‘আহলান সাহলান, খোশ আমদেদ ইয়া মাহে রমজান’। আর মাত্র একদিন পরই পবিত্র মাহে রমজান। এ বছরও রমজান মাস সাধারণ অন্যান্য বছরের মত নয়। কারণ প্রথম রোজার দিন থেকেই সরকার কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে গত দু’সপ্তাহে রেকর্ড সংখ্যক করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে এবং বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যাও। এরকম পরিস্থিতিতে সরকার সবাইকে ঘরে থাকার আহবান জানাচ্ছেন। যেহেতু একদিকে লকডাউন, অন্যদিকে রমজান ফলে সাধারণ মানুষের কষ্ট কিছুটা বাড়বে বৈ কমবে না। দেশে বিরাট সংখ্যক কর্মজীবী মানুষ দিন আনে দিন খায়। সুতরাং তাদের জন্য এবছর সীমাহীন কষ্টের বছর।
বাংলাদেশে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, রমজান মাস এলেই কিছু সংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ী নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে দেন। সাধারণ মানুষের পকেট কেটে এসব অতি মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা নিজেদের বাক্স ভরেন। ফলে জনদুর্ভোগ চরম মাত্রায় বেড়ে যায়। যেখানে বিশ্বের অন্যান্য দেশে রমজান মাস এলেই পণ্য সামগ্রীর দাম হ্রাস করে দেন, সেখানে আমাদের দেশের চিত্রটা ঠিক উল্টো। ইতিমধ্যে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার পবিত্র মাহে রমজান মাস উপলক্ষে ৬৫০টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমিয়েছে। আর একই সাথে রমজান মাসজুড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কম থাকবে বলে জানিয়েছে দেশটির সরকার। (৭ এপ্রিল, ২০২১ দৈনিক কালের কণ্ঠ)।
ইতোমধ্যে খুচরা বাজারে সব ধরনের ডাল, ভোজ্যতেল, আদা-রসুন-পেঁয়াজ, হলুদ-মরিচ, চিনি-লবণ এমনকি খেঁজুরের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। গরুর মাংস ও মুরগির দামও বেড়েছে। বাড়তি দরে পণ্য কিনতে সাধারণ ভোক্তার নাভিশ্বাস উঠছে। করোনাভাইরাসের কারণে এমনিতেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এরপরও নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে নিম্নআয়ের মানুষের ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে।
রমজান হলো আত্মশুদ্ধির মাস। এ মাসে রোজা রাখার মাধ্যমে সকল ধরনের পাপ থেকে নিজের বিরত রাখার অনুশীলন করা হয়। শারীরিক, মানসিকভাবে মানুষ পরিশীলিত হয়। কিন্তু পবিত্র রমজান মাসকে কেন্দ্র করে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। আর অতি এ মুনাফালোভী সিন্ডিকেট নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। যেটি সাধারণ মানুষের জন্য খুবই কষ্টকর। রমজান মাসে সবাই যাতে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য-দ্রব্য সঠিক দামে ক্রয় করতে পারে এ বিষয়টি ব্যবসায়ীদেরকে খেয়াল রাখা ঈমানী কর্তব্য। রমজানকে উপলক্ষ্য করে নিত্য-প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ানো হলে সেটি চরম অন্যায়। এমনকি বিষয়টি দুর্নীতির সামিল।
ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনেকেই রোজা রাখেন এবং রোজা রাখার যে ফজিলত সেটিও তারা জানেন। কিন্তু সবকিছু জেনে অন্যায়ভাবে পণ্যের দাম বাড়িয়ে অতি মুনাফা লাভ করলে কেয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে কী জবাব দেবেন। যেদিন মানুষের সকল কৃতকর্মের কথা জিজ্ঞাসা করা হবে, সেদিন যারা রমজানকে কেন্দ্রে করে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগে ফেলে মুনাফা লাভ করেছেন তারা কী জবাব দিবেন? সুতরাং আমাদের সব-সময় খেয়াল রাখতে হবে জীবন ধারনের জন্য যা করছি সেখানে কতটুকু হালাল। ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল এবং সুদকে হারাম করেছেন।’ (সূরা বাকারা : ২৭৫)। অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না, শুধু তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয়, তা বৈধ।’ (সূরা নিসা ২৯)।
রমজান মাস বছরের অন্য এগারো মাসের চেয়ে অধিক মর্যাদাশীল ও বরকতময়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘রমজান মাসই হলো সে মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়াত।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৫)। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যখন রমজানের আগমন হয় তখন জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তানদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়।’ (বোখারি, হাদিস : ১৮৯৯)
অন্য হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক ইফতারের সময় অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে থাকেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২১৬৯৮)। আরেক হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান পেল অথচ নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারেনি, সে হতভাগা।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৯০৮)।
আসুন রমজান মাসকে কেন্দ্র করে আমরা অতি মুনাফা লাভের মানসিকতা বর্জন করি এবং সবাই যাতে নিজেদের সাধ্যমত নিত্য পণ্য-দ্রব্য ক্রয় করতে পারে তার ব্যবস্থা করি। আর সরকার যেন দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে জনজীবনের চলমান সমস্যাগুলো সহনীয় করে তুলবে, যাতে অন্তত রমজান মাসটা মানুষ একটু স্বস্তিতে কাটাতে পারে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ উচিত বাজারে পণ্যের মূল্যতালিকা তদারকিমূলক অভিযান চালানো। আইনশৃঙখলা রক্ষাকারী আরো কঠোর নজরদারি চালানো। এছাড়া টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রিও সঠিকভাবে মনিটরিং করতে হবে।
এছাড়াও আমরা সমাজে নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রত্যেকেই রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় সচেষ্ট হব, রোজাদারদের সহযোগিতা করবো শ্রমজীবী মানুষ যাতে অন্তত বাড়তি কষ্ট না পায় সে বিষয়টি খেয়াল রাখা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। রমজান মাস হেদায়েতপ্রাপ্তির মাস, গুনাহ মাফের ও ক্ষমা অর্জনের মাস। আল্লাহতায়ালার রহমত ও বরকত লাভের মাস এবং জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার মাস। সুতরাং এ মাসে অধিক ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করা এবং তাওবা-ইস্তেগফারের মাধ্যমে ক্ষমা অর্জন লাভে সচেষ্ট হওয়া সবার কর্তব্য। পবিত্র রমজান মাসকে সাদর সম্ভাষণ। সবাইকে রমজানের শুভেচ্ছা।
(লেখক : সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)
খুলনা গেজেট/ টি আই