খুলনা, বাংলাদেশ | ১১ পৌষ, ১৪৩১ | ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন, নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট
  চাঁদপুরে জাহাজে ৭ জনকে হত্যা: আসামি ইরফান ৭ দিনের রিমান্ডে

‘যোগাযোগে পরিবর্তনের পাশাপাশি নিরসন হবে আঞ্চলিক বৈষম্য’

এম. এ. মান্নান বাবলু

বাংলাদেশের স্বপ্ন আর গর্বের অপর নাম পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু গোটা জাতি বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জন্য যেন এক স্বর্গীয় আশীর্বাদ। এই সেতু জাতির আত্মমর্যাদার প্রশ্নেও গুরুত্ববহ। এ যেন লক্ষ কোটি হৃদয়ের মুক্তির পথ। বাঙালী বিজয়ের জাতি। নিজস্ব অর্থায়নে বহুল আকাঙ্খিত পদ্মা সেতু নির্মান মাতৃভূমির স্বাধীনতার পর আরেকটি ঐতিহাসিক বিজয়। পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন জাতির আত্মবিশ^াস যেমনি বাড়িয়েছে তেমনি এর অপার সম্ভাবনা দেশবাসীকে আনন্দে উদ্বেলিত করেছে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর অদম্য সাহসী কন্যা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার দুর্দমনীয় নেতৃত্ব আর ঐকান্তিক ইচ্ছায় পদ্মা সেতুর সফল বাস্তবায়ন। স্বপ্নের পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষের জন্য মাননীয় প্রধান মন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার শ্রেষ্ঠ উপহার।

এইতো মাত্র কয়েক বছর আগে প্রমত্তা পদ্মার বুকে যে স্বপ্নের যাত্রা শুরু হয়েছিল তা এখন বাস্তব। এই সেতুর সফল বাস্তবায়নে উন্নয়নের মহাসড়কে নাম লেখানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পথে দূর্বার গতিতে এগিয়ে যাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনপদ। তাইতো এখন আনন্দের ঢেউ বইছে গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল জুড়ে। যেন শত বছরের প্রতীক্ষার ফল প্রাপ্তি। রাজনৈতিক অবস্থান আর দল-মত এর উর্ধ্বে এসে প্রায় সবাই-ই খুশি পদ্মা সেতুর সাফল্যে।

আমাদের চির চেনা পদ্মা নদীর মাওয়া-কাঁঠালবাড়ী ঘাট- ফেরী, লঞ্চ ও স্পীডবোটে পাড়াপাড়ের বিগত দিনের অনেক অভিজ্ঞতা স্মৃতিতে অম্লান হয়ে থাকবে। গল্প হয়ে থাকবে পদ্মা পাড়াপাড়ের সুখ. দুঃখ বেদনা আর তিক্ত অভিজ্ঞতার কত্তসব কাহিনী। আমরা বলবো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঐতো ওখান দিয়েই আমরা পার হতাম প্রমত্তা পদ্মা নদী। যা নতুন প্রজন্মের কাছে হয়তোবা রূপকথার গল্পের মতই মনে হবে।

প্রায়শঃই মঙ্গায় পতিত উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থার যেমন আমুল পরিবর্তন এনেছে বঙ্গবন্ধু সেতু তেমনি পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ পুরো দেশের অর্থনীতির সার্বিক চিত্র বদলে দেবে। গাড়ীর চাকার সাথে সাথে ঘুরবে অর্থনীতির চাকাও। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সাথে সমগ্র দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে। নিরসন হবে অনেক আঞ্চলিক বৈষম্যও। দেশের অধিকাংশ উন্নয়ন কর্মকা- রাজধানী ঢাকা থেকে পরিচালিত হয়। কিন্তু এ উন্নয়নের সুবিধাগুলো দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছাতে পদ্মা একটি বড় বাঁধা ছিলো। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় ৬ কোটি অধিবাসী পদ্মা সেতুর প্রাথমিক উপকারভোগী। সেতুটি নির্মিত হওয়ায় এই এলাকার লোকজনের ঢাকাসহ সমগ্র দেশে যাতায়াত সহজ হবে-যেটা তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসায় ও প্রযুক্তিসহ সার্বিক উন্নয়নে প্রভাব ফেলবে। এছাড়াও দক্ষিণের জেলাসমুহ থেকে নদীপথে লঞ্চে বা রকেটে রাজধানী ঢাকায় যাওয়ার বহুবিধ প্রতিকূলতাও এই সেতুর সফল বাস্তবায়নে নিরসন হতে চলছে।

এই সেতুর সাথে রেল লাইন সংযুক্ত থাকায় টেলিযোগাযোগ. বিদ্যুৎ ব্যবস্থা এবং প্রাকৃতিক গ্যাস পরিবহনের ক্ষেত্রেও সেতুটি প্রধান ভূমিকা পালন করবে। এই সেতুর ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ব্যবসায়-বাণিজ্যের ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন হবে-যা জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। একইসাথে এই এলাকার জমির মান. দাম এবং উপযোগিতাও বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।

যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে একটি অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকা- আবর্তিত হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা একটি দেশ বা অঞ্চলের উন্নয়নের হাতিয়ার। পদ্মা সেতু এ ক্ষেত্রে অর্থনীতির ভিত্তি ও সোনালী সোপান হিসেবে কাজ করবে। এর ফলে বাড়বে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবন যাত্রার মান ও কর্মসংস্থান। এ সেতু নির্মানের সুফল হিসেবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অন্যতম প্রধান উৎপাদন কেন্দ্রে পরিনত হবে এবং কোটিরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে- যা দেশের অর্থনীতির জন্য বয়ে আনবে সুসংবাদ। এতদাঞ্চলের কৃষি পণ্যের বাজার হবে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চল।

এই সেতুর ফলে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে যুক্ত হবে মংলা ও পায়রা বন্দর। বেনাপোল স্থল বন্দরের সঙ্গেও রাজধানী এবং চট্টগ্রাম বন্দরের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় ৬ কোটি মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন আনবে পদ্মা সেতু। এই সেতু হওয়ায় এ অঞ্চলে শিল্পপতি, উদ্যোক্তারা শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলতে উৎসাহী হবে। এ অঞ্চলে তৈরি হবে বিশ^ মানের হাসপাতাল, হোটেল, মোটেল আরও কত কি! দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কর্ম প্রত্যাশী মানুষের মধ্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেলে ব্যাস্টিক অর্থনীতিতে যেমন ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তেমনি সমষ্টিক অর্থনীতির গতি প্রবাহেও নতুন দিগন্তের দ্বার উম্মোচন হবে।

এই সেতুর ফলে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ও সুন্দরবন পর্যটন কেন্দ্রের অভাবনীয় উন্নয়ন হবে। পর্যটকদের যাতায়াত সুবিধা হবে। এই সেতুকে ঘিরে পর্যটনের হবে নতুন মাত্রা। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন চর ও দ্বীপকে কেন্দ্র করে মালদ্বীপের মত পর্যটনের বিশাল জগত তৈরি করা সম্ভব। এই সেতুর ফলে রাজধানী থেকে কক্সবাজারের চেয়ে কম সময়ে কুয়াকাটা ও সুন্দরবন পৌঁছানো যাবে। এই সেতুকে ঘিরে পদ্মার দুই পাড়ে সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই নগরের আদলে আধুনিক শহর গড়ে তোলাও অসম্ভব নয়।

পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নে দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হলো নতুন সোনালী স্বপ্ন। অর্থনীতিতে পদ্মা সেতুর ভূমিকা নিয়ে বিশ^ ব্যাংক অভিমত জানিয়েছে, সেতুটি বাস্তবায়নে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে যাবে। আর প্রতি বছর দারিদ্র নিরসন হবে শূন্য দশমিক ৮৪ ভাগ। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনোমিক মডেলিং এর পরিচালক ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ সেলিম রহমানের মতে সেতুটি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়াবে। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ ড. মঈনুল ইসলাম বলেন-‘পদ্মা সেতু শুধু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অপেক্ষাকৃত বঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে রাজধানী ঢাকা এবং চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক লাইফ লাইনের সঙ্গে সংযুক্ত করবে না, এটা পুরো অর্থনীতিকে আক্ষরিক অর্থে একসূত্রে গাঁথার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম এবং অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে।’

সর্বোপরি স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত এবং বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু। মাননীয় প্রধান মন্ত্রী ঘোষিত ২০৪১ সালে বাংলাদেশ যে উন্নত দেশ হবে সে ক্ষেত্রে এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। স্বপ্নের এই সেতুকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং দুই পাড়ের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন।

(লেখক : সাধারণ সম্পাদক, সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন, খুলনা মহানগর শাখা, খুলনা)




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!