খুলনা, বাংলাদেশ | ৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৪ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ১০ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮৮৬

রাহুগ্রাস (পর্ব ০৪)

গৌরাঙ্গ নন্দী

পাশের বাড়ির প্রভাসের ডাকাডাকিতে শিবু বাড়ি থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরোয়। আগের দিনেই প্রভাস বলেছিল, ‘শিবু, কাল তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাবো।’ শিবুর চেয়ে প্রভাস বয়সে বড়। তবে সম্পর্কটা খুবই ভালো। একসঙ্গে ঘোরাফেরা করে। শিবু’র আর একা একা ভালোও লাগে না। প্রভাসের ডাকে বেরিয়ে সে জানতে চায়, ‘কোথায় যাবো?’

চল, গেলেই জানতে পারবি। বেশী দূরে না। ওই স্কুল বাড়ি।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা স্কুলবাড়িতে পৌঁছে যায়। দেখে সেখানে আরও অনেকেই আছেন। ওরা দু’জনই হয়তো বয়সে ছোট। তাদের চেয়ে বেশী বয়সীরাই সেখানে সমবেত হয়েছে। তারা সকলেই শহরের স্কুল-কলেজে পড়ে। একজন কথা বলছিল : সেনাপ্রধান লে: জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতার দÐমুন্ডের মালিক। সেনাশাসকের বিরুদ্ধে ছাত্ররা অনাস্থা দেখিয়েছে। তারা সামরিক আইনের অবসান চায়। কিন্তু ক্ষমতা হতে সেনাপ্রধান সরতে চান না। তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকবেন। নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্যে রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। তারই অংশ হিসেবে অনেকগুলো রাজনৈতিক দল নিয়ে একটি রাজনৈতিক জোট গড়ে তুলেছেন। নাম জাগদল। জাতীয় গণতান্ত্রিক দল। এই সেনাশাসকের পক্ষে অবসরপ্রাপ্ত অনেক সেনা কর্মকর্তারা যোগ দিয়েছেন। দেশের সম্পদশালী ধনীরাও তার সঙ্গে আছেন। আরও আছে বিদেশী অর্থলগ্নিকারী বহুজাতিক সংস্থাগুলো। ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা পেতে আরও অনেকেই সামরিক শাসকের সমর্থক হচ্ছেন। এই সরকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ নামমাত্র মূল্যে দিয়ে দেয়া হচ্ছে ব্যক্তির কাছে।

এসবই ব্যক্তিখাত বিকশিত করার চেষ্টা। খুলনার আটরা শিল্প এলাকার আফিল জুটমিলটি ফিরে পেয়েছেন দৌলতপুরের ব্যবসায়ী আফিলউদ্দিন। এই মিলটি পাকিস্তানের আমলে, আইযুবী উন্নয়ন দশকের কালে পিআইডিসি – পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের সহায়তায় এ দেশীয় ধনী দৌলতপুরের পাট ব্যবসায়ী আফিলউদ্দিন গড়ে তুলেছিলেন। দেশ স্বাধীন হলে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রের মালিকানায় নেয়া হলে এই মিলটিও জাতীয়করণ করা হয়। সেই মিলই আগের মালিককে ফেরত দেয়া হচ্ছে। অবশ্য, মিলের যে দাম হয়, তার মাত্র পাঁচ শতাংশ টাকা দিতে হয়েছে। দামও নির্ধারিত হয়েছে সামান্য। প্রতি বছরে মেশিনপত্র ও অন্যান্য স্থাপনার ব্যবহার-ক্ষমতা কমে যাওয়ার হিসেবে সম-পরিমাণ অর্থ বাদ দিয়ে দাম ঠিক হয়েছে। তাতে একশ’ কোটি টাকার সম্পত্তির দাম পড়েছে মাত্র পাঁচ কোটি টাকা। মিল মালিক সেই টাকাও কয়েক কিস্তিতে পরিশোধ করার সুযোগ পেয়েছেন। প্রথম দফা টাকা দিয়ে মিল বুঝে নিয়েছে মালিক। সেখান থেকে নগদ টাকা বের করার জন্যে মিল এলাকার কয়েক শ’ গাছ ও অন্যান্য স্থাপনা বিক্রি করে দিয়েছেন। আবার মিলটি ব্যাঙ্কের কাছে বন্ধক রেখে শতকোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। ব্যাঙ্কের টাকা মানে জনগণের টাকা নিয়ে ব্যক্তি মালিকের সম্পদ ফুলে-ফেঁপে উঠছে।

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রায়শ:ই রাজধানী ও বড় শহরগুলোতে মিছিল করছে। অবশ্য, রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ। উনিশশ’ পঁচাত্তর সালের পনেরো আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যা করার পর থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ঝিমুনিভাব। জিয়াউর রহমানের ক্ষমতাকালে আওয়ামী লীগ বিরোধীরা বিশেষত: মুক্তিযুদ্ধকালে বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর একাংশকে তার পিছনে জড়ো করেছিল। দালাল আইন বাতিল হয়। দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্তদের মুক্তি দেয়া হয়। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে আবারও রাজনীতি করার সুযোগ দেয়া হয়। এরশাদ সরকারও তেমনি ধারা অব্যাহত রেখেছে। বেশী বেশী করে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে। আর অর্থনীতিতে ব্যক্তিখাত বিকাশের সুযোগ দিচ্ছে। একদিকে, শহরে শিল্প-কল-কারখানা ব্যক্তির হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে; অন্যদিকে গ্রামে সাধারণ মানুষের জমি দখল করা হচ্ছে। চারিদিকে শুরু হয়েছে বিশৃঙ্খলা। এক ধরণের লুটেরা কাল। শহরের ধনীরা গ্রামে এসে জমি দখল করছে। সুন্দরবন সংলগ্ন মাল , খোলপেটুয়া, কপোতাক্ষ, ভদ্রা, ঢাকী, সালতা, কাজীবাছা, পশুর প্রভৃতি নদীতীরের জনবসতিতে চলেছে শহুরে ধনী ও তাদের লাঠিয়াল বাহিনীর দৌরাত্ম।

ধোপাদি গ্রামের মতোই আশেপাশের নদীতীরের গ্রামগুলোয় চিংড়ি চাষের আশায় মানুষগুলো হায়েনার মতো হামলে পড়ছে। বাঁধ কাটছে। নোনা পানি তুলে দিচ্ছে। যতদূর নোনা পানি যায়, ততদূর এলাকা নিয়ে এক একজন ঘিরে নিয়ে গড়ে তুলছে চিংড়িঘের। এর বিরুদ্ধাচরণ হলেই চোরাগোপ্তা হমলায় মানুষ মরছে। হঠাৎ হঠাৎ করেই এক একজনের লাশ পাওয়া যাচ্ছে। যুবকদের লাশই বেশী। আর সেই হত্যাকাÐকে ঘিরে পুলিশ আসছে। পুলিশ আরও অনেক যুবকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তাদেরকে পুলিশী হেফাজতে নির্যাতন করা হচ্ছে। কেউ কেউ মামলার ফাঁদে পড়ে হাজতবাস করছে মাসের পর মাস। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ওই পরিবারগুলো। এরই মাঝে ধোপাদিতে একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে।

একদিন সকাল বেলায় ভদ্রায় ভাসতে দেখা গেল প্রমিলা দিদির লাশ। প্রমিলা মÐল। জীবন স্যারের মেয়ে। অষ্টাদশী এই তরুণী কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল। ছুটিতে সে বাড়িতে আসে। এলাকায় চিংড়ি চাষের নামে প্রভাবশালীদের দাপট শুরু হওয়ায় সেও উদ্বিগ্ন ছিল। বাবার সাথে সেও নানান সভায় যোগ দিতো। নিজেদের ভ‚মির অধিকার রক্ষা করার জন্যে নিজেদের সংগঠিত হওয়ার বিষয়ে সে গুরুত্ব দিয়ে কথা বলতো। তাঁর তীক্ষè কথাবার্তায় মানুষ উৎসাহিত হতো। সাহস পেতো। সেই প্রমিলা দিদির লাশ। তিনি কিভাবে মারা গেলেন। শোনা গেল, তিনি আত্মঘাতি হয়েছেন। নদীতে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু তিনি সাঁতার জানতেন। বাদা বনের কাছের এই জনপদের মেয়েরা ভালো সাঁতরাতে জানে। তবে তিনি কোন দু:খে আত্মহত্যা করলেন!

প্রথমে ঘটনাটি জানা যায়নি। কিন্তু পরে এক কান, দু’-কান করে ঘটনাটি জানাজানি হয়ে গেল। ঘটনাটি দু’দিন আগের। রাতের বেলায় ঘুমিয়ে পড়েছেন জীবন স্যার। বাড়িতে বড় মেয়ে প্রমীলা এবং ছোট ছেলে অসিত। তারাও ঘুমিয়েছে। বড় ছেলে এবং জীবন স্যারের স্ত্রী বাড়িতে ছিলেন না; তারা কোন এক আত্মীয় বাড়িতে গিয়েছিলেন। রাতের মধ্য-প্রহরে একদল অস্ত্রধারী দরোজায় কড়া নাড়ে।

স্যার বাড়িতে আছেন? একটু উঠুন।

একাধিকবার ডাকতে থাকায় স্যার মনে করেন, গ্রামেরই কেউ হবে হয়তো। প্রমীলা দি-ও বিছানায় উঠে বসে। সেই বাবার সাথে কথা বলে দরোজা খুলে দেয়। দরোজা খোলার সাথে সাথে যমদূতের মতো কয়েকজন ঘরে ঢুকে পড়ে। প্রমীলা কিছু বলার চেষ্টা করে। কিন্তু একজন গামছা দিয়ে তার মুখটি বেঁধে ফেলে পাশের ঘরে নিয়ে যায়। দু’জন জীবন স্যারের কপালে অস্ত্র ঠেকিয়ে তার হাত-পা বেঁধে ফেলে। মুখে কাপড় গুজে দেয়; যাতে শব্দ করতে না পারে। পাশের ঘরে শুয়েছিল ছোট ছেলে অসিত। হুড়োহুড়িতে তারও ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে দেখে দিদিকে একদল লোক জাপটে ধরেছে। তার কি করা উচিত, বুঝতে না পেরে বাবা বাবা বলে চিৎকার করে ওঠে। আক্রমণকারীদের কেউ একজন তার মাথায় কিছু একটা দিয়ে জোরে আঘাত করে। সে মাগো বলে লুটিয়ে পড়ে সেখানেই অচেতন হয়ে পড়ে। সে-ই দুর্বৃত্তদের পাঁচজন একে একে প্রমীলা দি’কে অত্যাচার করে।

আচমকা এই আক্রমণ ও অত্যাচারের ঘটনায় প্রমীলা কষ্ট-যন্ত্রণা-বেদনায় অচেতন হয়ে পড়ে। কতোক্ষণ সে চেতনা হারিয়ে পড়েছিল, তা অনুমান করতে পারে না। তবে হয়তো বেশী সময় না। দুর্বৃত্তদের দলটি যাওয়ার সময়ে বেশ হৈ চৈ করতে করতে যায়। এতে আশেপাশের দু’-একজনের ঘুম ভেঙ্গে গেলেও কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারে না যে, এই বাড়িতে এত্তোবড় একটি ভয়ানক ঘটনা ঘটে গেছে। কেউ একজন স্যারের বাড়ির কাছে এসে স্যার, স্যার বলে দু’-একবার ডাকাডাকি করলেও বাড়ির ভিতরে আসেনি।

প্রমীলার চেতনা ফিরে আসার পর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। কয়েকবারের চেষ্টায় সে উঠে দাঁড়াতে পারে। চোখ যায় ছোট ভাই অসিতের দিকে। তাকে ডাক দেয়। কিন্তু কোন সাড়া পায় না। কাছে গিয়ে তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করে। বাবা, বা-বা বলে কয়েকবার ডাক দেয়। কিন্তু সাড়া পায় না। ধীরে ধীরে ওই ঘর ছেড়ে এ ঘরে এসে দেখে বাবার হাত পিঠমোড়া দিয়ে বাঁধা। পা দুটোও বাঁধা। মুখে কাপড় গোঁজা। মানুষটি খাটের উপর সোজা স্থির হয়ে বসে আছে। চোখ দিয়ে অবিরল ধারায় জল গড়িয়ে পড়ে চলেছে। চোখ দুটিতে যেন রাজ্যের ভয়, অপমান, লজ্জা মিলেমিশে এক ভয়ঙ্কর অবস্থা তৈরি করেছে।

প্রমীলা বাবাকে মুক্ত করে। জীবন স্যার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন, মাগো আমি তোর ব্যর্থ, অকর্মণ্য, অপদার্থ বাবা। আমি তোকে দুর্বৃত্তদের হাত হতে রক্ষা করতে পারিনি মা। তুই আমাকে সাজা দে। আমার সামনে তোর এই অপমান! এ লজ্জা আমি কোথায় রাখবো!

প্রমীলা খুব দৃঢ় কণ্ঠে বলে, বাবা, অসিত অচেতন হয়ে পড়ে আছে। এখন কান্নার সময় না। আমাকে ছাড়ো। তুমি এসো আমার সঙ্গে। প্রমীলা নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে এক গøাস জল নিয়ে অসিতের চোখে-মুখে ছিটিয়ে দিতে থাকে। আর বারে বারে নাম ধরে ডাকতে থাকে। অসিত, অসিতরে, ছোট ভাই আমার। ওঠ। ওঠ। চোখ মেলে তাকা। কয়েকবারের ডাকাডাকিতে বছর দশেকের অসিত চোখ দুটো বড় বড় করে তাকায়। এদিক-ওদিক, চারিদিকে তাকাতে থাকে। ঘুমের ঘোরের মধ্যে আঘাত, অনেকগুলো মানুষের আক্রমণ, ভয়ে-আতঙ্কে চেতনা হারিয়ে মুখটি অসিতের একেবারে পাÐুর হয়ে আছে। ধীরে ধীরে সে স্বাভাবিক হয়। দিদি, দিদিরে বলে অসিত তাকে হাউমাউ করে জড়িয়ে ধরে।

ঘটনার আকস্মিকতায় একেবারে চুপসে যায় জীবন স্যার। প্রমীলাও কেমন যেন চুপচাপ হয়ে যায়। এরই দু’দিন পর সকাল বেলায় নদীতে তার লাশ পাওয়া যায়। সহ্য করতে পারেনি এই অপমান। কাজটি যে চিংড়ি চাষের সমর্থক বাহিনীর, তা আর কারও বুঝতে বাকি থাকে না। জীবন স্যারকে কেউ কেউ থানায় মামলা করার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু নীতিনিষ্ঠ এই মানুষটি কারও কথায় সাড়া দেননি। বলেছেন, যা হবার তাতো হয়েছে। আমার এই অপমান, এই লজ্জা আরও মানুষকে জানিয়ে কি হবে! একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এরমধ্যেই প্রমীলার আত্মহত্যা মানুষটিকে আরও কাবু করে দেয়। একেবারেই কারও সাথে কথা বলতে চান না। বাড়ি থেকে বের হন না একেবারেই। বাড়িতেও মুখ গুজে বসে থাকেন। আহা, প্রাণবন্ত মানুষটি একেবারে মিইয়ে গেছেন।

তপন দা’ এই ঘটনাটিকেই ব্যাখা করছিলেন। বলছিলেন, আজ যে লুটেরার দল আমাদের গ্রামে হাজির হয়েছে, তাদেরকে সহযোগিতা করছে সামরিক সরকার। ক্ষমতায় সামরিক সরকার; রাজনৈতিক কর্মকাÐ বন্ধ; মানুষের কথা বলার অধিকার নেই। এই সুযোগে দেশের উঠতি ধনী শ্রেণী এসব অরাজকতা ঘটিয়ে চলেছে। তারা হামলে পড়েছে সুন্দরবন উপক‚লের গরীব মানুষদের উপর। আবার এই এলাকাটিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাস। দেশের ধনী গোষ্ঠী এখন সম্পদ বাড়াতে চায়। টাকা চাই। অনেক টাকা। এ কারণে তারা রাষ্ট্রীয় শক্তিকে কাজে লাগিয়ে গরীব মানুষদের উপর হামলে পড়েছে।

অবশ্য, পশ্চিম উপক‚লের প্লাবনভ‚মির এই অ লটিও তাদের জন্যে সুবিধার। কারণ, এই জায়গাটি স্বাদু ও নোনা পানির সম্মিলনস্থলে গড়ে উঠেছে। উপকূলীয় জোয়ার-ভাটার প্লাবনভূমি। ঈষৎ নোনা পানির এ অ লের নদীগুলো জোয়ার-ভাটার। দিনের ২৪ ঘন্টায় দুই বার জোয়ার, দুই বার ভাটা হয়। প্রতিটি কম-বেশী ছয় ঘন্টার স্থিতিকাল। জোয়ারে সাগরের নোনা পানি উঠে আসে। সাথে আসে পলি। যে পলি জমে জমে এখানকার ভ‚মি গড়ে উঠেছে। এখানেই বাদাবন। ম্যানগ্রোভ বন, সুন্দরবনের অবস্থান। আমাদের বাড়ির কাছে সুন্দরবন। যা চওড়ায় ৭০ কিলোমিটারের মতো। এরপর সাগর। সুন্দরবনের লাখ লাখ টন লতা-গুল্ম-উদ্ভিদের পাতা এখানকার পানিতে মিশে জলজ প্রাণীর বিশাল খাদ্য-ভান্ডার গড়ে তুলেছে। এ কারণে এখানে মাছও বেশী মেলে। এখানে সহজেই পাওয়া যায় নোনা পানি। আগেতো আমাদের বাপ-ঠাকুরদাদারা এই নোনাপানির সাথেই বসত করতো। বর্ষা আসার আগেই তারা নদীতীরে বাঁধ দিতো। উপকূলীয় বাঁধ হওয়ার আগে জোয়ারের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ জলরাশি এই নদীগুলোর দু’কূল ছাপিয়ে, খাল-নালাগুলো দিয়ে প্লাবনভূমিতে উঠে আসতো। তীব্র স্রোতে জোয়ারের পলি এই প্লাবনভূমিতে জমা করে আবার ভাটায় স্বচ্ছ জল ফিরে যেতো। এতে জোয়ার-ভাটার নদীগুলো নাব্য বজায় থাকতো। আবার এখানকার ভূমি গঠনের কাজও চলতো। আমাদের বাপ-ঠাকুরদাদারা এই প্লাবন-ভূমির চারিদিকে জৈষ্ঠ্য-আষাঢ় মাসে সাময়িক বাঁধ দিয়ে আমন ধান রোপন করতো। উদ্দেশ্য থাকতো আমন ধান রক্ষা করা। পৌষ মাসে আবার ওই বাঁধ ভেঙে দিতো। এরই নাম ছিল অষ্টমাসী বাঁধ। প্লাবনভূমিতে জোয়ারবাহিত পলি জমলে এর উর্বরা শক্তি বাড়তো। ধানের উৎপাদন ভালো হতো।

কিন্তু উনিশশ’ ষাটের দশকে উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্পের আওতায় এ অ লে ৩৯টি পোল্ডার তৈরি করা হয়। বাঁধ, ¯øুইস গেইট মিলে-মিশে যে ব্যবস্থাটি তাকেই পোল্ডার বলে। পোল্ডার শব্দটি ডাচ দেশের। তারাই প্রথম পানির এই পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলে। আর পাকিস্তান আমলে ওয়াপদা -ওয়াটার অ্যান্ড পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট অথরিটি এই পোল্ডার গড়ে তোলে। ওই ওয়াপদার নাম এখন পাউবো -পানি উন্নয়ন বোর্ড। পোল্ডারগুলো এক, দুই, তিন সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করা। যেমন আমাদের পোল্ডারটি ৩২ নং। চালনা ৩১ নং। আর কৈলাশগঞ্জ-দাকোপ-বাজুয়া-লাউডোব-বাণিশান্তা ৩৩নং পোল্ডার। মজার বিষয় হচ্ছে, এই বাঁধ দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, নোনা পানি ও জলোচ্ছ¡াস ঠেকাতে এই বাঁধ দেয়া হচ্ছে। এতে এখানকার ধানের ফলন ভালো হবে। শাক-সবজি হবে। ওই কাজে আমেরিকার উন্নয়ন সংস্থা – ইউএসএইড টাকা দিয়েছিল। আবার এখন বাঁধ কেটে নোনা পানি এনে চিংড়ি চাষের জন্যেও টাকা দিচ্ছে বিশ^ব্যাঙ্ক। আমাদের দেশের সরকারগুলো বিদেশীদের পরামর্শ শুনেই কাজ করে। তারা যেভাবে বলে, সেভাবেই করে। তবে তখন ছিল আইযুব খানের নেতৃত্বে¦ সামরিক সরকার। বিদেশীরা সরকারে ছিল। আর এখন এরশাদের নেতৃত্বে সামরিক সরকার। দেশী সরকার। তখন যা কিছু হতো সবই বিদেশী ধনীদের স্বার্থে; এখন যা কিছু হচ্ছে তা দেশীয় ধনীদের স্বার্থে। বিদেশীদের অত্যাচারে দেশী ধনীরাও বিরক্ত ছিল। কিন্তু এখন দেশী ধনীরা তাদের স্বার্থে গরীব মানুষ, বাদার কুলের মানুষের উপর অত্যাচার-নিপীড়ন করছে।

কে যেন বললো, তা হলে সামরিক সরকারই আমাদের সমস্যার কারণ। তপন দা’ বলেন, হ্যাঁ, আপাত: দৃষ্টিতে তাই মনে হয়। তবে এর পিছনে রয়েছে এ দেশের ধনীগোষ্ঠী। যারা আরও আরও সম্পদের মালিক হতে চায়। তারাই কৌশলে তাদের প্রতিনিধি দিয়ে সরকার গঠন করে। সরকারগুলোর মধ্যে দিয়ে তাদের স্বার্থের অনুক‚লে নিয়ম-নীতি তৈরি করে। তেমন তেমন কার্যক্রম গ্রহণ করে। তবে সামরিক সরকার হলে মানুষতো একেবারে কথা বলতে পারে না। তখন শাসকরা ইচ্ছেমত নীতি-পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। শিবু খুবই মনোযোগ দিয়ে শুনছিল কথাগুলো। কিন্তু অনেক কিছু বুঝতে পারেনি। বেশ শক্ত কথা। তবুও সে সাহসের সাথে প্রশ্ন করে, তাহলে তপন দা’ আমাদের কি কিছুই করার নেই? আমাদের এভাবে অত্যাচারিত হতে হবে? থানা-পুলিশ, আইন-আদালত কেউ আমাদের সহযোগিতা করবে না? আর একটি প্রশ্ন, আমরা গরীব, ক্ষমতাহীন বলেই কি আমাদের উপর বেশী অত্যাচার, আমাদের জমি দখল করা হচ্ছে?

তপন ধীরে ধীরে বলে। দেখ, শিবু তোমার প্রশ্ন দুটো চমৎকার। তোমার শেষ প্রশ্নটি ধরে জবাব দিতে শুরু করি। তারপর অন্যটির জবাব দেবো। বিষয়টি সামাজিক ইতিহাসের। ধনীরা গরীবের উপর, সবলেরা দুর্বলের উপর অত্যাচার করে। এ ঘটনাটিও তাই। দেশে দেশে পুঁজি গড়ে তোলার ইতিহাসও তাই। আমাদের দেশটাকে দুশো বছরের বেশী সময় ধরে ইংরেজরা শাসন-শোষণ করেছে। আমাদের সোনার বাংলা হতে রাশি রাশি সম্পদ লুটেছে তারা। আমাদের দেশ হতে সম্পদ লুটেছে, তাদের দেশে শিল্প বিপ্লব হয়েছে, তারা শত শত শিল্প-কলকারখানা গড়ে তুলেছে; বিপরীতে আমাদের দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছে। হাজারে হাজারে মানুষ না খেয়ে মারা গেছে। সেই লুণ্ঠিত সম্পদ নিয়ে তারা এখন ধনী, উন্নত, মহান দেশ। একইভাবে পশ্চিম পাকিস্তানও পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের কাঁচামাল, ভ‚মি ও শ্রমিক; কিন্তু মালিক পশ্চিম পাকিস্তানীরা, মুনাফা লুটেছেও তারা। এখন বাংলাদেশের মধ্যেই একদল মানুষ ধনী হয়ে উঠছে। তারা আরও ধনী হতে চায়, আরও অনেকে ধনী হতে চায়, তাই দুর্বলের উপর, গরীবের উপর এই নিপীড়ন।

হ্যাঁ, আমরা চুপ করে থাকবো না। আমরা প্রতিবাদ করবো। দেবাশীষের হত্যাকাÐ, জীবন স্যারের বাড়িতে হামলা-নির্যাতনের ঘটনা, প্রমীলার আত্মহনন – এসবকিছুই ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্যে। যাতে আমরা ভয় পাই, মুখ বুঝে থাকি। কোন কথা না বলি। প্রতিবাদ, প্রতিরোধে না যাই। তবে যেহেতু, থানা-পুলিশ-প্রশাসন সকলেই চিংড়ি চাষীদের পক্ষে, তাই আমরা এই মুহূর্তে প্রতিবাদ করেও সুবিধা কিছু করতে পারবো না। তবে আমাদের সংগঠিত হতে হবে। এক ভাবনার ছাতার তলায় আসতে হবে। তবেই না তাদেরকে আমরা প্রতিরোধ করতে পারবো।

শিবু ভেবে পায় না, কি করে প্রতিবাদ হবে? সবলের বিরুদ্ধে দুর্বল কিভাবে লড়াই করবে? চলবে…




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!