দুপুরের বেলা গড়িয়ে যেতে না যেতেই স্কুল ঘরে গ্রামের প্রায় সব পুরুষ সদস্য এবং কিছু নারী সদস্য জড়ো হন। শিবুও ছুটতে ছুটতে গিয়ে সেখানে হাজির হয়। চুপটি করে পিছনের এক জায়গায় গিয়ে বসে পড়ে। কে যেন বলে ওঠে, ‘এই তুই এইহেনে ক্যান?’ কোন জবাব না দিয়ে সে একদিকে গুটিশুটি মেরে বসে থাকে। ততোক্ষণে পুরো জোয়ারের নোনা পানি ধোপাদির প্রায় পুরো বিলটি গিলে খেয়েছে। কোথাও কোথাও হাঁটু পানি জমেছে। কোথাও বা তার একটু কম। স্বাভাবিকভাবে বিলের নীচু অংশে বেশী পানি, উঁচু অংশে কম। বিলটাতো অনেক বড়। এই বিলটা জুড়েই কি চিংড়ির ঘের হবে? কেউ একজন প্রশ্ন করে। যে যার মতো করে জবাব দেয়। একজন বলে, হয়তোবা। আর একজন বলে, হতি পারে; তা না হলি অতো পানি তোলবে ক্যান! কোন উত্তরই যথাযথ নয়। বুঝাই যায়, যে যার মতো করে কথা বলে চলেছে। আসলে কারও কাছেইতো প্রকৃত কোন তথ্য নেই। কিভাবে বলবে! সকলের মধ্যেই এক ধরণের উত্তেজনা। দুই-চার বিঘে জমির মালিকরাই বেশী হাহাকার করছে। তাদের সমস্যাটাই বেশী। ভাগ-চাষী হয়েই তাদের জীবনটা কাটছে। এখন সেই জমি যদি চলে যায়; তা হলে উপায় কি!
কিছুু পরে গ্রামের মানী লোক জীবন স্যার, জীবনানন্দ মন্ডল, হরষিত মন্ডল, ওই পাড়ার কুতুবউদ্দিন সাহেব, হারাধন ঘরামিসহ অনেকেই হাজির হলেন। একে একে কথা শুরু হল। সকলেরই এক কথা। একি জুলুম শুরু হ’ল? বলা নেই, কওয়া নেই, বাঁধ কাইটে বিলি পানি তুইলে দিলো। এর প্রতিকার চাই। কিভাবে এর প্রতিকার হবে, তাই গ্রামের মাতব্বরদের কাছে সকলের চাওয়া।
হরষিত মন্ডল কথা বলছেন। তিনি বলেন, এভাবে যে বাঁধ কাটতি পারে, তার কিন্তু খুঁটির জোর আছে। তা না হলি, একটা এলাকায় আইসে বাঁধ কাইটে নদীর নোনা পানি তুলে দেবে কেন? এখন তার শক্তির উৎস কোথায়, তা আমরা জানি না। আমরা আচমকাই যদি এর প্রতিবাদ করতে যাই, তাহলে হিতে বিপরীত হতি পারে। আমাদের বুঝে-শুনে এগুতে হবে। আমাদের জানতি হবে, ওই লোকটি কে? কি তার পরিচয়? লোকটা চিংড়ি চাষ করতি এলো কিভাবে? কার জমি সে বরাদ্দ নিয়েছে? নিলে কিভাবে নিয়েছে? যে দিয়েছে, সে-ই-বা কিভাবে দিলো? এসব আমাদের সবকিছু খুঁটিনাটি ভালোভাবে জাইনে, তবে এগুতে হবে। এটাতো সকলেই দেখতে এবং বুঝতে পারছেন, সাথে বন্দুক, পাইক-পেয়াদা নিয়ে যে আইসে উঠিছে; সে কিন্তু তার ক্ষমতা খাটানোর জন্যেই আইছে। ফলে আমাদেরও দেখে-শুনে পা ফেলতি হবে। তার আগে আমাদের এই তথ্যগুলো জানা চাই।
জীবন স্যারও তার কথায় ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানান। তার মুখটা খুব গম্ভীর। তিনি সকল কথাই শুনছেন, কিন্তু মাঝে মাঝে যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছেন। অথবা উদাস হচ্ছেন। হরষিত বাবুর কথার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, হ্যাঁ, যা করতে হবে, বুঝে-শুনে করতে হবে।
পিছন দিকে যেখানে অপেক্ষাকৃত তরুণেরা বসেছিল, সেখান থেকেই একাধিকজন বলে উঠলো, আমর ওদের বাধা দেবো। ওদের এই কর্মকা- করতে দেবো না। ওরা একবার শুরু করেছে, বাধা না পেলে কিন্তু ওরা এটা করতেই থাকবে। থামবে না।
জীবন স্যার, ধীরে-সুস্থে বলেন, বাবারা তোমাদের মনের অবস্থা বুঝি। আমারও যে ভালো লাগছে, তা নয়। কিন্তু কিভাবে এর প্রতিবাদ করা যাবে, তাই নিয়েই ভাবনা। প্রতিবাদ করে আদৌ কোন ফল হবে – কি-না, তাতো বুঝে উঠতে পারছি না। কারণ, আমি জানি, পাইকগাছায় অনেক আগে থেকে চিংড়ি চাষ শুরু হয়েছে। তা নিয়ে দ্বন্দ্ব-বিরোধ মারামারিও হয়েছে। এতোদিন আমাদের এখানে এই আপদ ছিল না। এখন এলো। এখন এর মোকাবেলা ঠা-া মাথায় করতে হবে। হরষিত দাদা যা বলেছে, আমি তার সাথে পুরোপুরি একমত। তবে এর সাথে একটা কথা যোগ করি, তা হচ্ছে, আমরা বর্গাদাররা এখুনি যেন আমাদের জমির মালিকদের সাথে যোগাযোগ করি। জমির মালিকরা কি ওই চিংড়ি চাষীকে জমি দিয়েছে, না দেয়নি; তা আমাদের জানতে হবে। দিলে কিভাবে, কোন শর্তে দিয়েছে, সেটাও জানা দরকার। জামির মালিকরা জমি দিলে আমরাতো কিছু বলতে পারেবো না। তখন আমাদের জমি রক্ষার জন্যে আমাদের কথা বলতে হবে। সেই কৌশল ঠিক করতে হবে।
সুন্দরবন হাসিল করে এখানে ভূমি উদ্ধার ও জনবসতি গড়ে ওঠে। ভূমি উদ্ধারের সাথে যারা জড়িত ছিল, তারা কিছু জমির অধিকার পেয়েছিল, ভোগ-দখল, চাষাবাদের অধিকার, ফসল ফলানোর অধিকার। তখন জমির মালিকানা সংক্রান্ত কাগজপত্রের কোন বালাই ছিল না; এমনকি রায়ত কৃষকদের হাতে জমির মালিকানা স্বত্ত্বও ছিল না। আর যখন রায়ত কৃষকরা জমির মালিকানা পেলো, তখন দেখা গেলো জমিদারি-গাতিদারি সূত্রে অধিকাংশ জমির মালিক হয়েছে শহুরে বাসিন্দারা। সুন্দরবনের কুলে নোনা জল খেয়ে যারা ফসল ফলায়, তারা হলো ভাগচাষী। বর্গাদার। শহুরে বাবুদের জমি চাষ করে। অবশ্য, ফসল বলতে ওই একটাই, আমন ধান। আগেতো ফসল ফলানোর জন্যে নিজেদের বাঁধ দিতে হতো। ১৯৬০ এর দশকে সরকার বাঁধ দিলে সেই দায়ও চলে গেল। মানুষগুলো আষাঢ়ের বর্ষায় একবার আমন ধানের চাষ করে। ফসল উঠলে মালিকের ঘরে আধাআধি ভাগ করে তুলে দিয়ে আসে। আর বাকি অর্ধেক ফসলে নিজেদের সারাবছরের খাওয়া ও অন্যান্য খরচ মেটে। সেই ভাগচাষীরা এখন চোখে সর্ষে ফুল দেখতে শুরু করে। জমির মালিক যদি বেশী টাকার আশায় চিংড়ি চাষের জন্যে জমি দিয়ে দেয়, তবে তাদের কি হবে!
তিন দিন পর একই জায়গায় আবারও সকলে জড়ো হয়। যাদের কাছে যেসব তথ্য ছিল, সেসব সকলে একে একে বলে। দেখা গেল, খুলনা শহরের বাসিন্দা হোমিও ডাক্তার লুৎফর রহমানের ৯০ বিঘা জমি ওই চিংড়ি চাষী তার কাছ থেকে বন্দোবস্ত নিয়েছে। পাঁচ বছর ওই জমি চিংড়ি চাষী ব্যবহার করবে; এজন্যে প্রতি বছর বিঘে প্রতি তাকে তিন হাজার করে টাকা দেবে। তবে আমন ধান চাষের আগে জমি ছেড়ে দেবে। ধান হবে। ধান করবে আগের মতো তার বর্গাদার। আবার ধান উঠে গেলে তারা নোনা পানি তুলে চিংড়ি চাষ করবে।
লুৎফর রহমানের বর্গাদার অনুপম ম-ল যখন এসব কথা বলছিল, তখন অন্যেরা তা হা করে শুনছিল। কেউ কেউ দীর্ঘ-নি:শ^াস ছাড়েন। কেউ কেউ আ, হু শব্দ করেন। সকলেই মোটামুটি হতচকিত। বিহ্বল। অনুপম ম-ল বলেন, আমি ডাক্তার বাবুরে কইছিলাম। যদি তারা জমি না ছাড়ে, আর একবার নোনা পানি তুলে চিংড়ি চাষ করলি, ওই জমিতি কি পরের বার ভালো ধান হবে!
কিন্তু তিনি তাতে কোন গা করলেন না। বললেন, একসাথে অনেকগুলো নগদ টাকা পেলাম, আমার কাজে লাগবে। আর লুৎফর মানুষ ভালো। আমার চেনা-জানা। ওতো বললো, বৃষ্টি হলে নোনা চইলে যায়। আমন ফসলের কোন ক্ষতি হবে না। অনুপম, তোমার কোন অসুবিধে হবে না। তুমি ঠিকঠাক, ধানের চাষ করতে পারবে। আমি আর কি কবো। জমি তার। সিদ্ধান্ত তার। সে যদি লাভ দেইখে তার জমি কারুরে দেয়, তালি আমি কি করতি পারি। আমারতো কিছু বলার থাহে না।
এরকম আরও তিন জনের জমি নিয়ে ওই চিংড়ি চাষী নোনা পানি তুলেছে। সব মিলে তার জমির পরিমাণ দাঁড়ায় দুশো বিঘার মতো। তাও জমিগুলো এক জায়গায় নয়। তিন জনের জমি বিলির তিন জায়গায়। কিন্তু সে প্রায় হাজারখানেক বিঘে জমিতে নোনা পানি তুলেছে। মাতব্বরদের কেউ কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে চিংড়ি চাষী জানিয়েছে, আপানারাও আমাকে জমি দিয়ে দেন, আমি সকলকে প্রতি বছর হিসেবে প্রতি বিঘা জমির হারি (ভাড়া) দেবো। কিন্তু সকলে একমত হতে পারেনি। এখানে বসেও সকলে একমত হতে পারে না। কিভাবে হবে। নতুন একটি পদক্ষেপ। চাষের ধরণ ভিন্ন। উদ্যোক্তা নতুন। জমি একবার তাদের দখলে গেলে তারা যদি দখল না ছাড়ে। আবার নোনা পানিতো এখন সকল জমিতে। জমি যদি তাদের না দেওয়া হয়, তাহলে টাকা পাবে না। তাই বলে চিংড়ি চাষতো বন্ধ হবে না। নোনা পানিতো বিল-জুড়ে।
জীবন স্যার বলেন, আমরা সত্যি একটা বিপদের মধ্যে পড়েছি। না পারছি সহ্য করতে, না পারছি কোন প্রতিকার করতে। আমি যতটুকু খোঁজ-খবর নিয়েছি, তাতে জানতে পারলাম, সরকার এই চাষে উৎসাহ দিচ্ছে। জানো-ত, এখন সামরিক শাসক ক্ষমতায়। লে. জেনারেল হুসেইন মোহম্মদ এরশাদ হচ্ছেন দেশের প্রেসিডেন্ট। তাকে পরামর্শ দিচ্ছে বিশে^র বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আইএমএফ মানে ইন্টান্যাশনাল মানিটরি ফান্ড, যাকে বাংলায় বলে আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিল, এডিবি অর্থাৎ এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক বা এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক, বিশ^ব্যাঙ্ক প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের বড় কর্তারা; অর্থনীতিবিদদের অনেকেও সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছে। তাদের কথা বেসরকারি খাতে পুঁজি বিনিয়োগ করা হোক। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর সরকার কল-কারখানাগুলো সরকারি করেছিল, তাই এখন ব্যক্তি মালিকদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। খুলনার আটরা এলাকার আফিল জুট মিল ছিল দৌলতপুরের আফিল উদ্দীন সাহেবের। তার কাছে আবার ওই মিল ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।
জীবন স্যার বলে চলেন, আমাদের প্রয়োজনে অনেক পণ্য বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়; আবার বিদেশীদের কাছ থেকে অনেক টাকা ধার নিতে হয়। পণ্য কেনার টাকা, ধার শোধ করা প্রভৃতির জন্যে টাকা লাগে। এই ধার শোধ করা আমাদের দেশের টাকায় হয় না। প্রয়োজন হয় বিদেশী মূদ্রা, আমেরিকান ডলার। এখন আমরা ডলার কিভাবে পাই; এক বিদেশী সাহায্য; আর দুই, আমাদের পণ্য বাইরের দেশে বিক্রি করে। আমাদের দেশের পণ্যতো কম। তাই তারা পরামর্শ দিয়েছে, তোমাদের রপ্তানিযোগ্য পণ্য বাড়াও। পাকিস্তান আমল থেকে আমাদের রপ্তানি পণ্য ছিল পাট ও পাটজাত পণ্য। এখন তাতে ভাটা পড়েছে। চিংড়ির চাহিদা আছে বিদেশে। বিদেশীরা এই কাঁটাবিহীন মাছটা ভালো খায়। দামও ভালো। এ কারণে সরকারকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে, চিংড়ির উৎপাদন বাড়াতে। বিশ^ব্যাঙ্ক সরকারকে চিংড়িসহ মাছের উৎপাদন বাড়াতে একটা প্রকল্পের মাধ্যমে অনেক টাকা ঋণ দিয়েছে। আর সরকারের দল – জাতীয় পার্টির লোকজন, তাদের আস্থাভাজন লোকজন চিংড়ি চাষে নেমে পড়েছে। আগে সাতক্ষীরায় এর চাষ শুরু হয়। পাইকগাছায়ও অনেকদিন ধরে চাষ হচ্ছে। এখন আমাদের এখানে চাষের জন্যে এলো।
সকলেই স্যারের কথা শুনছিল। কারুরই যেন মুখে কোন কথা নেই। হারাধন ঘরামি বলে ওঠেন, ভালো কথা। চিংড়ি চাষ করুক। চিংড়ি বিদেশে যাক। ডলার আসুক। তাই বলে আমাদের ক্ষতি করে।
জীবন স্যার বলেন, দেখো। জলতো নীচের দিকেই গড়ায়। ক্ষতিতো যা হয়, তা ওই গরীবের। দুর্বলের হয়। যদিও বেশীরভাগ জমির মালিক শহরের মানুষেরা। আমরা এখানে অনেকে বসবাস করলেও আমাদের জমির মালিকানা কম। আমাদের উপর দমন-পীড়ন হলেও দেখার মানুষ কম। ফলে ক্ষমতাবানেরা ক্ষমতা খাটাচ্ছে।
বাধা দিয়ে হারাধন বলে ওঠেন, তাহলে কি আমরা সবকিছু মুখ বুজে মাইনে নেবো?
না, আমি তা বলছি না। জীবন স্যার তার কথার জবাবে বলতে থাকেন, এখানে মুখ বুজে মেনে নেয়ার কথা উঠছে না। আমি পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করলাম, এ কারণে যে, যাতে সকলের বুঝতে সুবিধা হয়। বুঝে-শুনেই আমাদের পা ফেলতে হবে। কারণ, কে যে আমাদের পক্ষে থাকবে, আমরা কার যে সহযোগিতা পাবো, তা বলা মুশকিল।
কে যেন বললো, যারা বাঁধ কেটে দিয়েছে, তারা না-কি বলাবলি করছিল, খুলনার জাতীয় পার্টির নেতা হাসান সাহেবও না-কি এখানে চিংড়ি চাষ করতে আসবে?
জীবন স্যার বলেন, আসতে পারে। চিংড়ি চাষীরা দল ভারী করতে চাইবে। একজন, দুইজন করে তারা অনেকেই আসতে পারে। এদের সঙ্গে স্থানীয় চালনার আনিসও আছে বলে আমি শুনেছি। তবে কারা কারা আছে, তা এখনও জানতে পারিনি।
আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হয়, জীবন স্যার সহ আরও কয়েকজন মিলে গোটা বিষয়টা নিয়ে চিংড়ি চাষীর সাথে কথা বলবে। তিনি কাদের জমি নিয়েছেন, কাদের জমি নেননি; যাদের জমি নেননি, কিন্তু ইতিমধ্যে নোনা পানি উঠে গেছে, তাদের জমির হারি কেমন হবে। কয় বছরের জন্যে তিনি জমি নিতে চান। এসব কিছু নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। দিন গেলেই পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে যাবে। বাধা নেই, কোন কথা নেই, তাহলেতো তারা যা বলবে, সেটাই চূড়ান্ত।
খুলনা শহরের টুটুপাড়ায় তখন বৈঠক বসেছে। নামী-দামী প্রভাবশালী অনেকেই আছেন। আলোচনার বিষয় চিংড়ি চাষ। কামারখোলা ও সুতারখালি দুটো ইউনিয়ন নিয়ে গড়ে ওঠা দ্বীপের মত ভূ-ভাগে চিংড়ি চাষ করতে হবে। জায়গাটি মনোরম। একদিকে সুন্দরবন। তিন দিকেই বসতি। তবে ভূ-ভাগটি সম্পূর্ণভাবে নদী দিয়ে ঘেরা। শহর হতে সড়ক পথে যাওয়ার ভালো রাস্তা নেই। খুলনার গল্লামারী এলাকা দিয়ে কোনভাবে দাকোপ উপজেলা সদর – চালনা পর্যন্ত যাওয়া যায়। তারপর নদীপথে ট্রলার চলাচল করে, তাতে যাওয়া যায়। নদীপথটাই সহজ পথ। সেক্ষেত্রে ট্রলার, আর দ্রুতগতির জন্যে স্পিডবোট ব্যবহার করা যায়। জমির মালিক বেশীরভাগ শহর এলাকার। পাইকগাছার লুৎফর রহমান ইতিমধ্যে ওই এলাকার এক অংশে বাঁধ কেটে নোনা পানি তুলে দিয়েছে। ফলে আামদেরও দেরী করা উচিত হবে না।
সব শুনে হাসান নামের নেতা গোছের লোকটা বলেন, তাহলে তোমরা আর দেরি করছ কেন? তোমরাও ওই এলাকার এক অংশে গিয়ে উঠে পড়। বাঁধ কেটে নোনা পানি তুলে দেও।
কে একজন জবাব দিল, কার জমি, কোন অংশে কাটবো; এগুলো আগে থেকে দেখে নিলে হতো না।
বোঝা যায়, নেতা লোকটি ক্ষুব্ধ হয়। বড় বড় চোখ করে বলে, ওই এলাকায় গিয়ে ভালো লোকেশন দেখে বাঁধ কেটে দিয়ে আগে নোনা পানি তুলে দেবে; এতো ভাবনা-চিন্তার কি আছে। জমি কার, মালিক কে, এসব পরে হবে। জমির মালিকতো বেশীরভাগ শহুরে। ওইখানে যারা বাস করে, তারা বেশীরভাগ বর্গাদার। ওরা যদি কেউ কিছু বলতে আসে, বাধা দিতে আসে; জেনে নিবি, জমির মালিক কে? তারপর দেখা যাবে। জমির মালিককে কি বলতে হয়, তা আমি দেখবো।
হাসান সাহেবের ভাইপো ওমরের নেতৃত্বে পরদিন সকালে চারটি ট্রলারে চেপে লোক আসে। অস্ত্র-শস্ত্রও আছে। তারাও ঢাকী নদীর আর এক অংশে বাঁধ কাটা শুরু করে। কারা যেন বাধা দিতে গিয়েছিল, তাদেরকে তারা বেদম পেটায়। পাশাপাশি অনেক বোমাবাজিও হয়। বোমা ফাটার শব্দে এলাকা একেবারে থরেকম্প হয়ে পড়ে। বোমা, গুলি ফাটার শব্দের সাথে সাথে চলে বাঁধ কাটার প্রতিযোগিতা। আর নোনা পানি বিলে ছড়িয়ে গেলে দখলদারদের উল্লাস। রাতের বেলায় ওরা বাঁধের পাশেই তাবু খাটিয়ে কয়েকজনকে পাহারায় বসায়। বাকীরা পাশের ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে গিয়ে ওঠে। চেয়ারম্যানকে বলে, তাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। চেয়ারম্যান কেমন যেন ইতস্তত করছিল। তাই দেখে কে যেন পিছন থেকে বলে ওঠে, ‘… বাচ্চাটা কি বুঝতি পারতিছে না; আমরা কি কচ্ছি।’ ওমর তাকে মৃদু ধমক দিয়ে বলে, ‘এই এসব কি কথা; উনি ভালো মানুষ। আমাইগে খাতি দেবে, থাকতিও দেবে।’ অনেকটা বাধ্য ছেলের মতোই চেয়ারম্যান খাবার জোগাড় করতে শুরু করে।
প্রায় গোটা রাতটাই বিকট শব্দে আওয়াজ হয়। কেউ একজন বলে এগুলো বোমা’র শব্দ। মাঝে-মধ্যে গুলির শব্দও শোনা যায়। বারান্দায় শুয়েছিল শিবু। থেকে থেকে বোমার আওয়াজে সে কেমন অস্থির হয়ে ওঠে। উঠে গিয়ে ঘরের মধ্যে মায়ের কাছে গিয়ে শুয়ে পড়ে। আচমকা অনেক শব্দে বাড়ির গরুগুলোর মধ্যেও অস্থিরতা দেখা দেয়। মাঝেমাঝেই ডেকে উঠছে। একে বিলের নোনা পানির কারণে গরুগুলো আর উন্মুক্ত মাঠে চরে বেড়ানোর সুযোগ পায় না। হঠাৎ করেই তাদের খাবারের সঙ্কট দেখা দিয়েছে; অন্যদিকে রাতের বেলায় তীব্র আওয়াজ।
শিবু এক নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি। সকলেই যে কি-সব বলাবলি করছে। এক ভীতিকর অবস্থা! একদল লোক গায়ের জোরে একটি এলাকার দীর্ঘদিনের চলে আসা অভ্যাস রীতি-নীতি একেবারে পাল্টে দিতে শুরু করেছে। এলাকার মানুষদের মুখের হাসি মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। বয়সীরা আফসোস করে বলতে শুরু করেছে, একাত্তরে আমাদের ওপর পাকিস্তানের সমর্থক রাজাকাররা হামলে পড়েছিল, তখন তারা পাকিস্তান রক্ষার চেষ্টা করেছিল। আর এখন বাংলাদেশ। এই সময়েও একই অরাজক দশা। একজনের ক্ষমতা আছে, টাকা আছে, রাজনীতির জোর আছে, প্রশাসনের জোর আছে, তাতেই বাঁধ কেটে নোনা পানি তুলে, জমি দখলে নিয়ে নিলো। আর কথায় কথায় গালি, ‘… বাচ্চারা, সব এহানে থাহিস ক্যান।’ চলে যেতে বলা। উঠতে-বসতে গালি। কিছু করারও ক্ষমতা নেই। যেন মার খাওয়া, আর অবজ্ঞা-তাচ্ছিল্যের শিকার হওয়া। শিবু ভেবে পায় না, আচ্ছা, … এসবের মানেই বা কি! (চলবে)