রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে পরিপূর্ণ আদব রক্ষা করার আবশ্যকতার বিষয়টি মুসলিম ব্যক্তি তার মনে প্রাণে অনুভব করে; আর এ আবশ্যকতার ব্যাপারটি নিম্নোক্ত কারণে:
১) আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক মুমিন পুরুষ ও নারীর উপর রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে পরিপূর্ণ আদব রক্ষা করে চলার বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন; কেননা, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বাণীর মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন:
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ
হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সমক্ষে তোমরা কোনো বিষয়ে অগ্রণী হয়ো না। -সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১
২) আল্লাহ তা‘আলা মুমিনগণের উপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করার বিষয়টিকে ফরয করে দিয়েছেন, ঠিক তেমনিভাবে তাঁকে মহব্বত করার বিষয়টিকেও তাদের জন্য বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর। -সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৩৩
৩) আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে ইমাম (নেতা) ও বিচারক বানিয়ে দিয়েছেন; আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
نَزَّلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ
আমরা তো আপনার প্রতি সত্যসহ কিতাব নাযিল করেছি, যাতে আপনি আল্লাহ আপনাকে যা জানিয়েছেন, সে অনুযায়ী মানুষের মধ্যে বিচার মীমাংসা করতে পারেন। -সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩
৪) আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে মহব্বত করার বিষয়টিকে তাঁর অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু ﷺ ভাষায় ফরয করে দিয়েছেন; রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ، حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ
সেই সত্তার কসম করে বলছি, যাঁর হাতে আমার জীবন! তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার সন্তান-সন্ততি, তার পিতামাতা ও সব মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় হব। -বুখারী, হাদিস নং- ১৪ ও ১৫; মুসলিম, হাদিস নং- ১৭৮ আর যাঁকে ভালোবাসা আবশ্যক, তাঁর সাথে আদব রক্ষা করে চলাটাও বাধ্যতামূলক এবং তাঁর সাথে সভ্য আচরণ করা বাঞ্ছনীয়।
৫) যাঁকে রব্বুল আলামিন আল্লাহ তা‘আলা শারীরিক গঠনাকৃতি ও নৈতিক চরিত্রের সৌন্দর্যের দ্বারা বিশেষিত করেছেনে এবং যাঁকে আত্মসম্মান ও বৈশিষ্ট্যের পূর্ণতা দান করেছেন, তিনি হলেন সবচেয়ে সুন্দর ও শ্রেষ্ঠতর সৃষ্টি; সুতরাং যাঁর এ অবস্থা, তাঁর সাথে ভদ্র ও সভ্য আচরণ করার বিষয়টি আবশ্যক হবে না কিভাবে!
এসব হলো রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে আদব রক্ষা করে চলার কিছু জরুরি বিষয় এবং এগুলো ছাড়া আরও অনেক বিষয় রয়েছে; কিন্তু কিভাবে আদব রক্ষা করা যাবে? আর কিসের দ্বারা সে আদব রক্ষা করা সম্ভব হবে? এ বিষয়টি ভালভাবে জানতে হবে!
নবী করীম ﷺ এর সাথে আদব হবে:
(ক) দীন ও দুনিয়ার সকল নিয়মনীতি ও কর্মপদ্ধতিতে তাঁর আনুগত্য করা, পদাঙ্ক অনুসরণ করা এবং তাঁর পদক্ষেপ অনুযায়ী পরিকল্পনা করা।
(খ) তাঁর প্রতি ভালোবাসা, সম্মান ও মর্যাদার উপর অপর কোনো সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা, অথবা সম্মান, বা মর্যাদাকে অগ্রাধিকার না দেওয়া।
(গ) তিনি যাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতেন, তাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করা; তিনি যাকে শত্রু বলে গ্রহণ করতেন, তাকে শত্রুরূপে গ্রহণ করা; তিনি যাতে সন্তুষ্ট থাকতেন, তাতে সন্তুষ্ট থাকা; আর তিনি যার প্রতি রাগান্বিত হতেন, তার প্রতি রাগ করা।
(ঘ) তাঁর নামকে সম্মান করা এবং তাঁর নাম উচ্চারণের সময় শ্রদ্ধা করা; তাঁর প্রতি দরূদ ও সালাম পেশ করা; তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা এবং তাঁর মহৎ গুণাবলী ও মর্যাদাকে যথাযথ মূল্যায়ন করা।
(ঙ) দীন ও দুনিয়ার বিষয়ে তিনি যেসব সংবাদ দিয়েছেন এবং দুনিয়ার জীবন ও আখিরাতের ব্যাপারে গায়েবী বিষয়ে যেসব তথ্য দিয়েছেন, সেসব ব্যাপারে তাঁকে সত্যবাদী বলে বিশ্বাস করা।
তাঁর সুন্নাতকে জীবিত করা এবং তাঁর শরী‘য়তকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করা; আর তাঁর দা‘ওয়াতকে পৌঁছিয়ে দেওয়া এবং তাঁর অসীয়ত তথা নির্দেশসমূহ বাস্তবায়ন করা ।
(চ) আল্লাহ তা‘আলা যাকে নবী ﷺ এর কবর ও মাসজিদে নববী যিয়ারত করার মত সুবর্ণ সুযোগ দিয়েছেন, তাঁর কবরের নিকট এবং মাসজিদে নববীতে তার কণ্ঠস্বরকে নিম্নগামী করা।
(ছ) তাঁর ভালোবাসার কারণে সৎব্যক্তিগণকে ভালোবাসা ও বন্ধুরূপে গ্রহণ করা; আর তাঁর ঘৃণার কারণে ফাসীক লোকদের পাপাচারকে ঘৃণা করা। যারা রসূল ﷺ এর শানে কটুক্তিমূলক কথা বলে এবং বেয়াদবীপূর্ণ আচরণ করে ঐ সকল কুলাঙ্গারদের ঘৃণা করা ও তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা। -মিনহাজুল মুসলিম, পৃ. ১১৪ – ১১৫
এগুলো হচ্ছে নবী ﷺ এর সাথে আদব তথা শিষ্টাচারপূর্ণ ব্যবহারের কিছু বাহ্যিক চিত্র।
সুতরাং মুসলিম ব্যক্তি সেসব আদব পরিপূর্ণভাবে পালন ও সংরক্ষণের ব্যাপারে সব সময় সচেষ্ট থাকবে; কেননা, এর উপর তার জীবনের পরিপূর্ণতা ও সফলতা নির্ভর করে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার নিকট আমাদের নিবেদন, তিনি যেন আমাদেরকে আমাদের নবী ﷺ এর সাথে আদব রক্ষা করে চলার তাওফীক দান করেন এবং আমাদেরকে তাঁর অনুসারী, সাহায্যকারী (আনসার) ও তাঁর অনুকরণকারীদের মাঝে আন্তর্ভুক্ত করে নেন; তিনি যেন আমাদেরকে তাঁর আনুগত্য করার সুযোগ করে দেন এবং আমাদেরকে তাঁর শাফা‘আত (সুপারিশ করা) থেকে বঞ্চিত না করেন। আল্লাহুম্মা আমীন।
(লেখক : ইমাম ও খতিব, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়)