খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

রাহুগ্রাস (পর্ব ০১)

গৌরাঙ্গ নন্দী

মধ্য বোশেখের গনগনে তাপের হলকা ছুটছে। মাঠের দিকে তাকানো যায় না। চারিদিকে আলোর নাচন। কি এক ক্লান্তি। চোখ ফেটে জল বেরোয়। নদীর উপর পড়া রোদের ঝিকিমিকি। ও-কি; নদীর ওপাড়ের দিকে কি কেউ আগুন জেলেছে। তবে বাতাসটি ভারী চমৎকার। তাতে না আছে তাপের ঝাঁজ; না আছে শীতের ছোঁয়া। অদ্ভূত এক আবেশী বাতাস। বসে বসে ওই বাতাসে স্নান করছিলেন শিবু পদ। মাঝে মাঝে চোখ দুটো মুদে আসছিল। ঘুম ঘুম ভাব। কি এক আবেশ জড়ানো তাতে। সত্যিই কি সে ঘুমিয়ে যাবে! শরীরটাকে ঠিকঠাক করে একটি খুঁটির সাথে ঠেস দিয়ে বসে। যদি সত্যিই ঘুম চলে আসে, তাহলে যেন পড়ে না যায়। পড়ে গেলে হয়তো গড়িয়ে গড়িয়ে দেহটি সেই ঢাকি নদীতে গিয়ে পড়বে। অবশ্য, তাও একদিকে ভালো। যদি সেখানেই সলিল সমাধি হয়। জীবনের সমাপ্তি। না’ দূর ছাই। কি সব ভাবনা! তিন হাত নীচের ভিজে কাদামাটিতে পড়লে কেউ কি আর মারা যায়! আর সলিল সমাধি! সেতো দূর-অস্ত। আচমকা নদীর মাঝে পড়ে গেলে কেউ যদি উঠতে না পারে, তাহলে হয়তো নদীতে হাবডুবু খেয়ে মরতে পারে। তবে সে পড়ে গেলে মরবে না। হয়তো ব্যথা পাবে। গায়ে কাদামাটি মাখামাখি হবে। কেউ তা দেখলে হাসাহাসি করবে। মরণ হবে না! মরণ কি এতো সোজা!

শিবু। পুরো নাম শিবুপদ মন্ডল। নামটি বিকৃত করে কেউ কেউ শিবে বলেও ডাকে। আজকাল তার কোন কাজ নেই, অথবা কাজ তার ভালো লাগে না। আর বোশেখ মাসের এ রকম তপ্ত গরমে কি-ই-বা কাজ করবে! আশে-পাশে কোন কাজও নেই। কাজের জন্যে যেতে হয় দূরে, অনেক দূরে। কে আছে তার? যে কারণে ছুটতে হবে! একা মানুষ। দু’বেলা দু’টো জুটলেই হ’ল। না হলে উপোষ করে চালিয়ে দেয়া। খানিকটা অলস সময় কাটানো। একান্ত নিজের মত করে সময় পার করা। আর নদীর পাড়ে বাঁধের ওপর দোচলা পাঁচ হাত বাই দশ হাতের বেড়াবিহীন উদোম ঘরে বসে বাতাসে স্নান করা। আর দিবা-স্বপ্ন দেখা। এর মজাটাই আলাদা।

আজকাল শিবুপদ প্রায়ই এমনটি করে। একাকী বসে থাকে। কখনও চোখ যায় দূরে, আবার কাছে। ঢাকী নদীর ভাঙ্গন দেখে। তাকিয়ে থাকে। কেমন করে নদীটা ধনুকের মত করে ওপারের দিকে চলে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে যেমন এই পারে ভাঙ্গন হানা দিয়েছিল। ভাঙতে ভাঙতে নদীতীরের জমি, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, রায়দের বাড়ি, স্কুলঘর, মন্দির, পরে ওই কোণে মন্ডলদের ঘর, সব স-ব গিলে ফেলে। এখন যেন এ পাড়কে ক্ষমা করেছে। এখন আক্রমণ ওপাড়ে। ভাঙছেতো ভাঙছেই। নদীটা ধনুকের মতো বেঁকে চলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝেই শিবুপদ’র মাথায় মৃত্যুর কথা আসে। ভাবে মৃত্যুটা হয়ে গেলে ভালোই হতো। কিন্তু কিভাবে! চাইলেইতো মৃত্যু আসে না। মনে মনে আওড়ায় কবি বলেছেন, ’মরণরে তুহু মম শ্যাম সম।’ মরণরে শ্যাম ভেবে আহ্বান করা। আসলে মরণকে বরণ করে নেওয়ার মানসিক প্রস্তুতি। আবারও কেউ কেউতো সত্যি সত্যি আচমকাই মারা যায়। এখনতো তার চারপাশে কেউ নেই। তার জন্যে কাঁদারও কেউ নেই। কেউ তার জন্যে অপেক্ষা করেও থাকে না। কি করে সময় কাটাবে! কি করে তার খাওয়া চলবে। তবেতো মৃত্যুই ভালো। না সেটি তার হাতে নেই। কোন এক অদৃশ্য টানে সেটি নির্ধারিত। তা না হলে এতোকিছুু দেখার জন্যে কি তার বেঁচে থাকার দরকার আছে! কতোকিছুইতো দেখলো এই ছোট্ট জীবনটিতে। দু:খ-বেদনা আর টিকে থাকার জন্যে সংগ্রাম ছাড়া আর কিছুইতো সে পায়নি। যাদেরকে আপন ভেবেছিল; আপন করে গড়ে তুলতে চেয়েছিল, তারাতো সকলেই একে একে তাকে ছেড়ে চলে গেছে। এখন সেতো একেবারে একা। আচ্ছা, মানুষ তবুও এই জীবনকে এতো ভালোবাসে কেন? এই জীবনের প্রতি এতো মায়া কেন? সেকি স্মৃতির জাবর কাটার জন্যে। তবে কেন, ঘুরে-ফিরে তার পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে!

ধোপাদি নামের এই যে গ্রামটি, নদীর কুল বেয়ে গড়ে ওঠা একটি ভূ-খন্ড। ছোট। চারিদিকে নদী। এর তিনদিকেই নদীর ওপাড়ে বসতি। একদিকে, ওপাড়ে বন, সুন্দরবন। নদীর ধার ঘেঁষে যেমন গ্রাম। তেমনি গ্রামের মাঝ দিয়েও নদী ছিল। এখনও আছে। কেউ কেউ বলে খাল। ওই খাল বা নদীর পাড়েও গ্রাম ছিল। গ্রাম ছিল মানে কয়েকটি ঘর পাশাপাশি। খুব বেশীদিন আগের কথা নয়। বড় জোর দুশো বছর। তার আগে এই গাঁগুলোও সব ওই সুন্দরবনের মধ্যে ছিল। ইংরেজরা এখানে পত্তনি দিল। বন সাফ করে বসতি হলো। জমিদার, গাতিদার, হাওলাদারেরা সব জমি পেল। এরা সবই শহরে থাকে। কাছেই খুলনা শহর। কেউবা বাগেরহাটে। কেউবা সাতক্ষীরায়। আর এখানে বসত করে তাদের আস্থাভাজন শিবুপদের বাবার বাবা – ঠাকুরদাদা, তার বাবা-কাকারা। বাবার মা – ঠাকুরমা’র কাছে গল্প শুনেছে শিবুপদ। ঠাকুরমার ঠাকুর-দাদারা না-কি যশোর বা তার চেয়েও উত্তরের কোন এক গাঁ থেকে এখানে এসে বসতি গড়ে তোলে। জায়গাটি বড় মনোরম। নদী-খালে মাছ মেলে। বনে গেলে কাঠ মেলে। মধুও মেলে। তবে আছে বাঘ। সাপ। আছে মায়াবী হরিণ। অনেকে সে হরিণও ধরে। হরিণ ধরে বিক্রি করা অনেকের নেশা; আবার পেশাও। ধনীর বাড়িতে হরিণের চামড়া থাকে। দেওয়ালে টানিয়ে রাখে। আবার কেউ কেউ চেয়ারের উপর দিয়ে বসে। ধনীর বাড়িতে বাঘের চামড়াও থাকে। শোভাবর্ধনকারী বস্তু। তবে এ মহার্ঘ্য বস্তু পাওয়ার জন্য বনের পশুকে হত্যা করতে হয়, যা কোনভাবেই কাম্য নয়।

তবে বিপদ হচ্ছে জোয়ারের নোনা পানি। মাঘ মাসের মাঝামাঝি হতেই নদীর পানি নোনা হতে শুরু করে। বৈশাখ-জৈষ্ঠে নোনার মাত্রা সবচেয়ে বাড়ে। শ্রাবণ-ভাদ্রে বৃষ্টি হলে নোনা কমতে থাকে। আবারও নদীর পানি মিষ্টি হয়। বৃষ্টিতে নদীর পানি ফুলেও ওঠে। জোয়ারে সাগর হতে আসা পানির তোড়ে মাঠ-ঘাট ডুবে যায়। তা থেকে রেহাই পেতে মানুষ দল বেঁধে নদী বরাবর বাঁধ দেয়। আর বাঁধের ভিতর নীচু জমিতে বর্ষার পানিতে চাষ করে। আমন ধানের চাষ। ফসল বলতে ওই একটাই। আমন ধান। তাতে যা ফলতো, তাই দিয়েই সংসার খরচ। খাওয়া-পরা। ধান উঠলে জমির মালিককে অর্ধেক ধান দিয়ে বাকী ধানে নিজেদের চলা। সারা বছরের খাওয়া। আবার ওই ধান বিক্রি করে জামা-কাপড় কেনা। আর বাড়ির আনাচে-কানাচে সবজি ফলানো। জাল নিয়ে নদী থেকে মাছ ধরা। বাড়ির গরুর দুধ খাওয়া।

বর্ষায় বাঁধ ভেঙ্গে গেলে আবারও ঠিকঠাক করা। বাঁধগুলো সাধারণত: ছয় মাস থেকে আট মাস টিকে থাকতো, তাই তার বাহারি নামও ছিল ষষ্ঠমাসী বা অষ্টমাসী বাঁধ। কখনও কখনও বর্ষার তোড় বেশী হলে বাঁধ ভেঙ্গে গাঁ ভাসিয়ে নেওয়ার উপক্রম হতো। গাঁয়ের পুরুষ ছেলেরা তখন জড়ো হয়ে সেই বাঁধ রক্ষায় পাহারা দিতো। বাঁধে ফাটল দেখা দিলে ঝড়-বাদলার দিনেও চাক চাক করে মাটি কেটে বাঁধ আটকাতো। খুবই ঝক্কির কাজ। কষ্টও খুব। কিন্তু বাঁধ না আটকানো গেলে বিল ভেসে যাবে। ক্ষেতের ফসল তলিয়ে যাবে। চাই-কি বাড়ি-ঘরও ভেসে যেতে পারে, তাই পুরুষেরা বাঁধ রক্ষার কাজ করতো। আর তখন ঘরে ঘরে নারীরা ঠাকুর-দেবতার নাম জপতো। যাতে দেবতারা তুষ্ট হয়ে তাদের রক্ষা করে।

শিবু বলে ওঠে, কোই ঠাম্মা, আমিতো এসব দেখিনি?

ঠাকুমা একগাল হেসে বলে, তুমি কি করে দেখবে দাদুভাই, তুমিতো তখন হওনি। দুই হাতে শিবুর গালটা টিপে দিয়ে ঠাম্মা আরও বলে, আমি যহোন বউ হয়ে এই গাঁয়ে আলাম, সেতো তহোনকার কথা। তারপরতো কত সময় গেল। আইয়ুব খানের সরকার মাটির বড় বাঁধ দিতি শুরু করলো। কতো লোক। দৌড়োদৌড়ি-হুড়োহুড়ি। বিলির নদীর ধারের মাটি চাক চাক কইরে কাইটে তাই দিয়ে বাঁধ তৈরি করে। তারপরতো আরও কতোকিছু।

-বাঁধ? বিস্ময়ভরা চোখে জানতে চায় শিবু।

-হ্যাঁ, দাদুভাই। ঠাম্মা বলে চলে। ওই যে আমরা যাকে ভেড়ি বলি, তাই বাঁধ। নদীর দুই ধার দিয়ে চলে গেছে। অনেক চওড়া। উঁচুও অনেক। আর মাঝে মাঝে স্লুইস গেট। বিলের মধ্যে জমে যাওয়া জল বের করে দেয়ার জন্যে তৈরি করা। ওই ভেড়ির উপর দিয়ে আমরা এখন চলাচল করি। চলাচলের রাস্তা।

শিবু চোখের সামনেই যেন ঠাম্মাকে দেখতে পায়। ঠাম্মার আদরে আদরে নাকি শিবুটা আর মানুষ হতে পারেনি। ভ্যাবলা রয়ে গেল সারাটা জীবন। ঠাম্মার উদ্দেশ্যেই যেন শিবু বলে, ও ঠাম্মা, আমি কি ভ্যাবলা? তুমি কি আমাকে ভ্যাবলাই বানালে? সকলে আমায় ঠকায় কেন? না-কি আমি সকলকে ঠকাই! আমি কিভাবে ঠকালাম। আমি কি কাউকে ভালোবাসতে পারলাম না! কেন, কাউকে আমি ধরে রাখতে পারলাম না। একে একে সক্কলেই আমারে ছেড়ে চলে গেল। কাউকে আমি রাখতে পারিনি। আসলে ভালবাসার রং কি? দেখতে কেমন? সে-কি কিছু চাওয়া। জীবনের, দেহের, আনন্দের, সঙ্গী হওয়া, না-কি ক্ষুধা নিবারণের উপায়। কোন ক্ষুধা? পাকস্থলীর, না-কি মিলনের? কোনটা ঠাম্মা, আমায় বলো না?

আচমকাই একটি বক ঢাকীর বুকে ঝাঁপ দিয়ে মাছ তুলে নেওয়ার চেষ্টা করে। শিবু নড়েচড়ে বসে। মাছটা তুলতে পারলো কি-না, তা বোঝা গেল না। তবে বকটির ছোঁ মারা চোখের সামনে ঘটায় শিবুর ভাবনার তাল ছিঁড়ে যায়। দূরে, ওপাড়ে নদীর জলে রোদের ঝিকিমিকিতে যেন আগুনের ফুলকি উঠছে। বেশ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকে। ওপাড় ঘেঁষে একটি ট্রলার (ইঞ্জিন চালিত নৌকা) ছুটে চলেছে। কোথায় যাচ্ছে? তিলডাঙ্গা, নলিয়ান বাজার; অথবা গড়–ইখালির পাড়ে। গড়–ইখালি। অনেক ধনীর বাস। ওই ধনী ক্ষমতাধররাই একদিন তাদের পাড়ে এসে ভেড়ি কেটে দিল। কি হবে ওসব ভেবে! খুঁটিতে মাথাটি হেলান দেয়া শিবুর চোখদুটো আবারও মুদে আসে। কিন্তু ভাবনা যায় না। ফিরে ফিরে আসে। শিবু তাতে ডুবে যায়।

শিবুর তখন কিশোর কাল। একদিন মাঘি পূর্ণিমার রাতে হৈ হৈ শব্দে সারা পাড়া জেগে ওঠে। সেও ঘুমিয়ে গিয়েছিল। ঘুম ভেঙ্গে মানুষের চেঁচামেচি, চিৎকার, হা-হা-কার ধ্বনি শোনে। ঠিকমত বুঝতে পারেনি। আবারও ঘুমিয়ে পড়ে। ভোরে ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যায়। কাছের নদীর পাড়ে তখন অনেক জটলা। ঘুম থেকে উঠে চোখে কোনমতে জলের ঝাপটা দিয়ে সেও নদীর পাড়ে যায়। তাহলে গত রাতের শব্দ-চেঁচামেচি আজও চলছে। কি ঘটনা, দেখতে হয়।

বাঁধের কাছে, বিলের এক কোণে একটু উঁচুমতো জায়গায় পাড়ার প্রায় সকল পুরুষ সদস্যরাই জড়ো হয়েছে। শিবে সেখানে এগিয়ে যায়। আর একটু দূরে ভেড়ির উপর দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকজন লোক। তাদের হাতে বন্দুক। কারও হাতে লাঠি। তারাই বাঁধ কেটে দিয়েছে। শুধু বাঁধ নয়; বাঁধের বাইরে, নদীর পাশে যে বড় জমি তাও কেটেছে। বাঁধের কাটা অংশ বরাবর নদী পর্যন্ত একটি খাল। ওই খাল দিয়ে ঢাকির পানি বাঁধের কাটা অংশ দিয়ে হু হু করে বিলে প্রবেশ করছে। নদীর নোনা পানি। এই পানি টেনে আনার জন্যে বাঁধ-এর বাইরে নদীপাড়ের হাত পনেরো জমি কেটে বাঁধ পর্যন্ত খাল তৈরি করতে হয়েছে। আর জোয়ারের পানির চাপে সেই কাটা অংশ দিয়ে হু হু করে পানি ঢুকছে। বলা হচ্ছে, এই নোনা পানিতে চিংড়ির চাষ হবে। বাগদা চিংড়ি। এপাশে জড়ো হওয়া পাড়ার মানুষগুলো হা-হুতাশ করছে।

কেউ একজন বলছে, নদীতি বাঁধ দিয়া হইছিল, নোনা পানি ঠেকানোর জন্যি; আর সেই বাঁধ কাইটে আবার নোনা পানি আনা হচ্ছে।

-হ, বাগদা চিংড়িতে অনেক লাভ। তাই তারা চিংড়ির চাষ করবে।
-তারা কতটুকু জমি নিছে। পানিতো উঠোচ্ছে দেদার।
-আমরাতো কিচ্ছু জানিনে।
-জমির মালিকরা কি তাইগে জমি দিছে?
-যারা বাঁধ কাইটে পানি তুলতিছে, তাদের কারুতো এইহেনে জমি নেই।

এভাবে এক একজন কথা বলছে। সকলের কথায় উদ্বেগ। সকলেই ভীত সন্ত্রস্ত। এক অনিশ্চিত অন্ধকারের দু:স্বপ্ন যেন সকলকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। এরমধ্যে ও পাড়ার হরেন কাকা প্রায় করুণ সুরে আর্তনাদ করে বলে ওঠে, বঙ্গবন্ধু দ্যাশটারে স্বাধীন করিলো। ভাবিলাম এই দ্যাশে হিন্দুরা থাকতি পারবে। তারেতো ঝাড়ে-বংশে মাইরে ফেললো। এহোন আমাইগো মারবেনে। কিছু হলিতো, হিন্দুগে পরে চাপ পরে। তোরা এহেনে থাইস ক্যান। চইলে যা। এবার না আবার তাই শুরু হয়!

সলিল দা, কথা বলেন। দেখ কাকা, এটা দুশ্চিন্তার বিষয় বটে। কিন্তু তাই বলে এভাবে ভাবলেতো চলবে না। আর আমরা সংখ্যালঘু। আমাদের উপর চাপ দেয়া খুব সহজ, এসব কথাও সত্যি। কিন্তু আমরা যদি এক থাকি, তাহলেতো এই চাপ মোকাবেলা করাও যায়। তবে বন্দুক-গোলাগুলির সামনেতো আমরা দাঁড়াতে পারবো না, এটাও সত্যি কথা।

আজকের সকালটাই কেমন বিবর্ণ। কোন কিছুই যেন স্বাভাবিকভাবে চলছে না। ভোরের আলো সেও কেমন যেন বিবর্ণ। গরুগুলো কেউ মাঠে ছাড়ছে না। ঘরের নারীরাও উঠোন ঝাড় দিতে যেন ভুলে গেছে। কোন বাড়িতে রান্নার আয়োজন নেই। সকাল বেলায় কেউই হয়তো খাবে না। ছোটরা যারা উঠেছে, খাবারের জন্যে মায়েদের বিরক্ত করছে; তাদের উপর মায়েদের যেন সকল রাগ। বকাঝকা, কেউ কেউ দু’চার ঘা শিশুদের পিঠের উপর বসিয়েও দিয়েছে। কি অদ্ভূত! কোথাকার কোন পাইকগাছার এক ধনী-ব্যবসায়ী সরকারের সায় নিয়ে, থানা-পুলিশকে জানিয়ে বাঁধ কেটে নোনা পানি তুলেছে। বাগদা চিংড়ির চাষ করবে। গরীব চাষীরা যাতে বাধা দিতে না পারে, আর বাধা দিলেও যাতে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিহত করা যায়, সে কারণে সঙ্গে বন্দুকধারীও আছে। আর এই ক্ষোভের জালা এখন মায়েরা তাদের শিশুদের উপর ঝাড়ছে।

শুরু হয়েছে শলা পরামর্শ। কিভাবে এই অরাজকতা রোখা যায়। রুখতে হবে, তা না হলে যে ধান হবে না। ধান না হলে সারা-বছর এই বাদার পাশের মানুষগুলো কি খাবে। একবারের আমন ফসলের আধাআধি ভাগ দিয়ে যা পাওয়া যায়, তা দিয়েই বছরের খাওয়া, কাপড়-চোপড় কেনা, লেখাপড়ার খরচ মেটানো, আত্মীয়-কুটুম্বিতা -সব সব চালানো যখন দায়; তখন এই নতুন উৎপাত। কত বছর ধরে চলে আসছে এই নিয়ম। সেই কবে বাদা কেটে ভূমি হাসিল হল। সেই ভূমির মালিক হ’ল শহুরে ধনী বাবুরা। এখানে যারা এলো বসতি গড়তে, তারা হলো ভাগ চাষী। যারা চাষ করে, তারা ভাগ চাষী। ফসলের ভাগ পায় তাই এমন নাম। বর্ষার শুরুতেই বীজতলা তৈরি, জমি তৈরি, ধান রোপন করা, ধান পুষ্ট হলে কাটা, খৈলেনে জড়ো করা। আর তখন জমির মালিকরা পরিযায়ী পাখির মতন এসে হাজির হয়। তারা খৈলেনের পাশে এক জায়গায় নাড়া দিয়ে তৈরি অস্থায়ী আবাসে ঠাঁই নেয়। সময়মতো খাবার খায়। আর কবে ধান মাড়াই হবে, তার ক্ষণ গোণেন। ধান মাড়াই হয়। সেই ধানের আধাআধি ভাগ তুলে দেয়া হয় মালিকের নৌকায়। সাথে ভাগচাষীর লোকেরাও যায়। জমির মালিকের গোলায় ধান তুলে দিয়ে তবেই স্বস্তি। জমির মালিকের কষ্ট পাওয়া চলবে না, তাহলে পরের বার যদি তার কাছ থেকে জমি ছাড়িয়ে অন্য কারও কাছে দেয়। তবে নিশ্চিন্ত আয়ের পথ কমে যাওয়া। সংসারের খরচ জোগাড় করা দায়।

এখানকার প্রায় সকলেই ভাগচাষী। এই ভাগচাষীদের নিজের জমি খুব একটা বেশী নেই। ওই এক বিঘে, দুই বিঘে। কারোর হয়তো পাঁচ-ছয় বিঘে হবে। আর হাতে গোণা কয়েক জনের আছে পঞ্চাশ-ষাট বিঘে জমি। টাউন খুলনার কংগ্রেস নেতা নগেন সেন, সেই ৪৭ এর পরে ভারত-পাকিস্তান হওয়ার পর ইন্ডিয়ায় চলে যাওয়ার সময় ভাগচাষী হরষিত মন্ডলদের তার পঞ্চাশ বিঘা জমি দিয়ে যায়। হয়তো টাকা কিছু দিয়েছিল, অথবা দেয়নি। সেই থেকে তারা এই পাড়ার, এই এলাকার ধনী চাষী। সকলেই তার কাছে যাওয়া সাব্যস্ত করে। কথা বলতে হবে। পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে হবে। করণীয় ঠিক করতে হবে। (চলবে)

 

খুলনা গেজেট / আ হ আ




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!