়িতে বসবাস করছে। উপায়হীন মানুষেরা অনেকেই এলাকা ছাড়তে শুরু করেছে। কিন্তু যাদের সেই সুযোগ নেই, তারা এখনও বাঁধের উপর মাটি আঁকড়ে পড়ে আছে। কত কত নেতারা আসেন, তারাও আশ্বাস দেন। কিন্তু বাড়ি ফেরার সুযোগ তৈরি হয় না। শিবুদের জমিটুকু সবই এখনও জোয়ারের পানির তলায়, ভাটার সময় পানি একটুখানি কমে বটে, তাতে ভিটেমাটি দেখা যায়, তবে সম্পূর্ণ ভেসে ওঠে না। ঝড়ের পরে বছরখানেক ঘরগুলোর অস্তিত্ব ছিল, নিত্য নোনা পানিতে আটকে থাকায় একদিন তা ঝুপ করে বসে পড়ে। ভেসে যায় ঘরের নানান উপকরণ। কোনো উপকরণই কাজে লাগানোর মতো ছিল না। নেতারা আসেন, জনপ্রতিনিধিরা আসেন। মানুষের জন্য কেঁদে-কেটে একসার হন, কিন্তু বাঁধ বাঁধা আর হয় না। এদিকে বাঁধের ভাঙ্গন বড়ো হয়। শোনা যায়, ভাঙ্গন বড় না হলে বাজেট বড় হবে না; তাই ভাঙ্গন আটকানোর উদ্যোগ-তৎপরতা নেই।

বাঁধের ভাঙ্গা মেরামতিতে বছর তিনেক লেগে গেল। এখন বাঁধ দেয়া হয়েছে আংটির মত জমি ঘিরে; বলে রিং বাঁধ। রিংয়ের মধ্যে পড়া জমিগুলো এখন কবে নদীর মধ্যে যায়, তাই দেখার। এজন্যে এলাকাবাসী, জমির মালিককে কোন ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি। রিং বাঁধের কারণে যে জমিগুলো বাঁধের বাইরে পড়েছে, সেখানে আর বসবাস করার উপযোগী নেই। মানুষগুলো ধরেই নিয়েছে, এখানে আর বসবাস করতে পারবে না। আর ঢাকি’র ভাঙ্গনে প্রতি বছরই জমি নদী-গর্ভে যাচ্ছে। প্রকাশ রায়ের তিনশ’ বিঘা জমি ছিল, তার পুরো জমিটাই এখন বাঁধের বাইরে। প্রতিদিনই জোয়ার-ভাটায় তাঁর জমিতে জোয়ারের পানি ওঠে। কিভাবে আবার বসতি গড়ে তুলবে, এই ভেবে ভেবে একদিন সেও ভারতে পাড়ি জমায়। এভাবেই চলে গিয়েছে, রিনা রায়, গোবিন্দ রায়, হরিপদ মÐল, মহানন্দ বাইন, সবিতা রায়, উৎসব বাইনদের পরিবার। আরও অনেকই গিয়েছে। এখনও যাচ্ছে। সকলেই গিয়েছে নিজেদের আত্মীয়-স্বজনের উৎস ধরে। আবার যাদের ছোট-খাট চাকুরি ছিল, বা ব্যবসা ছিল, তারা তাই করে টিকে থাকার চেষ্টা করে চলেছে।

ভারতে চলে যাওয়ারা সকলেই যেমন এক জায়গায় যায়নি, তেমনি সকলেই থিতু হতে পারেনি। শিবুকেও কেউ কেউ বলেছে, ’তোদের জমি-জায়গাতো আর ফিরে পাবি বলে মনে হয় না, ওর চেয়ে চল, ভারতে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করি।’ অনিতাও এতে রাজি ছিল। কিন্তু শিবু ঝুঁকি নিতে পারেনি। অচেনা, বিদেশ-বিভুইয়ে গিয়ে কি করবে, কিভাবে খাবার জোগাড় করবে; স্বামী-স্ত্রী ছাড়াও দুটো মেয়ে – চারটি মানুষের খাওয়ার জোগাড় কি চাট্টিখানি কথা। প্রকৃতপক্ষে, শিবুর চরিত্রের এই এক অদ্ভ‚ত দিক, সে ঝুঁকি নিতে পারে না। ভয় পায়। আগু-পিছু ভাবে। ভাবনা-চিন্তা করে কাজ করা ভালো, তাই বলে ঝুঁকিও নিতে হয়; না, শিবু কোন ঝুঁকি নিতে চায় না। ঝুঁকিতে যদি সে উতরে যেতে না পারে, তাহলেতো একেবারে বিপদে পড়বে।

দেশটাকে শিবু বড্ড ভালোবাসে। আসলেই কি ভালোবাসে। এখানেতো জীবন-জীবিকার সঙ্কট। কিভাবে প্রতিটি দিন কাটবে, তাই সে কোনভাবে ভেবে উঠতে পারে না। তাহলে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জামানো কি ভালো না। না, শিবুর কেমন যেন গোলমাল হয়ে যায়। এই জায়গায় তবুওতো পরিচিত লোক আছে। পরিচিতদের সহায়তা পাওয়া যেতে পারে। সম্পূর্ণ অপরিচিতরা কে, কিভাবে তাকে সহযোগিতা করবে। অনিতা শিবু’র এই পিছুটান, দোদুল্যমনতা একদম পছন্দ করে না। মাঝে মাঝে সে রুষ্টভাবে বলেও, ’সবাই যেন সবকিছু ওনার মুখে তুলে দেবে। কে আছে, এই বাজারে কেউ কাউকে সহায়তা করার। কোন কাজ-কাম করার মুরোদ নেই; রিলিফের চাল-ডালের প্রতি নজর; ওই হলি কি সংসার চলে। ইন্ডিয়ায় চইলে গিলি কি হয়; এহেনেও জন দিয়ে খাওয়া, সেইহেনেও জন দিয়ে খাওয়া। ওইহেনে আরও মাইয়েরা কতো কাজ করে। এইহেনেতো মাইয়ে মানুষ কাজ করলি ইজ্জত যায়। সমীরণ দাদা কতোবার কইরে কলো, তবুও মানুষটার হুশ হলো না।’

আসলে ভারতে যাওয়া-আসার পথটাও সুবিধার নয়। সকলে বেআইনীভাবে যাওয়া-আসা করে। যাদের কিছু সহায়-সম্পদ আছে, তারাই কিছু সুবিধা করতে পারে। একেবারে কপর্দকহীন অবস্থায় নতুন একটি জায়গায় গিয়ে খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। তার উপর পথে পথে নানা বে-আইনী ঝক্কি। ভারতে সকলেই পাড়ি জমায় বেআইনী পথে। শিবুও একবার গিয়েছিল। আজও সেদিনের কথা মনে উঠলে তার গোটা শরীর ছম ছম করে ওঠে। ভয়ে কুঁকড়ে যায়।

দিনটি কি বার ছিল, তা শিবুর মনে নেই। তবে দিনটির অভিজ্ঞতাটা তার ভালোভাবেই মনে আছে। সেদিন সকাল সকাল তারা চারজন যাত্রা শুরু করেছিল। সঙ্গে ছিল পথ চিনিয়ে নেওয়ার জন্য এক ব্যক্তি। যাকে সকলে দালাল বলে। প্রকৃতপক্ষে, ওই লোকটি বে-আইনী পথে ভারতে যাওয়ার পথটি দেখিয়ে নেয় এবং ওই কারণে পথে থাকা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উৎকোচ দিয়ে যাওয়ার পথটি নির্বিঘ্ন করে। উৎকোচ দিলেও সোজাসুজি, সহজ পথে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। যেতে হয় চুপিসারে, আড়ালে-আবডালে।
শিবুরা প্রথমে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে গিয়ে পৌঁছায়। সেখান হতে রিক্সা-ভানে চেপে একটি গ্রামে যায়। তাদের সকলকে শিখিয়ে দেয়া হয়, তাদেরকে কেউ কিছু জানতে চাইলে, বলবে ওই গ্রামের অমুক বাড়িতে তারা যাচ্ছে। তারা তাদের আত্মীয় হয়। শিবু সঙ্গী হরষিতকে জিজ্ঞেস করে, ’দাদা, আমরাতো তাকে টাকা দিচ্ছি; তারপরও আমাদের মিথ্যে কথা কেন বলতি হবে?’

হরষিত বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠে জবাব দেয়, ’তা না হলি কি আমরা পুলিশের কাছে ধরা পড়বো?’ পাশাপাশি অমরেশকে উদ্দেশ্য করে বলে, ’দেখ, অমরেশ, আমি কইয়েলাম না, এই শিবেটা ঝামেলা করতি পারে! এহোন কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। ওর সতীপনার কারণে আমরা সক্কলে না বিপদে পড়ি!’

অমরেশ বলতে শুরু করে, ‘দেখ শিবু, যাচ্ছিতো চোরাই পথে। সেই পথে চিনিয়ে দেওয়ার জন্যে একজন মানুষ সহযোগিতা করছে। তার জন্যে আমরা তাকে টাকাও দিচ্ছি। যে টাকার ভাগ এখানকার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সকল স্তরের ক্ষমতাবান মানুষের কাছে যাবে। এটাই এখানকার এই চোরাই পথের অলিখিত নিয়ম। যখন দুই দেশের এই অবৈধ যাতায়াতের ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি হয়, তখনও যাতায়াত সামান্য চলে, এজন্যে পয়সা আরও বেশী দিতে হয়। আগের চেয়ে বর্ডারে এখন অনেক কড়াকড়ি। মালামাল আগের মতো এপার-ওপার হয় না। দু’-একজন মানুষ এখনও পারাপার হয়, তাও অনেক কষ্টে। তোর হয়তো খারাপ লাগছে। কিন্তু কি আর করাা! আমরাতো এভাবেই যাচ্ছি, যে কারণে ঝুঁকি নিতে হয়েছে। অন্তত: এই রাস্তাটুকু যাওয়ার জন্যে তার কথাই শিরোধার্য করে এগুতে হবে। এখন সে যা বলবে, তাই আমাদের শুনতে হবে। তা না হলে আমরা যদি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সদস্যদের হাতে ধরা পড়ি, তাহলে আমরাতো জেলের মধ্যি পইচে মরবো। আমাদের ছাড়াবে খিডা। আমাদেরতো ছাড়ানোর মতো মানুষ নেই, টাকা-পয়সাও নেই।’

শিবু অমরেশের কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিল। আর রিক্সা-ভ্যানে চেপে চুপচাপ চলতে থাকে। এক সময় তারা একটি বাড়িতে গিয়ে ওঠে। ওই বাড়িতে ঘন্টা দুয়েকের মতো তারা সময় কাটায়। এরই মধ্যে কিছু শুকণো খাবার খায় সকলে। কেউ কেউ শুয়ে-বসে বিশ্রামও নেয়। গ্রামটি বেশ চমৎকার। ছায়াঘেরা। অনেক গাছপালা। শিবুর বেশ ভালো লাগে। গাছপালার ফাঁক দিয়ে এক চিলতে সূর্যের আলো তীরের মতো এসে পড়েছে বারান্দায়। আলো-আঁধারির ফাঁকে দেখা মেলে দূরে সবুজ ধান ক্ষেত। তাদের ওখানেও আগে এমন ধানের ক্ষেত দেখা যেতো। এখন আর দেখা মেলে না। এখন নোনা পানির চিংড়ি, ঝড়-ঝঞ্জার মুখে নদী-ভাঙ্গনে বিপর্যন্ত জনপদ। আবারও ধান লাগানোর চেষ্টা। কেউ কেউ আবারও নোনা পানিতে চিংড়ি চাষ করতে মরিয়া। তাদের বক্তব্য, কিছুই যখন হচ্ছে না, তখন চিংড়ি চাষ করি; তাতেও দুটো পয়সা আসবে। আহা! এই জায়গাটি কতো সুন্দর! এখানে নোনা পানি নেই, চিংড়ি নেই। আচ্ছা, ইছামতির পানি কি নোনা নয়? এরা কি চিংড়ি চাষ করে না? না-কি অন্য কোন ঝামেলা আছে।

শিবু’র ভাবনায় চিড় ধরে। ওই লোকটি, তাদের সহায়তাকারী; চালক, বা দালাল, কোথা থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। সকলকে তাড়া দিয়ে বলে, ’এখুনি উঠতে হবে। না হলি বিপদ!’ কি বিপদ, কেন বিপদ’ তা কেউ প্রশ্ন তোলে না। সকলেই উঠে পড়ে। সূর্য তখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে। সন্ধ্যা হতে এখনও বাকি। শিবুরা সকলে ওই মানুষটাকে অসুসরণ করে চুপচাপ এগিয়ে চলেছে। বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে গিয়ে একটি ছোট দোচলা ঘরের বারান্দায় নিয়ে তাদের বাসানো হয়। বলা হয়, ’এখানে বসো। অপেক্ষা করতে থাকো। ঘাট-এর অবস্থা বুঝে তোমাদের ডেকে নেওয়া হবে।’ ঘাট মানে ইছামতী নদীর ঘাট। তবে এই ঘাটে স্বাভাবিকভাবে কোন মানুষ এপার-ওপার করে না। অস্বাভাবিকভাবেই এই ঘাট ব্যবহৃত হয়।

শিবুরা যে বারান্দাটিতে বসেছিল, সেখান থেকে দূরে নদী-তীরের বাঁধ দেখা যাচ্ছিল। ওই বাঁধ ইছামতির পারের। ওই বাঁধের উপর সাধারণভাবে কোন মানুষ চলাচল করতে পারে না। অস্ত্রধারী, নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম পরা মানুষগুলো বাঁধের উপর হাঁটা-চলা করছে। বুঝা যায়, তারা পাহারা দিচ্ছে। কখনও কখনও দুই পাহারদার সদস্য কথা বলছে। ধীরে ধীরে চারিদিকে আঁধার নামে। শিবু’র ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে থাকে। আর কতক্ষণ! আরও কতো সময় অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু কি আর করা! কোন প্রশ্ন করা যাবে না। হরষিৎ, অমরেশ খুবই বিরক্ত তার উপর। তারা কোন কিছু নিয়ে প্রশ্ন করছে না। তারা কি বিরক্ত হচ্ছে, না-কি এই লুকোচুরি তার ভালো লাগছে। অমরেশ দাকে শিবু প্রশ্ন করতে চায়। কিন্তু ফিসফিস আওয়াজ শুনে থেমে যায়।

আঁধারের মাঝেই বেশ কতকগুলো পায়ের শব্দ শোণে। কেউ একজন খুবই নীচু গলায় বলছে, ’এই হেনে চুপচাপ বইসে থাহো। সময় হলি ডাকপো।’ কেউ একজন কোন একটি কথা বলতে চায়। অমনি সেই লোকটি বলে ওঠে, ’চুপ, কোন কথা নয়। শব্দ করা যাবে না।’

ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। এই ডাকটি আর ঢাকির তীরে শোনা যায় না। কোথা থেকে যেন শিয়ালের ডাক শোনা গেল। শিয়ালের ডাকতো তারা শুনতেই পায় না। এমনিতে শিবু তার ছোটবেলায় কচিত, দু’-একবার শিয়ালের ডাক শুনেছে। আর এখনতো সবই নোনা পানির পেটে। নোনার দাপটে ঝোঁপ-ঝাড় গেছে, শিয়ালের বংশও গেছে। কে যেন নিজের শরীরেই থাপ্পড় দেয়। সামান্য শব্দ। তাতেই আরও কয়েকজন ফিসফিস করে বলে ওঠে, ’কি সর্বনাশ। আমরা শব্দ করে কেন আমাদের বিপদ বাড়াচ্ছি।’ শিবুর মনে হয়, আমরা এই মানুষগুলো এখন নিজেরাই আইন ভাঙার জন্যে মরিয়া। আবার সমূহ বিপদ হতে রক্ষা পেতে নিজেদের লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে চলেছি।

কেউ একজন এসে বলে, ’এবারে উঠতে হবে। এক একজন করে সারিবদ্ধভাবে যাবে। কেউ লাইনচ্যুত হবে না। আস্তে আস্তে গিয়ে ওই দূরের বাঁধটি পাড়ি দিয়ে ঢাল বেয়ে নীচে নামতে হবে। নদীতে নৌকা আছে; ওই নৌকায় উঠতে হবে। কেউ দলছুট হলে বিপদে পড়বে। তখন কিন্তু কেউ বাঁচাতে পারবে না।’ শিবু’র গলা-বুক শুকিয়ে যায়। হাত-পা কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে যায়। কিভাবে, এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে এই রাস্তাটুকু পার হবে। অন্ধকারেও না-কি দেখা যায়। কিন্তু কিভাবে, তা শিবু ভালো বোঝে না। শিবুতো ছোটবেলায় রাতের বেলায় কিছুই চোখে দেখতে পারতো না। রাতের বেলায় সেই শিশু বয়সে একদিন বাড়ির বাইরে গিয়ে আর নিজে বাড়ি ফিরতে পারেনি। এক ঝোঁপের উপর পড়ে গিয়েছিল। সেখানে পড়ে গিয়ে সে খুব কেঁদেছিল। একদম ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে কতোক্ষণ সে পড়েছিল, তা সে মনে করতে পারে না। পরে একজন পথচারী কান্নার আওয়াজ শুনে তাকে উদ্ধার করে দেখে – শিবু। তারপর তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল।

আজ আবার সেই অন্ধকার যাত্রা। সে-কি আবারও কোন জায়গায় আটকে যাবে; না-কি নদীতে পড়ে যাবে। এতা কিছু ভেবে আর কি হবে! এখান থেকেতো ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। সকলের দেখাদেখি সেও পা মেলাতে শুরু করে। প্রায় শরীরের সাথে শরীর মিলিয়ে চলার মধ্যে দিয়ে তারা এগিয়ে চলে। বুঝতে পারে, বাঁধের উপর তারা উঠেছে। এবারে ঢাল বেয়ে নামছে। নদীর পানিতে মাঝে মাঝে কেমন যেন অষ্পষ্ট আলো উঁকি দিচ্ছে। পরে সে জেনেছিল, আঁধারে নৌকা চলাচলকারীরা টর্চ লাইটের মাথায় কাপড় দিয়ে আলোর তীব্রতা আটকে তা নদীর পানিতে ফেলে। এভাবেই একে-অপরকে সংকেত দেয়। শিবু তখন নদীর পানিতে পড়েছে। ডান পা-টি এগুতেই শক্ত কাঠের মতো কিছু একটায় সে আঘাত পায়। শরীরটি সামান্য ঝুঁকে হাত দিকে সেই আঘাত পাওয়া জায়গাটি পরখ করতেই টের পায়, সেটি নৌকা। ডান পা-টি উঁচু করে সে নৗকায় উঠে পড়ে। অনেক লোকাই ওঠে। এক একজন যেন শরীরের সাথে শরীর লাগিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। নৌকাটি কি চলতে শুরু করেছে। সে একটু নীচু হয়ে নৌকার গলুই স্পর্শ করার চেষ্টা করে। কি ভয়ানক! গলুই আর নদীর পানির উপরিতল প্রায় সমান সমান। মাত্র দুই আঙুলের মতো গলুই উঁচুতে। তার গোটা শরীরটি কেঁপে ওঠে। কে যেন, অস্পষ্ট ঝঁঝালো কণ্ঠে বলে ওঠে, ’কে নড়াচড়া করতিছে। নৌকাতো ডুবে যাবে। আমাইগে সক্কলকেতো ডুবে মরতি হবে। সোজা হন। চুপ কইরে দাঁড়ায়ে থাকেন।’

শিবু সোজা হয়। চুপচাপ দাঁিড়য়ে থাকে। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কাছের মানুষটিকেও দেখা যাচ্ছে না। শুধুমাত্র নি:স্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। অল্প জায়গায় অনেক মানুষ গাদাগাদি করে আছে বলেই মনে হয়, মানুষের নি:শ^াসের শব্দ অনুভ‚ত হচ্ছে। আর আছে, নদীর জল কেটে যাওয়ার একটি মৃদু শব্দ। রাতের আঁধারে পানির উপর ভেসে যাওয়া একটি ছোট নৌকা, তাতে মানুষের ভীড়। এখন যদি নৌকাটি ডুবে যায়, তাহলে একেবারে অভ্যস্ত – ওই নৌকার মাঝি, তার সহকারী ছাড়া আরও দু’-একজন হয়তো নদীতে হাবুডুবু খেতে খেতে প্রাণে বেঁচে যাবে; আর অধিকাংশরাই মারা যাবে। শিবুতো মরবেই। অবশ্য, সে সাঁতার জানে। কিন্তু সাঁতার জেনে কি হবে! কোথায় ডুবছে, কিভাবে ডুবছে, নদীর তীর হতে কতো গভীরে ডুবছে, এতো কিছুর উপর নির্ভর করছে, তার সাঁতার জানার কৌশলের দক্ষতা।

নৌকাটি কিছু একটায় ধাক্কা খেলো। একজন অনুচ্চ কণ্ঠে বলে উঠলো, আমরা এখন ভারতের পারে। আপনারা সকলে আস্তে আস্তে নামবেন। নৌকা যেন দোল না খায়। আস্তে এক পা পানি-মাটিতে ঠেকিয়ে আর এক পা নামাবেন। তারপর একজন, দু’জন করে খানিকটা সোজা গিয়ে বাঁয়ে গিয়ে ডাইনে হয়ে আবারও বাঁয়ে যাবেন। কিছুদূর হাঁটলে একটি বাড়ি পাবেন। ওই বাড়ির উঠোন দিয়ে হেঁটে অন্যদিকে বেরিয়ে গেলে ইট বিছানো রাস্তা পাবেন; ওই রাস্তা ধরে মিনিট দশেক হাঁটলে পিচ ঢালা রাস্তার মোড়। সেখান থেকেই বাস, অটো করে যে যার জায়গায় চলে যেতে পারবেন। শিবু তার কথা কান খাড়া করে শুনছিল। কিন্তু ডাইনে-বাঁয়ে, আবারও বাঁয়ে-ডাইনে মোড় দেওয়া রাস্তার বর্ণনা সে মনে রাখতে পারলো না। ফলে, উপায় কি! ওই হরষিত দা’র উপর ভর করতে হবে! তার সাথে পা মিলিয়ে যেতে হবে।

শিবু ওইভাবেই ভারত হতে আবারও ঢাকির পাড়ে বাঁধের উপর ঝুপড়িতে ফিরেছিল। যেদিন ফিরলো, অনিতা বেশ চোখ দুটো জ¦লজ¦ল করে জানতে চেয়েছিল, কেমন দেখলে, আমরা কবে যাবো ওইহেনে? কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শিবু যখন বলে, তার এলাকাটি ভালো লাগেনি, সেখানে যাওয়া চলবে না; তখুনি অনিতার মুখটি কালো অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যায়। তারপর অন্তত: তিনদিন অনিতা আর তার সাথে কথা বলেনি। (চলবে)

খুলনা গেজেট/ টি আই




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!