মিজানুর রহমান তোতা। ঝিনাইদহের সন্তান। ছিলেন ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত । সেখানকার কেসি কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রজীবন শেষে যশোরে পর্দাপণ। ৪৫ বছর ধরে সাংবাদিকতা করেছেন। যশোর সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি, একবার প্রেসক্লাব, যশোর- এর সম্পাদক ও তিনবার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৭৭ সাল থেকেই ছড়া, কবিতা, সংবাদ লেখালেখিতে প্রবেশ। ১৯৭৮ সালে দৈনিক গণকন্ঠের রিপোর্টার, সমাচারের স্টাফ রিপোর্টার, ১৯৭৯ সালে দৈনিক স্ফুলিঙ্গের স্টাফ রিপোর্টার, ১৯৮০ সালে পিআইবির লং কোর্সের প্রশিক্ষণ, পরবর্তীতে দৈনিক স্ফুলিঙ্গের বার্তা সম্পাদক, দৈনিক ঠিকানায় নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আজাদের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এর মধ্যে সাপ্তাহিক ছুটি, সাপ্তাহিক পূর্ণিমায় লেখালেখি, তারপর থেকেই দৈনিক ইনকিলাবে একটানা ৩৫ বছরই তিনি কাজ করছেন।
সাংবাদিকতার ওপর তার ‘মাঠ সাংবাদিকতা’ এবং আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘ক্ষতবিক্ষত বিবেক’ নামের গ্রন্থ দুটি ইতোপূর্বে খুবই সমাদৃত হয়েছে। সাহিত্যচর্চা করেন বহুদিন। তার অসংখ্য কবিতা দেশে-বিদেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তার নির্বাচিত ৮০টি কবিতা নিয়ে ‘দিবানিশি স্বপ্নের খেলা’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ হয়েছে।
সামরিক শাসক জেনারেল এইচ এম এরশাদের জামানায় ১৯৮৬ সালে মাওলানা আব্দুল মান্নানের মালিকানায় দৈনিক ইনকিলাব প্রকাশিত হলে যশোর প্রতিনিধি হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে লাইম লাইটে আসেন তিনি। যশোরের যশ, খেজুরের রস এ শ্লোগানকে ধারণ করে মা মাটি মানুষের কথা তুলে ধরেছেন পত্রিকার পাতায়। কৃষি ভিত্তিক সংবাদকে প্রাধান্য দিতেন। জল, জাত ও জমির ওপর নির্ভর করে কৃষি অর্থনীতি। যশোরে বারো মাসেই কৃষি অর্থনীতির কোন না কোনটাই প্রাধান্য পায়। সারা বছর গদখালির ফুল মার্কেট গণমাধ্যমে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। খাজুরায় কার্তিক থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত খেজুরের রস, গুড়, পাটালী ইত্যাদির ব্যবসা জমজমাট থাকে। এমনকি এখানকার গুড় পাটালী বিদেশে রপ্তানী হয়। গ্রামে গঞ্জে স’মিল স্থাপনের ফলে খেজুর গাছ উজাড় হওয়ায় যশোরের ঐতিহ্য বিলীন হতে থাকে। এমন একটি প্রতিবেদন ইনকিলাবে ছাপা হওয়ার পর যশোর জেলার কৃষি বিভাগ একলক্ষ খেজুরের চারা রোপণ করে। মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম এর পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলেন।
যশোরের কৃষি অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু ঝিনাইদহের বারোবাজার। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত মৌসুমে নানা জাতির সবজির বড় মোকাম এ স্থানটি। কৃষি অর্থনীতি চাঙ্গা করার লক্ষে তার লেখনী ছিল বস্তুনিষ্ঠ। শার্শা ও মনিরামপুরের পেঁপে চাষকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নেওয়ার জন্য লেখনীর পাশাপাশি সেমিনারে কথা বলেছেন। তার বক্তব্য কৃষিবিদরা গ্রহণ করে তা আমলে নেন। যশোরের এ দুই উপজেলা থেকে বছরে কোটি কোটি টাকার পেঁপে উৎপাদন হয়।
ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে কপোতাক্ষ নদ খনন করে জলধার সৃষ্টির জন্য গণমানুষের আন্দোলনের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। যশোরের বড় একটি অংশ রোরো ধানের ওপর নির্ভরশীল। নতুন জলধার সৃষ্টির ফলে একদিকে যেমন ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমে, অপরদিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে পরিবেশ রক্ষা পায়।
সীমান্তবর্তী জেলা যশোর মাদক চোরাচালানের রুট। বিশেষ করে আশির দশকে বেনাপোল ও চৌগাছা সীমান্ত দিয়ে ফেন্সিডিল ও ইয়াবা প্রবেশ করায় মাদকের নীল ছোবলে দক্ষিণাঞ্চল বিষাক্ত হয়ে ওঠে। চরমপন্থীদের অস্ত্রের ঝনঝনিতে যশোরের নিরীহ মানুষের শান্তি নষ্ট, উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার মধ্য দিয়ে মাসের পর মাস কাটাতে হয়েছে। স্থানীয় সাংবাদিকরা এর বিরুদ্ধে স্বোচ্চার হন। নেতৃস্থানীয় সাংবাদিকদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
ভৈরব নদের দখলদারদের রক্তচক্ষু এক সময় শহরের অধিবাসীদের শান্তি নষ্ঠ করে। সাংবাদিক নেতা দৈনিক রানার সম্পাদক আর এম সাইফুল আলম মুকুল ও জনকন্ঠের ব্যুরো প্র্রধান শামসুর রহমান নিহত হওয়ার পর স্থানীয় সাংবাদিকরা পেশা ছেড়ে দেওয়ার একটি সংকটময় মুহুর্তে উপনীত হন। সে সময় সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি অভয়ের বাণী শুনিয়েছেন। দিনভর কাটাতেন সাংবাদিকতা জগতের মধ্যে। এ জগতের বাইরে তার পদচারণা ছিল না।
তার অনুপস্থিতিতে শূন্যতার সৃষ্টি হল। দীর্ঘ কর্মময় জীবন আজকের প্রজন্মের সাংবাদিকদের জন্য অনুকরণীয়। চির বিদায়ের এ মুহুর্তে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
(লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, খুলনা গেজেট)