খুলনা, বাংলাদেশ | ৪ আশ্বিন, ১৪৩১ | ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে ২৪ ঘণ্টায় ৩ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৮৮৭
  ঢাবির হলে পিটিয়ে যুবককে হত্যা: ছাত্রলীগ নেতাসহ আটক ৩, তদন্ত কমিটি গঠন
  বেক্সিমকো গ্রুপের সব সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রিসিভার নিয়োগ দিতে পূর্ণাঙ্গ রায়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট

রজব মাসের আমল ও কিছু ভ্রান্তির মূলোৎপাটন

মাওলানা জুবায়ের হাসান

এখন চলছে আরবী রজব মাস। আল্লাহ তাআলা বারো মাসের মধ্যে চারটি মাসকে ‘আশহুরে হুরুম’ তথা সম্মানিত ঘোষণা করেছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারোটি আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টির দিন থেকে। সুতরাং তোমরা এই মাসসমূহে নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।’ -সূরা তাওবা : ৩৪

এই চারটি সম্মানিত মাসের একটি হল রজব। রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেছেন, বারো মাসে বছর। তার মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি ধারাবাহিক : যিলকদ, যিলহজ্ব, মহররম আর চতুর্থটি হল রজব, যা জুমাদাল উখরা  ও শাবান মাসের মধ্যবর্তী মাস।’ -সহীহ বুখারী ২/৬৭২

উলামায়ে কেরাম বলেছেন, আশহুরে হুরুমের এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, এসব মাসে ইবাদতের প্রতি যত্নবান হলে বাকি মাসগুলোতে ইবাদতের তাওফীক হয়। আর আশহুরে হুরুমে কষ্ট করে গুনাহ থেকে বিরত থাকতে পারলে অন্যান্য মাসেও গুনাহ পরিহার করা সহজ হয়। -আহকামুল কুরআন, জাসসাস ৩/১১১

তাই আশহুরে হুরুমের অন্তর্গত রজব মাসের মর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট হওয়া উচিত। তবে স্মরণ রাখা উচিত যে, শরীয়তের পক্ষ থেকে এ মাসের জন্য বিশেষ কোনো নামায, বিশেষ কোনো রোযা বা বিশেষ পদ্ধতির কোনো আমলের হুকুম দেওয়া হয়নি। তাই বাজারের অনির্ভরযোগ্য বই-পুস্তকে রজব মাস উপলক্ষে বিশেষ নামায ও রোযার যেসব কথা পাওয়া যায় তা সবই ভিত্তিহীন। এ ধরনের মনগড়া আমল দ্বারা এ মাসের ফযীলত লাভ করা সম্ভব নয়। রজব মাসের বরকত ও ফযীলত হাসিল করার জন্য অন্যান্য মাসে পালনীয় ফরয ইবাদতগুলো যথাযথভাবে পালন করতে হবে এবং নফল ইবাদত বেশি বেশি করতে হবে।

এ মাসের গুরুত্বপূর্ণ আমল

পুরো মাসটির ব্যাপারে হুযুর ﷺ থেকে বিশুদ্ধ সনদের মাধ্যমে যা জানা যায়, তা হচ্ছে, যখন তিনি রজবের চাঁদ দেখতেন, তখন এই দুআ পড়তেন

اللهم بارك لنا في رجب و شعبان و بلغنا رمضان

হে আল্লাহ! আমাদেরকে রজব ও শাবান মাসে বরকত দান করুন আর রামাজান পর্যন্ত পৌছিয়ে দিন।

অর্থাৎ- আমাদের হায়াত এতটুকু বৃদ্ধি করুন, যেন আমরা রমজান পেয়ে যাই। কেন যেন প্রথম থেকে পবিত্র রমজান আগমনের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হচ্ছে। দু’আটি হুযুর ﷺ থেকে বিশুদ্ধ সনদের মাধ্যমে প্রমাণিত, তাই দু’আটি করা সুন্নাত। এ দু’আ ব্যতীত অন্য যে সকল কুসংস্কার মানুষের মাঝে প্রসিদ্ধ তার কোনো মূল বা ভিত্তি নেই।

শবে-মিরাজ নির্ধারণে মতবিরোধ

সর্বপ্রথম কথা হলো, ২৭শে রজবের ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে এ কথা বলা যায় না যে, এ রাতেই নবীজী ﷺ মি’রাজে তাশরীফ নিয়েছিলেন। কারণ, এ ব্যাপারে বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে। কোনো কোনো বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায়, হুযুর ﷺ মি’রাজে রবিউল আউয়াল মাসে গিয়েছেন। কোনো কোনো বর্ণনায় রজব মাসের কথাও উল্লেখ রয়েছে। কোনো কোনো বর্ণনায় অন্য মাসের কথাও বলা হয়েছে। তাই পুরোপুরি নিশ্চয়তার সাথে বলা যায় না যে, কোন রাতটি সঠিক অর্থে মি’রাজের রাত ছিল।

মনে করুন এ কথা যদি মেনে নেওয়া হয় যে, হুযুর ﷺ ২৭ রজব মি’রাজে তাশরীফ নিয়েছেন, তাহলে যে রাতে এ আযীমুশ্বান ঘটনা ঘটেছে, যে রাথে আল্লাহ তায়ালা নবী করীম ﷺ কে তার নৈকট্যের মর্যাদা দান করেছেন এবং নিজ দরবারে হাজিরা দেয়ার সম্মান দিয়েছেন এবং উম্মতের জন্যে নামাজের তোহফা পাঠিয়েছেন, সে রাত অবশ্যই সম্মানিত বটে! তার মর্যাদার ব্যাপারে কোনো মুসলমানের সন্দেহ থাকতে পারে না।

নবীজী ﷺ এর জীবনে আঠারবার শবে মি’রাজ এসেছিল। কিন্তু মি’রাজের ঘটনাটি নবুওয়তের পঞ্চম বছরে সংঘটিত হয়েছিল। অর্থাৎ মিরাজের ঘটনার পর আরো ১৮ (আঠার) বছর পর্যন্ত হুযুর ﷺ জীবিত ছিলেন। এই আঠার বছরে কোথাও একথা প্রমাণিত নেই যে, তিনি শবে মি’রাজের ব্যাপারে বিশেষ কোনো নির্দেশ দিয়েছেন। কিংবা তা উদযাপনের প্রতি বিশেষ কোনো গুরুত্বারোপ করেছেন। অথবা বলেছেন, এ রাতে শবে-কদরের ন্যায় জাগ্রত থাকা সওয়াবের কাজ। তার জামানায়ও এ রাতে জাগরণের কথা বিশেষভাবে পাওয়া যায় না। এ রাতে বিশেষভাবে তিনি নিজেও জাগ্রত থাকেননি, সাহাবায়ে কেরামকেও তাগিদ দেননি। আর সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কেউই জাগ্রত থাকেননি। রসূলুল্লাহ ﷺ এর ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কেরাম এই পৃথিবীতে আরো ১০০ (একশত) বছর বিদ্যমান ছিলেন। এই পুরো শতাব্দীতে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ২৭ রজবকে বিশেষ কোন মর্যাদা বা গুরুত্ব দিয়েছেন বলে একটি ঘটনাও প্রমাণিত নেই।

এ রাতে এবাদতের গুরুত্ব দেয়া বিদ’আত

অতএব, এ রাতে ইবাদতের জন্য বিশেষ গুরুত্ব দেয়া বিদ’আত। এমনিতে আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক রাতে যতটুকু ইবাদত করার তাওফীক দান করেন, তা অবশ্যই উত্তম। আজকের রাতেও জাগ্রত থাকুন, কালকের রাতেও থাকুন, এভাবে ২৭শে রজব রাতেও জাগ্রত থাকুন। উভয়ের মাঝে কোনো পার্থক্য বা বাহ্যিক ব্যবধান না থাকাই উচিত।

২৭শে রজবের রোজা ভিত্তিহীন

এমনিভাবে কোনো কোনো লোক ২৭শে রজবের রোজাকেও ফযীলতময় মনে করে। তাদের ধারণা, আশুরা ও আরাফার রোজা যেমনিভাবে ফযীলতময়, তেমনি ২৭শে রজবের রোজাও ফযীলতময়। মূলতঃ এক-দুটি দুর্বল বর্ণনা এ ব্যাপারে পাওয়া যায় বটে, তবে বিশুদ্ধ সনদের মাধ্যমে কোনো বর্ণনা প্রমাণিত নেই।

রজব মাসের বিশেষ নামায ভিত্তিহীন

একটি বইয়ে লেখা হয়েছে- রজব মাসের প্রথম তারিখে মাগরিবের নামায ও ইশার নামাযের মাঝখানে বিশ রাকাত নফল নামায পড়বে। প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ইখলাস ৩ বার, সূরা কাফিরূন ৩ বার পড়বে। তাহলে আল্লাহ পাক হাশরের দিন তাকে শহীদের দলের সহিত উঠাবেন এবং আল্লাহ পাকের নিকট সে বড় আবেদ বলে গণ্য হবে।

আরো লেখা হয়েছে যে, রজব মাসের প্রত্যেক জুমার দিন জুমার পর আসরের নামাযের আগে চার রাকাত নামায এক সালামে পড়বে। প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতিহার পর ৭ বার আয়াতুল কুরসি ও পাঁচবার সূরা ইখলাস পড়বে…। এগুলো সবই ভিত্তিহীন।

হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. বলেন-

لم يرد في فضل شهر رجب، ولا في صيامه، ولا في صيام شيء منه معين، ولا في قيام ليلة مخصوصة فيه حديث صحيح يصلح للحجة

রজব মাসের ফযীলত

রজব মাসে রোযা রাখার ফযীলত বা রজব মাসের নির্দিষ্ট কোনো দিন রোযা রাখার ফযীলত অথবা রজব মাসের নির্দিষ্ট কোনো রাতে নামায-ইবাদত করার ফযীলত সম্পর্কে প্রমাণ হওয়ার উপযুক্ত কোনো হাদীস নেই। -তাবয়ীনুল আজাব বিমা ওয়ারাদা ফী শাহরি রাজাব, পৃ. ১১

উপসংহার

মাহে রজব মাহে রামাজানের পূর্বাভাষ। তাই রামাজান আসার আগ থেকেই রোজা পালনের প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। এজন্য রাসূলুল্লাহ ﷺ তিন মাস পূর্ব হতেই দু’আ করতেন এবং মুসলমানদেরকে এদিকে মনোযোগী করতেন যে, এখন থেকেই সে পবিত্র মাসটির জন্য নিজেকে প্রস্তুত কর। সাথে সাথে স্বীয় সময়সূচি এমনভাবে তৈরি করার চিন্তা-ভাবনা কর, যাতে এ মুবারক মাস এলে (দিন ও রাতের) অধিকাংশ সময় আল্লাহর ইবাদাতে ব্যয় হয়। আল্লাহ তা’আলা নিজ দয়ায় আমাদেরকে সঠিক পথ দান করে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

(লেখক : ইমাম ও খতিব, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়)

 

খুলনা গেজেট/এমএইচবি

 




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!