এক সময়ের ঢাকার আবহানী ক্লাবের মাঠ কাঁপানো এবং দেশের নামকরা পেশাদার ফুটবলার, সাবেক জাতীয় দলের আক্রমণভাগের খেলোয়ার শেখ মোহাম্মদ আসলাম। খুলনার বিখ্যাত হাজী বাড়ির কৃতি সন্তান। যিনি খেলাধুলা থেকে অবসর নিয়েছেন অনেক আগেই। অভিমানে নিজেকে দূরে রেখেছেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন থেকে। নিজের ব্যবসা বাণিজ্য নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করেন পরিবার নিয়ে বসবাস করেন ঢাকাতেই।
এক সময়ে খুলনার ক্রীড়া জগতের সুখ্যাতি এবং বর্তমান খুলনার ক্রীড়া জগতের দৈন্যদশা নিয়ে খুলনা গেজেটের এ প্রতিবেদকের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় শেখ মোহাম্মদ আসলাম বলেন, ছোটবেলায় আমার বাবা এবং চাচাদের হাত ধরেই আমার খুলনা স্টেডিয়ামে আগমন। তখন দেখেছি স্টেডিয়ামে সেই যে দর্শকদের উপচেপড়া ভিড়। মানুষ যে ফুটবলকে কত ভালোবাসতো! শুধু ফুটবল নয়, এ্যাথলেটিক্স, ভারোত্তোলোনসহ বিভিন্ন ইভেন্টে ক্রীড়া জগতে খুলনার একটা ঐতিহ্য এবং বিরাট একটা সুখ্যাতি ছিলো। এ্যাথলেট বলেন, ভারোত্তোলন বলেন, ১০০ মিটার স্প্রিন্ট বলেন, ফুটবল বলেন, ক্রিকেট বলেন, প্রতিটা স্তরে আমাদের খুলনার কৃতি খেলোয়াড়দের পদচারণা ছিলো। আমি আমাদের যারা অগ্রজ, যারা অনুজ সবাইকে স্যালুট করি যে খুলনাকে আমরা জাতীয় পর্যায়ে একটা অবস্থান করে দিতে পেরেছিলাম। এখন সেই জায়গাটা আমার কাছে মনে হয় টোটালি নেই। বর্তমানে খুলনায় কোন খেলাধুলা নেই বললেই চলে।
এই যুব সমাজের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও আজকে যারা বিভিন্ন অর্গানাইজেশনের সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলবো এই যুবসমাজকে সুন্দর পথ দেখানোর জন্য হলেও খুলনার ক্রীড়াঙ্গনকে আবার সচল করা দরকার। যাতে করে তারা অবাধে খেলাধুলা, ফুটবল খেলে সমাজকে সুন্দর জায়গায় নিয়ে যেতে পারে। আমার জীবদ্দশায় জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে বুকে ধারণ করে বাংলাদেশের অধিনায়কত্ব করেছি। এই খুলনা অঞ্চল থেকে খেলে আমরা জাতীয় পর্যায়ে স্থান করে নিয়েছি।
বর্তমান খুলনার খেলোয়ারদের প্রতি আমার আহ্বান আমাদের যারা অনুজ, যারা ফুটবল খেলছে কিংবা অ্যাথলেটিক্সে আছেন সবাই আমাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে খুলনার পতাকা যাতে আরো উপরের দিকে উঠতে পারে সেই দিকে ধ্যান-ধারণা রেখে অনুশীলন করবে এবং যুব সমাজকে যুবশক্তিতে পরিণত করবেন। খুলনার যুব সমাজের কাছে সেই প্রত্যাশায় ব্যক্ত করি।
খুলনার ক্রীড়া জগতের দৈন্যদশা সম্পর্কে তিনি বলেন, খুলনায় খেলাধুলার এই দৈন্যদশার কারণ আমি একটাই বলবো যোগ্য জায়গায় যোগ্য লোককে বসাতে হবে। যোগ্য চেয়ারে যদি যোগ্য লোক না বসে তাহলে চেয়ারটাকে নষ্ট করে দিয়ে, সমাজটাকে নষ্ট করে দিয়ে তারা চলে যাবে। যেটা হচ্ছে বর্তমানে খুলনায়। এটা আমি আসু পরিবর্তন চাই। ক্রীড়াঙ্গনের সাথে যারা জড়িত তারা এ বিষয়টা নিয়ে কিছুটা হলেও চিন্তা করবেন। আমাদের যুব সমাজকে একটা যুবশক্তিতে পরিণত করার চেষ্টা করবো। এটাই আমাদের মটো (মূলমন্ত্র) হওয়া উচিত।
খুলনা স্টেডিয়ামকে সচল করার জন্য আমি বলবো, যারা ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে জড়িত উনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেই বলবো, আশা করি উনারা চেষ্টা করলেই আমাদের বিভাগীয় স্টেডিয়ামটা আরো সচল হবে এবং নতুন ভাবে জেগে উঠবে। এক্ষেত্রে আমার যদি কোন সহযোগিতা লাগে আমি পাশে থেকে সাহায্য করতে পারলে নিজেকে খুব ধন্য মনে করবো। এই অঞ্চলের সন্তান হিসেবে আমি আমার খুলনাকে সামনের দিকে আরো এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করবো।
নিজের পরিবারের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, সত্যি কথা বলতে কি আমার পরিবার ছিলো একটা ক্রীড়া পরিবার। খুলনায় আমাদের যে গোবরচাকা পল্লীমঙ্গল স্কুলের মাঠ। তখন ওখানে না গেলে আমাদের পেটের ভাত হজম হতো না। প্রতিদিন বিকেল বেলা ওখানে যেতেই হবে। তখন আজেবাজে আড্ডা থেকে সব সময় ওই মাঠটা আমাদেরকে ফিরিয়ে রেখেছে। এজন্য আমি বলবো খেলাধুলার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য মাঠের দরকার।
সেই জায়গায় আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সারা বাংলাদেশের প্রতিটা উপজেলায় ১টি করে শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম তৈরি করছেন। এজন্য আমি উনাকে স্যালুট করি এ্যাজ এ ফুটবলার হিসেবে। উনি উনার ভাইয়ের মতো ক্রীড়াপ্রেমী এবং উনাদের পরিবার একটি ক্রীড়া শৈলী পরিবার। এই ক্রীড়া পরিবারকে আমরা কিভাবে ধন্যবাদ জানাবো আমাদের জানা নেই। আমরা উনাকে কিছু দিতে পারছি না এটাই আমাদের ব্যর্থতা।
নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এবং সাফল্য সম্পর্কে শেখ আসলাম বলেন, ফুটবলে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব যে আমি বাংলাদেশ জাতীয় দলকে আমাদের দেশে একবার প্রেসিডেন্ট কাপে বিজয়ী করেছি। দেশকে একবার হলেও আমরা বাংলাদেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলাম। এটাই আমার জীবনের বড় সাফল্য বলে মনে করি।
জাতীয় দলের সাবেক কৃতি ফুটবলার শেখ মোহাম্মদ আসলামের জন্ম ১৯৫৮ সালের ১ মার্চ খুলনার বিখ্যাত হাজী পরিবারে। শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে খুলনাতে।
১৯৭৪ সালে খুলনা দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে টাউন ক্লাবের হয়ে খেলার মাধ্যমে পেশাদার ফুটবলে তার যাত্রা শুরু হয়। খেলেছেন বাংলাদেশ ওয়াপদায়। আবাহনী ক্রীড়া চক্রের হয়ে খেলার সময় তিনি সারাদেশে ব্যাপক সুখ্যাতি অর্জন করেন।
‘৮০ এবং ‘৯০ দশকে ঢাকা ঘরোয়া লীগের সবচেয়ে মারাত্মক মার্কসম্যান খেলোয়াড় ছিলেন ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি দীর্ঘাদেহী শেখ মোহাম্মদ আসলাম । ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ফুটবলে তিনি ৩০০ এর বেশি গোল করেছেন। ঢাকা লীগে ১১৭ গোল করার সাথে তিনি বাংলাদেশী টপ ফ্লাইট ফুটবলে সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা। ক্লাব এবং দেশের হয়ে ৩৮ টি আন্তর্জাতিক গোল করেছেন। এছাড়াও শেখ মোহাম্মদ আসলাম দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সময় বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে ১৪ টি অফিসিয়াল আন্তর্জাতিক গোল করেছেন।
১৯৮৪, ১৯৮৫ এবং ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার গৌরব অর্জন করেছেন।
খুলনা গেজেট/এইচ