প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ১৯১৪ সালে আর শেষ হয় ১৯১৯ সালে। ভারতের তৎকালীন সময়ের শাসক বৃটিশ সরকার এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধ প্রচেষ্টায় ভারতীয় সাহায্য ও সহযোগিতা বৃটিশ সরকারের কাছে অপরিহার্য ছিল। ১৯১৬ সালে লখনৌ চুক্তির ফলে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ঐক্যবদ্ধ ভাবে ভারতের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি করে।
পরবর্তী একটি সময় ১৯১৭ সাল। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামের সন্তান কাজী নজরুল ইসলাম বৃটিশ সেনাবাহিনীর বেঙ্গলি রেজিমেন্টে যোগ দেন, উদ্দেশ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়া। তিনি তখন রানীগঞ্জের শিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ বৃটিশ সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অংশ নেন। বর্তমান পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের পেশোয়ার জেলার নৌশহরা মহাকুমায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
১৯২০ সালের মার্চ মাসে ৪৯ নং বেঙ্গলি রেজিমেন্ট ভেঙ্গে দেয়ার আগ পর্যন্ত তিনি পেশোয়ার ও বেলুচিস্তানে অবস্থান করেন।
তেমনি একটি সময় বৃটিশ সরকারের নিপীড়ণমূলক কর্মকান্ড, যেমন ১৯১৯ সালের রৌলট আইন এবং জালিনওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডে ভারতবাসীর মনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী নেতা মহাত্মা গান্ধী এসব অসন্তোষকে কেন্দ্র করে বৃটিশদের বিরুদ্ধে অসহোযোগ আন্দোলন, মাওলানা মোহাম্মাদ আলী ও শওকত আলীর নেতৃত্বাধীন খেলাফত আন্দোলকে সমর্থন দেন। সে সময়ে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচির মধ্যে ছিল বৃটিশ পণ্য, খেতাব, আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্জন।
উনবিংশ শতকের শেষ বা বিংশ শতকের দ্বিতীয়-তৃতীয় দশকে বিস্তৃত রাজনৈতিক পটভুমিতে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের আর্বিভাব। এ সময়ে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে ভারত উত্তপ্ত ছিল। কবি এ আন্দোলনকে মানসিক ভাবে সমর্থন দিতেন। কয়েকটি সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন।
শিয়ারশোল হাইস্কুলে অধ্যায়ন কালে শিক্ষক নিবারাণ চন্দ্র ঘটক তাকে মা, মাটি ও মানুষকে ভালোবাসতে উদ্বুদ্ধ করেন। বৃটিশের শৃঙ্খল মুক্ত করে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাতেন। এ শিক্ষক তাকে বৃটিশের নিপীড়নের বিরুদ্ধে মানুষের মুক্তি ও প্রাপ্য সম্পর্কে ধারণা দিতেন। সেই থেকে কবির মধ্যে বিদ্রোহী সত্তা কাজ করতে থাকে। তার লেখায় শোষণমুক্ত সমাজ, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতার কথা ফুটে উঠত। স্বাধীনতা সংগ্রামী গোপীনাথ সাহা, ক্ষুদিরাম বসু, সূর্যসেন, যতীন দাস প্রমূখের আত্মত্যাগ তাকে অনুপ্রাণিত করে।
১৯২০ সালে মার্চে সেনাবাহিনী থেকে ফিরে এসে কবি বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য অফিসে ওঠেন। থাকতেন কমিউনিটি পার্টির সহকারী সম্পাদক কমরেড মুজাফ্ফর আহম্মেদের কক্ষে। ভারতের এই প্রগতিশীল রাজনীতিক কবিকে মার্কসীয় দর্শনে উব্দুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। বামপন্থী এই নেতা কবির কাছে জানতে চান তিনি রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট হবেন কী না। উত্তরে কবি রাজনীতি করা ইচ্ছে ব্যক্ত করেন।
১৯২০ সালের ১২ জুলাই নবযুগ নামে সান্ধ্য দৈনিক প্রকাশিত হয়। কবি এই পত্রিকায় সম্পাদকের দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি সংবাদ লেখার পাশাপাশি উপ-সম্পাদকীয় ও সম্পাদকীয় লিখতেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এ দৈনিক প্রকাশনায় অর্থ যোগান দিতেন। কবি নবযুগের সম্পাদকীয় স্তম্ভে অনেক জ্বালাময়ী ও আবেগপূর্ণ প্রবন্ধ লেখেন। ১৯২২ সালে যুগবানী নামের গ্রন্থে অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তার লেখা প্রকাশিত হয়। ১৯২২ সালে ৬ জানুয়ারী বিজলী নামক পত্রিকায় কবির বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯২২ সালে ২০ জানুয়ারী চিত্তরঞ্জন দাসের সম্পাদনায় বাংলার কথায় কবির ভাঙ্গার গান (কারার ঐ লৌহ কপাট/ ভেঙ্গে ফেল, করবে লোপাট) প্রকাশিত হয়। ভাঙ্গার গান কবিতাটি বৃটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। ১৯২২ সালের ১২ আগষ্ট তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ধুমকেতু নামের অর্ধ সাপ্তাহিক। একই বছরের ১৩ অক্টোবর ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চেয়ে কবি ধুমকেতুতে প্রবন্ধ লেখেন।
প্রবন্ধে তিনি ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দ্বায়িত্ব ও সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা এবং শাসনভার থাকবে এ দেশবাসির হাতে এমন প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রবন্ধে তিনি স্পষ্ট উল্লেখ করেন এখানে বিদেশীদের কোন অধিকার থাকবে না। এ দাবি জনসমর্থন পায়। ১৯২২ সালের ৮ নবেম্বর ভারতীয় দন্ড বিধির ১২৪ ধারায় কবির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হয়। ১৯২৩ সালের ১৬ জানুয়ারী মামলার রায়ে কবির এক বছরের সশ্রম কারাদন্ড হয়। কারাভোগ শেষে ১৯২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর বহরামপুর জেল থেকে তিনি মুক্তি পান। কবিকে সঙ্গে নিয়ে পশ্চিম বাংলায় কমিউনিস্ট আন্দোলন বিকাশ লাভের জন্য কমরেড মুজাফ্ফর আহম্মেদ অগ্রসর হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সময়ে কবি কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হননি। ১৯২৫ তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। ভারতবাসী আর বৃটিশের শাসন মানতে রাজি ছিল না। স্বাধীনতার দাবিতে গোটা ভারতবর্ষ তখন উতপ্ত।
বৃটিশদের বিরুদ্ধে তিনি কবিতা লেখেন ”এ দেশ ছাড়বি কী না বল, নয়লে কিলের চোটে হাড় করিব জল”। কবি ঐ সময়ে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সদস্য হন। তার সতীর্থ ছিলেন হেমন্ত কুমার সরকার, কুতুবউদ্দিন আহম্মেদ ও সামসুদ্দিন হোসাইন। কংগ্রেসের কর্ণধর মহাত্মা গান্ধী স্বরাজ চেয়েছিলেন, আর কবি চেয়েছিলেন পূর্ণ স্বাধীনতা। এ দাবিতে গড়ে ওঠে শ্রমিক স্বরাজ দল। নবগঠিত এ দলের ইস্তেহারে কবি প্রথম স্বাক্ষর করেন। নবগঠিত এ সংগঠনের মুখপাত্র হিসেবে সাপ্তাহিক লাঙ্গল প্রকাশিত হয়। লাঙ্গলের প্রথম সংখ্যায় কবির লেখা ’সাম্যবাদ’ নামে কবিটি ছাপা হয়। ১৯২৩ সালে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সদস্য হন। ১৯২৬ সালে হুগলী ছেড়ে কৃষ্ণনগরে এসে বসবাস শুরু করেন। একই বছরের ৬ ফেব্রুয়ারী কৃষ্ণনগরে নিখিল বঙ্গীয় প্রজা সম্মেলন হয়।
সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নতুন দল বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দল গঠিত হয় এবং কবির রাজনৈতিক সংগঠন শ্রমিক স্বরাজদল নতুন দলের সাথে একীভুত হয়। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে কলকাতার সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে নিখিল ভারত শ্রমিক ও কৃষক পার্টি গঠিত হয়। কবি এ দলের নেতৃত্ব দেন। এ দলের মুখপাত্র ছিল গণবাণী। ১৯২৬ সালের ২২ ও ২৩ মে কৃষ্ণনগরে কংগ্রেসের প্রাদেশিক কাউন্সিল উপলক্ষে কবির রচিত গান ছিল ’দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ ছাত্রদলের সম্মেলনের জন্য গান রচনা করেন “আমরা শক্তি আমরা বল” এবং যুব সম্মেলনে গান ছিল ’চল চল চল উর্দ্ধ গগণে’।
১৯২৬ সালে কেন্দ্রীয় আইনসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৩১ অক্টোবর কবি ঢাকা সফর করেন। স্বরাজ পার্টির মনোনয়নে তিনি ফরিদপুর আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তখন ঢাকার সাথে সম্পৃক্ত ছিল ফরিদপুর। এ আসনে পাচঁজন প্রার্থী ছিলেন। কবি এক হাজার বাষট্টি ভোট পান, জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। রাজনীতিতে সফল না হলেও দেশপ্রেমের জন্য তার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। সাম্যবাদ কবিতা লিখে তিনি বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের সাথে একাত্মতা ঘোষনা করেন। আবু হেনা আব্দুল আওয়াল রচিত নজরুলের রাষ্ট্রচিন্তা গ্রন্থে উল্লেখ করেন, তিনি আঞ্চলিকতা ও সংকীর্ণতার উর্দ্ধে ছিলেন। শ্রমজীবী মানুষের ভাষায় তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। মাটি ও মানুষের সাথে তার সম্পর্ক ছিল নিবিড়। দেশ ও মানুষের মুক্তির সংগ্রামের রণনীতি ছিল তার রাজনৈতিক দর্শন।
(সুত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক কালের কন্ঠ ও সাপ্তাহিক একতা।)