বাঙালি সনাতন ধর্ম বিশ্বাসীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দুর্গাপূজার সূচণালগ্ন মহালয়া। সনাতন ধর্মবিশ্বাসীদের মতে শনিবার (১৪ অক্টোবর) পিতৃপক্ষের অবসান ঘটিয়ে দেবীপক্ষে মহালয়ার এ শুভক্ষণে দুর্গতীনাশিনী দুর্গা দেবীর আগমনী বার্তা ধ্বনিত হয়।
পুরাণমতে, আশ্বিনী অমাবস্যার এদিন দেবী দুর্গার মর্তে আবির্ভাব ঘটে। এ দিন থেকেই দুর্গাপূজার দিন গণনা শুরু হয়। মহালয়া মানেই আর ছয় দিনের প্রতীক্ষা মায়ের পূজার। আর এ দিনেই দেবীর চক্ষুদান করা হয়।
বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মতে, নানা ধর্মীয় মাঙ্গলিক আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শনিবার (১৪ অক্টোবর) মহালয়ার মধ্য দিয়ে দেবীপক্ষের শুরু। এরপর ২০ অক্টোবর সকালে ষষ্টাদি কল্পারম্ভে দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাস, ওই দিন বিকেলে পূজারম্ভ। ২১ অক্টোবর সকালে মহাসপ্তমী, ২২ অক্টোবর সকালে মহাঅষ্টমী, সন্ধিপুজো রাত ৮টা ৬ মিনিট থেকে রাত ৮টা ৫৪ মিনিট পর্যন্ত, ২৩ অক্টোবর সকালে মহানবমী পূজা কল্পারম্ভ এবং ২৪ অক্টোবর সকালে মহাদশমী কল্পারম্ভ- পূজা সমাপন ও দর্পণ বিসর্জন সকাল ৯টা ৪৯ মিনিটের মধ্যে।
যশোর রামকৃষ্ণ আশ্রম ও মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী জ্ঞান প্রকাশানন্দ মহারাজ বলেন, শাস্ত্রমতে এ বছর দেবীর আগমন ঘটকে (ঘোড়া) এবং কৈলাসে ফিরে যাবেনও ঘটকে। দেবীর ঘোড়ায় যাতায়াতের ফল হল ‘ছত্রভঙ্গস্তুরঙ্গমে’ অর্থাৎ সবকিছু ছত্রভঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। নানা গোলমাল, দাঙ্গাহাঙ্গামা, ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট দ্বারা বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলা ঘটে থাকে। ঘোড়া ছটফটে প্রাণি। তাই সে যখন যায়, সব কিছু ছত্রভঙ্গ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এতে ফসল নষ্ট হওয়ার এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা ও খরা দেখা দিতে পারে। মহামারি ও রাজনৈতিক অস্থিরতাও হতে পারে।
যশোর পূজা উদযাপন পরিষদ সূত্রে জানা যায়, এ বছর যশোর জেলার আটটি উপজেলায় গত বছরের চেয়ে ৯টি বেড়ে ৭৩২টি মন্দির ও মন্ডপে দুর্গাপূজার আয়োজন চলছে। এরমধ্যে যশোর সদর উপজেলা এলাকায় ১৬৭টি মন্দির ও মন্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। এরমধ্যে পৌর এলাকায় পূজা হবে ৫০টি মন্দিরে, অভয়নগর উপজেলায় ১৩৪টি, এরমধ্যে পৌর এলাকায় ২০টি, মণিরামপুরে ৯৯টি, পৌর এলাকায় ৯টি, কেশবপুরে ৯৮টি, পৌর এলাকায় ৯টি, বাঘারপাড়ায় ৯৭টি, পৌর এলাকায় ৪টি, ঝিকরগাছায় ৫৬টি, পৌর এলাকায় ৯টি, চৌগাছায় ৪৯টি, পৌর এলাকায় সাতটি ও শার্শায় ৩২টি, এরমধ্যে পৌর এলাকায় চারটি মন্দিরে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে।
মন্দিরে ও মন্ডপে প্রতীমা তৈরির কাজে ব্যস্ত ভাস্কররা। আয়োজকরাও বর্ণিল আয়োজনের পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে। এখন শুধু অপেক্ষা সেই মাহেন্দ্রক্ষণের। ছয় দিন পরেই চারিদিকে ধ্বণিত হবে ‘রূপং দেহি, যশ দেহি, জয়ং দেহি, দিশো দেহি মন্ত্র উচ্চারণ।
উল্লেখ্য, মহিষাসুরমর্দিনী দেবী দুর্গা সমস্ত অশুভ শক্তি বিনাশের প্রতীক রূপে পূজিত। মহামায়া অসীম শক্তির উৎস। পুরাণ মতে, শিবের বর অনুযায়ী কোন মানুষ বা দেবতা কখনো মহিষাসুরকে হত্যা করতে পারবে না। ফলত অসীম হ্মমতাশালী মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে এবং বিশ্ব ব্রক্ষ্মান্ডের অধীশ্বর হতে চায়। সুর অসুরের দ্বন্ধে মহালয়ার এদিনে, দুর্গতীনাশিনী দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধের দায়িত্ব পান।
শাস্ত্রমতে, মহালয়ার দুটি পর্ব রয়েছে, একটি পিতৃপক্ষ, অন্যটি দেবীপক্ষ। অমাবস্যা তিথিতে পিতৃপক্ষের শেষ হয়, আর প্রতিপদ তিথিতে শুরু হয় দেবী পক্ষ। দেবীপক্ষ তথা মহালায়ার এদিন মত আত্মীয়স্বজন ও পূর্বপুরুষদের আত্মার মঙ্গল কামনায় গঙ্গাতীরে প্রার্থণা করেন ভক্তরা। মহালয়ার আর একটি দিক হচ্ছে এই মহালয়া তিথিতে যারা পিতৃ-মাতৃহীন তারা তাদের পূর্বপূরুষের স্মরণ করে তাদের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন। সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াত আত্মাদের মর্ত্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়। প্রয়াত আত্মার যে সমাবেশ হয়, তাকে মহালয়া বলা হয়। মহালয় থেকে মহালয়া। পিতৃপক্ষেরও শেষদিন এটি।
ধর্মীয় বিশ্বাস মতে, দেবীপক্ষের আগের কৃষ্ণা প্রতিপদে মর্ত্যধামে নেমে আসেন পিতৃপুরুষরা। অপেক্ষা করেন উত্তরসূরিদের কাছ থেকে তিল, তুলসী, জল পাওয়ার। মহালয়ার দিন অমাবস্যায় তাদের উদ্দেশ্যে তিল, তুলসী, জলদানই তর্পণ। তাই এই পুণ্যতিথিতে তাদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা অর্পণ করেন সনাতন ধর্মবিশ্বাসীরা।
এদিন, মহালয়ার শুভক্ষণে সনাতন ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান আর বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণে যশোরে তিল তর্পণ অনুষ্ঠানসহ প্রার্থনা ও নানা ধর্মীয় কর্মসূচি পালন করা হয়। এ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শোক, তাপ, দুঃখ, অমঙ্গল, অন্ধকারহরণ করে শুভ, মঙ্গল, আনন্দ প্রদানকারী ও আলোর দিশারী অসুরবিনাশিনী মা’কে হিমালয় থেকে মর্ত্যে বরণ করে নেয়া হয়।
খুলনা গেজেট/এনএম