রাষ্ট্রের প্রায় সব খাতেই সংস্কার আনার কথা জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। তবে তারা নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গণমাধ্যম এ পাঁচটি খাতকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন বলে জানিয়েছেন। বিএনপির চাওয়াও এ খাতগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত সংস্কার করুক। এজন্য তারা বর্তমান সরকারকে যৌক্তিক সময় ও পরামর্শ দিয়ে সহায়তাও করতে চায়। তথ্য বলছে, এ খাতগুলোতে সংস্কারের কথা বিএনপি আগেই ঘোষণা করেছিল।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে ৩১ দফা সংবলিত ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা’ ঘোষণা করে বিএনপি। ওই ঘোষণার মধ্যেই এ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে অনেকটাই মিল থাকায় বিএনপির পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে আপত্তি না তুলে বরং কীভাবে এবং কত দ্রুত সংস্কার করা যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বিএনপির মতে, বিনা ভোটে চার দফায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রের মূল প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে ফেলেছে। তাই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করতে হলে এসব সেক্টরে সংস্কার আনতেই হবে। সেটি করা সম্ভব না হলে মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট থেকে যাবে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের এ উদ্যোগ ইতিবাচকভাবে দেখছে বিএনপি। সংস্কার করার সময় বিএনপির কাছে কোনো পরামর্শ চাইলে বিএনপি সর্বাত্মক সাড়া দেবে বলে জানা গেছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূস যে খাতগুলোতে সংস্কারের কথা বলেছেন, তা অত্যন্ত ইতিবাচক। তিনি জনআকাক্সক্ষার যথার্থ প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।’
গত বছর জুলাইয়ে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা রূপরেখা ঘোষণা করেছিল বিএনপি। দলটি তখন জানিয়েছিল, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে জয়লাভের পর ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার হটানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। ওই সরকারই রাষ্ট্র সংস্কার করবে।
আরও বলা হয়েছিল, দফাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, একটি ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’ গঠন করে সব বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী ও পরিবর্তনসমূহ পর্যালোচনা-পূর্বক তা রহিত কিংবা সংশোধন করা হবে। সংবিধানে গণভোট ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে। সব মত ও পথের সমন্বয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ‘নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের সমন্বয় করা হবে। পরপর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংসদে ‘উচ্চকক্ষ’বিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন করা হবে। ‘প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন’ গঠন করে প্রশাসন সংস্কার ও পুনঃগঠন করা হবে। আইসিটি অ্যাক্ট-২০০৬, সন্ত্রাসবিরোধী আইন-২০০৯-এর প্রয়োজনীয় সংশোধন এবং স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট-১৯৭৪, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-২০১৮-সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সব কালাকানুন বাতিল করা হবে।
গত ১৮ আগস্ট রাজধানীর একটি হোটেলে ঢাকায় বিদেশি বিভিন্ন মিশনের রাষ্ট্রদূত ও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘এমন একটি সময়ে দেশের দায়িত্ব নিয়েছি, যখন প্রায় সব ক্ষেত্রেই চরম বিশৃঙ্খলা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তাই নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গণমাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর অন্তর্বর্তী সরকার একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আয়োজন করবে।’
বিএনপিও মনে করে, আগামীতে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য এগুলো প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে প্রস্তুত করতে হবে। সে কথা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছেও বলেছে বিএনপি। গত ১২ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির পক্ষ থেকে বৈঠকে বলা হয়েছে নির্বাচনের যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারকে সময় দেওয়া হবে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে কিছুটা সময় লাগবে। এ সময় রাষ্ট্র কাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। সেই সংস্কারের সঙ্গে বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফার মূল স্পিরিটের হুবহু মিল রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু এ বিষয়ে সংস্কার করতে চাচ্ছে, তাই বিএনপি সর্বোচ্চ সহায়তা করবে।
গত সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। ছাত্ররাও এ সংস্কারের কথাই বলছে। এ সংস্কারকে আমরা স্বাগত জানাই।’