মানুষ ভালো মন্দ যে যাই করুক, পরকালে তার প্রতিদান দেয়া হবে। যত সামান্য নেকীর কাজ হোক, আর যত ছোট পাপ হোক কেয়ামতের দিন বান্দার সামনে আল্লাহ তা’আলা সব হাজির করবেন। কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে وَنَضَعُ الْمَوَازِينَ الْقِسْطَ لِيوْمِ الْقِيَامَةِ فَلَا تُظْلَمُ نفْسٌ شَيئًا وَإِنْ كَانَ مِثقَالَ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ أَتينَا بِهَا وَكَفَى بِنَا حَاسِبِينَ – আর কিয়ামতের দিন আমি ন্যায়বিচারের মানদন্ড স্থাপন করব। সুতরাং কারো প্রতি কোন অবিচার করা হবে না। কারো কর্ম যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আমি তা হাজির করব। আর হিসাব গ্রহণকারীরূপে আমিই যথেষ্ট । সুরা আম্বিয়া ৪৭।
শুধু করণীয় গুলো পালন করা পূর্ণঙ্গ ইসলাম না। বর্জনীয় গুলো বর্জন করাও ইসলামের নির্দেশ। শুধু পালনীয়গুলো পালন করা মুক্তির জন্য যথেষ্ট না, নিষিদ্ধ বিষয় থেকে বিরত থাকাও অতীব জরুরী।
নিষিদ্ধ আর পাপ কাজের মধ্যে এমন কিছু গুনাহ বা পাপ আছে, যে জন্য পরকালের শাস্তি তো বরাদ্দ আছেই, তার একটা অংশ ইহজগতেই প্রাপ্ত হয়। তেমন কয়েকটি নিন্মে বর্ণিত হলো-
১. পিতা-মাতার অবাধ্যতা
কুরআনের অসংখ্য জায়গায় আল্লাহ তা’আলা পিতা-মাতার সাথে ভাল ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং অবাধ্য হতে নিষেধ করেছেন। পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, তাদের সাথে দূর্বব্যহার করা এমন এক পাপ, যার শাস্তি আল্লাহ তা’আলা মৃত্যুর পূর্বে দুনিয়া থেকেই শুরু করে দেন। হযরত আনাস রা. বর্ণনা করেন, রসুল স. বলেছেন – وَبَابَانِ مُعَجَّلَانِ عُقُوبَتُهُمَا فِي الدُّنْيَا الْبَغْيُ وَالْعُقُوقُ এমন দুটি অপরাধ আছে যার শাস্তি ত্বরান্বিত হয়ে দুনিয়া থেকেই শুরু হয়ে যায় ১. পিতা-মাতার অবাধ্যতা ২. জুলুম। মুস্তাদরাকে হাকেম ৭৩৫০।
২. আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট করা
হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, রসুল স. বলেছেন, যে ব্যক্তি চায় তার রিযিক প্রশস্ত হোক এবং আয়ু বৃদ্ধি হোক, সে যেন তার আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখে। বুখারী ৫৯৮৬ । কালামে পাকে ইরশাদ হচ্ছে-“وَآتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ” নিকটাত্মীয়ের অধিকার রক্ষা কর। বনি ইসরাইল ২৬। আর আত্মীয়দের সাথে সু সম্পর্ক বজায় রাখা, এটা আত্মীয়দের অধিকার। যদি কেউ এই সম্পর্ক নষ্ট করে তাহলে তার শাস্তির একটি অংশ সে দুনিয়াতেই পেয়ে যাবে। রসুল স. বলেন- দুটি অপরাধ যে করে আল্লাহ তা’আলা তাকে দুনিয়াতে অতি দ্রুত শাস্তি দেন, সাথে সাথে পরকালের শাস্তিও তার জন্য জমা রাখেন। সে পাপ হলো ‘জুলুম’ ও ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট করা’। আবু দাউদ ৪৯০২। অনলাইনে ডিজিটাল বন্ধুকে সময় দিতে গিয়ে আজ আমরা প্রকৃত সম্পর্কটা ভুলতে বসেছি। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করেন।
৩. জুলুম বা অত্যাচার
জুলুম-অত্যাচার এমন এক অপরাধ যা করে কখনো পার পওয়া যায় না। দুনিয়ার জীবনে তার শাস্তি শুরু হয়ে যায়। আর পরকালে জুলুম ভয়ভহ রুপ ধারণ করবে। হযরত যাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত রসুল স. বলেছেন اتقوا الظلم، فإن الظلم ظلمات يوم القيامة، জুলুম কে ভয় কর, জুলুম থেকে বেচে থাক, কেননা জুলুম কেয়ামতের দিন নানাবিধ অন্ধকার নিয়ে হাজির হবে। মুসলিম ২৫৭৮।
ফিরআউন, নমরুদ, আবু জেহেল, আবু লাহাব সহ যারা দুনিয়াতে জুলুম করেছে আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে লাঞ্চিত করে দুনিয়া থেকে নিয়েছেন। আমাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য। জুলুম, অবিচার, অত্যাচার, লুণ্ঠন, দুঃশাসন, অপশাসন, জবরদখল সহ বিভিন্নভাবে যারা মানুষকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে দুনিয়াতেই শাস্তি দেন, চাই সে শাস্তি আমরা দেখি বা না দেখি। আর আখেরাতের শাস্তি তো আছেই। আদাবুল মুফরাদ ৫৯১।
৪. মুসলমানের ইজ্জত নষ্ট করা
আল্লাহ তা’আলা মুমিনদেরকে লক্ষ্য করে বলেন- “হে ঈমানদারগণ, কোন পুরুষ যেন অপর কোন পুরুষকে উপহাস না করে, কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারী থেকে উত্তম হতে পারে। কোন নারী ওপর নারীকে যেন উপহাস না করে, কেননা যাকে উপহাস করা হয়, উপহাসকারিণী অপেক্ষা সে উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করোনা”। সুরা হুজুরাত ১১।
কোন মুসলমানের জান, মাল, ইজ্জত-আবরু নষ্ট করা অপর মুসলমানের জন্য হারাম। বুখারী। যদি কোন মুসলামন আরেক মুসলমানকে হেয় ও তুচ্ছ করে, অপমান আর লাঞ্চিত করে, দুনিয়ার জীবনে তার শাস্তির অংশ হিসেবে আল্লাহ তা’আলা তাকে অতিসত্তর এমন স্থানে লাঞ্চিত করবেন, যেখানে তার সাহায্যের দরকার ছিল। রসুল স. বলেন- مَا مِنَ امْرِئٍ يَخْذُلُ امْرَأً مُسْلِمًا فِي مَوْضِعٍ تنتهَكُ فِيهِ حُرْمَتُهُ وَينتقَصُ فِيهِ مِنْ عِرْضِهِ، إِلَّا خَذَلَهُ اللَّهُ فِي مَوْطِنٍ يُحِبُّ فِيهِ نُصْرَتَهُ যে ব্যক্তি কোন মুসলামনকে এমন স্থানে অপদস্থ করে যেখানে তার ইজ্জত নষ্ট হয়, তার সম্মান হানী হয়, তাবে আল্লাহ তা’আলা তাকে এমন স্থানে অপদস্থ করবেন যেখানে সে সাহায্যের মুখাপেক্ষী হবে। আবু দাউদ ৪৮০৬ ইফা:।
৫. রিয়া বা লোক দেখানো আমল করা
যে নেকীর কাজ বা ভাল আমল লোক দেখানোর জন্য করা হয়, তার সওয়াব নষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহ তা’আলা বলেন- “ “যে ব্যক্তি সম্পদ ব্যয় করে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে আল্লাহ এবং শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস করে না, তার দৃষ্টান্ত এমন একটি মসৃণ পাথর, যার উপর ধুলা বা মাটি রয়েছে। অতপর তাতে প্রবল বৃষ্টি পড়লো, ফলে তা একেবারে পরিষ্কার করে ফেললো”।সুরা বাক্বারা ২৬৪। অর্থাৎ কোন সওয়াব আর বাকি থাকলো না।
এছাড়াও লোক দেখানো আমল করা মুনাফিকের আলামত। কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে- “নিশ্চয় মুনাফিকরা আল্লাহকে ধোঁকা দেয়। আর তিনি তাদেরকে ধোঁকায় ফেলেন। আর যখন তারা নামাযে দাড়ায় তখন অলসভাবে দাড়ায়, তারা লোকদেরকে দেখায় এবং আল্লাহকে কমই স্মরণ করে”। সুরা নিসা ১৪২। নিজের ইবাদত রিয়া তথা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে দেখানো জন্য করা এক প্রকার র্শিক। শুয়াবুল ইমান ৬৪১২।
রিয়াকারীকে আল্লাহ তা’আলা দুনিয়াতে যে শাস্তি দিবেন তা হলো- আল্লাহ তা’আলা তার গোপন উদ্দেশ্য প্রকাশ করে দিবেন। ফলে সে মানুষের কাছে তুচ্ছ আর ঘৃণিত হয়ে যাবে। রসুল স. বলেন – مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللَّهُ بِهِ ، وَمَنْ يرَائِي يرَائِي اللَّهُ بِهِ রসুল স. বলেন – যে ব্যক্তি লোক শোনানো ইবদাত করে ,আল্লাহ তা’আলা তার ‘লোক শোনানোর উদ্দেশ্য’ প্রকাশ করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি লোক দেখানো ইবাদত করে, আল্লাহ তা’আলা তার ‘লোক দেখানো উদ্দেশ্য’ প্রকাশ করে দিবেন, সহীহ বুখারী ৬৪৯৯।
৬. অকৃজ্ঞ হওয়া বা নেয়ামতের শুকরিয়া না করা
কৃতজ্ঞতা আদায় করা আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ। আর একজন সুস্থ বিবেকের মানুষ কখনো অনুগ্রহকারীর প্রতি অকৃতজ্ঞ হতে পারে না। আল্লাহ তা’আলা বলেন- “আমি লুকমানকে হিকমাহ দিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম যে, আমার কৃতজ্ঞতা আদায় কর। আর যে শুকরিয়া আদায় করে সে তো নিজের জন্যই শুকরিয়া আদায় করে। আর যে অকৃজ্ঞ হয় তার জেনে রাখা উচিত আল্লাহ তা’আলা অভাবমুক্ত, প্রশংসিত”। সুরা লুকমান ১২। এছাড়াও সুরা ইবরাহিমের ৭ নং আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন -لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর, তবে আমি অবশ্যই বাড়িয়ে দেব, আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তাহলে জেনে রেখ আমার আজাব বড় কঠিন।
যদি আমরা কৃতজ্ঞতা আদায় না করি তাহলে আমরা অভাবগ্রস্থ ও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়বো। ইরশাদ হচ্ছে- وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا قَرْيَةً كَانَتْ آمِنَةً مُطْمَئِنَّةً يَأْتِيهَا رِزْقُهَا رَغَدًا مِنْ كُلِّ مَكَانٍ فَكَفَرَتْ بِأَنْعُمِ اللَّهِ فَأَذَاقَهَا اللَّهُ لِبَاسَ الْجُوعِ وَالْخَوْفِ بِمَا كَانُوا يَصْنَعُونَ আল্লাহ তা’আলা দৃষ্টান্ত পেশ করেন একটি জনপদের। যা ছিল নিরাপদ ও শান্ত। সবদিক থেকে প্রচুর পরিমানে রিজিক আসতো। অতপর সে জনপদ আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার করল, অকৃতজ্ঞ হলো, তখন তারা যা করেছে তার বিনিময়ে আল্লাহ তা’আলা তাদের উপর ক্ষুধা ও ভয় চাপিয়ে দিলেন। সুরা নাহল ১১২।
৭. মিথ্যা এবং বিশ্বাসঘাতকতা
মিথ্যা বা প্রতারণা করে মানুষকে ঠকানো হয়। আর বিশ্বাসঘাতকতা তো পিছন থেকে ছুরিকাঘাতের মত এক গর্হিত কাজ। “আল্লাহ তা’আলা কোন বিশ্বাসঘতক এবং অকৃতজ্ঞকে ভালবাসেন না” সুরা হজ্জ ৩৮। “তোমরা মিথ্যা পরিহার কর” সুরা হজ্জ ৩০। পরকালের শাস্তি ছাড়াও এর প্রতিফল দুনিয়াতেই পাওয়া যায়। আজ আমি একজনের সাথে প্রতারণা করলে খুব তাড়াতাড়ি আমি প্রতারিত হবো। আজ বিশ্বাসঘাতকতা করলে, কাল আমি নিজেই তার শিকার হবো।
বলা উচিত না এমন কারোর কোন কথা, অপরকে বলে দেয়াও এক প্রকার বিশ্বাসঘাতকতা। এগুলো এমন অপরাধ যা আমাদের অনুভুতিতে আসে না, অথচ দুনিয়াতেই এর শাস্তি শুরু হয়ে যায়। রসুল স. বলেন – مَا مِنْ ذَنْبٍ أَجْدَرُ أَنْ يُعَجِّلَ اللهُ لِصَاحِبِهِ الْعُقُوبَةَ فِي الدُّنْيَا , مَعَ مَا يَدَّخِرُ لَهُ فِي الْآخِرَةِ , مِنْ الْبَغْيِ وَقَطِيعَةِ الرَّحِمِ وَالْخِيَانَةِ وَالْكَذِبِ পরকালের শাস্তি জমা রাখার পর যে অপরাধের শাস্তি ত্বরান্বিত করে আল্লাহ তা’আলা দুনিয়াতে দিবেন, তা হলো – জুলুম, আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট করা, মিথ্যা ও বিশ্বাসঘাতকতা। আল-জামে আস-সহিহ লিস সুনানী ওয়াল মাসানিদ ২৫১১।
সেই মহান রবের দরবারে আমাদের প্রার্থনা, তিনি যেন স্বীয় অনুগ্রহে এ সকল পাপ থেকে আমাদরেকে এবং আমাদের আপনজনদেরকে, সাথে সমস্ত মুসলমানকে হেফাজত করেন। আমিন ॥
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, ইমদাদুল উলূম রশিদিয়া মাদরাসা, ফুলবাড়িগেট, খুলনা।
খুলনা গেজেট/ বিএম শহিদুল