জাতির নিজস্বতা নিয়ে বেড়ে ওঠার জন্য, তার অভ্যন্তরীন শক্তি ও দুর্বলতা চিহ্নিত করে, আত্মবিশ্বাসের সাথে এগিয়ে যেতে হয়। আত্মবিশ্বাস দেয় আত্মনিয়ন্ত্রণের দৃঢ়তা। বাঙালি জাতি হাজার বছর ধরে এই গাঙ্গেয় বদ্বীপে বিকাশের প্রচেষ্টা অব্যহত রেখেছে। কখনো কিছু সময় নিজেরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করেছে, আবার বেশির ভাগ সময় শাসিত হয়েছে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী দ্বারা। বিদ্রোহ করেছে যুগে যুগে, রক্ত দিয়েছে অকাতরে। কিন্তু স্বাধীন ভূখণ্ড পায়নি কখনও। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন করে। যা অনন্য ও মহাকাব্যিক।
এই রাষ্ট্র গঠনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, আত্মত্যাগ ও জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিতে যে সর্বপ্লাবি ভূমিকা তা তাকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি অভিধায় ভূষিত করে। তের বছরের কারা জীবন। বার বার ফাঁসির মঞ্চে দাড়িয়ে বাঙালির অধিকারের দাবীতে আপোষহীন থাকা, অপার সাহসিকতার বিনম্র দৃঢ়তা তুলনাহীন।
যে জাতি তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্দেশিত পথে চলে, তা সুর্যকরোজ্জ্বল ভোর উন্মোচিত করে, এ সত্য যেন বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে প্রকাশিত।
স্বাধীন বাংলাদেশের পথ চলা শুরু হয়, মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল বীরত্বগাথা আর ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তস্নাত ভূমিতে। রূপান্তর ঘটতে থাকে বৃটিশ ও পাকিস্তান শাসিত ঔপনিবেশিক ও প্রাদেশিক বাংলার। হয়ে উঠতে থাকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। নিজস্ব রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে জাতীয় চার মূলনীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে পুনর্গঠিত হতে থাকে প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও বৈদেশিক সম্পর্কের কাঠামো। জাতিসংঘসহ ১৪ টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য পদ লাভ করে। নবীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আসতে থাকে, পঞ্চাশের অধিক রাষ্ট্রের প্রধানসহ নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশ সফর করে। ভারত থেকে ফিরে আসা এক কোটি লোককে পুর্নবাসিত করা হয়। ব্যাংক ব্যবস্থা, বিমান বাহিনী, পুলিশ, আর্মি, নেভীসহ সরকারের সকল বিভাগ গড়ে তোলা হয়। অবকাঠামো তৈরিতে মনোনিবেশ করা হয়। চারিদিকে কর্মচাঞ্চল্যের প্রকাশ।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিভক্ত পৃথিবী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারতসহ তাদের মিত্ররা। মার্কিন জনগন বাংলাদেশের ন্যায্য লড়াই কে সমর্থন করলেও প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও কিসিঞ্জার প্রশাসন বিরোধিতা করে। স্বভাবতই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্থান পরাজিত হলে বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন প্রশাসন ঝাঁকুনি খায়। তারপর থেকে বাংলাদেশকে বিপদগ্রস্ত ও বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা শুরু করে। পাকিস্তানি আইএসআই তাদের সহযোগী হয়। একাজে তারা বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব খন্দকার মোশতাক তার কিছু অনুচর ও মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে পাকিস্তান প্রত্যাগত সামরিক অফিসারদের একাংশকে কাজে লাগায়। মিথ্যা অপপ্রচার, সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে জাসদ গণ বাহিনী ও রাজাকার, আল বদর, মুসলিমলীগের ঘাপটি মেরে থাকা অংশ। একটি নবীন রাষ্ট্রের জন্য এ অন্তর্ঘাত ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত গভীর সমস্যার সৃষ্টি করে। বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল উচ্চতা সম্পন্ন মানুষ বাংলাদেশের নেতৃত্বে থাকার কারণে এগিয়ে চলছিল সামনের দিকে। রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে যায় ষড়যন্ত্রকারীরা। সাদামাটা জীবন যাপন, দেশের মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসার কারণে নিরাপত্তা বিহীন বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে তারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মম ভাবে হত্যা করে।
বাঙালি জাতির অগ্রযাত্রাকে ব্যহত করে, বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপে বসে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের ক্রীড়ানক ব্যাক্তিবর্গ ও সামরিক জান্তা। হাজার বছরের ইতিহাস সংস্কৃতির যে অর্জন তা স্তব্ধ হয়ে যায়। বাঙালি মূল্যবোধের উল্টো দিকে চলা শুরু করে বাংলাদেশ। সমাজ কাঠামোর একটি অংশকে সাম্প্রদায়িক ও বিভক্ত করে দিতে সক্ষম হয় তারা। আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়ে। বাংলাদেশ দরিদ্রতম হয়ে পড়ে। এদের অপশাসনের কারণে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও অর্জন বিলীন হতে থাকে। মানুষের জীবনমান শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। আর বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ইনডেমনিটি দিয়ে আইনের শাসনকে করে সুদূর পরাহত।
২০২০ সালের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে জাতি হিসাবে আমাদের অঙ্গীকার হোক, বঙ্গবন্ধু কে হত্যার মধ্য দিয়ে যে অনিরাময় যোগ্য বেদনা ও অপূরনীয় ক্ষতি, আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তা স্মরনে রেখে সামনের পথ নির্ধারন করবো। বঙ্গবন্ধুকে হারানোর শোককে শক্তিতে তে রূপান্তরিত করে আধুনিক উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় দিপ্ত পথচলা অব্যহত রাখবো। জ্ঞান, বিজ্ঞান, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক অভিযাত্রার মাধ্যমে বাংলাদেশকে এমন ভাবে গড়ে তুলবো, যা বিশ্ব সভ্যতায় অবদান রাখবে এবং মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নেবে। এমন সোনার বাংলা গড়তে পারলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হবে। দীপ্ত সমুজ্জ্বল চির ভাস্বর হবেন তিনি।
খুলনা গেজেট / এমএম