অনেক রাত পর্যন্ত জেগে টেলিভিশিন দেখাটা আমার একটা নেশা বলতে পারেন। যেহেতু নিউজ চ্যানেলে কাজ করি, রিমোট হাতে তাই ঘুরেফিরে দেশি-আন্তর্জাতিক নিউজ চ্যানেলে চোখ রাখতে রাখতে ঘড়ির কাটা কখন যে দুইটা, তিনটা বেজে যায় খেয়াল থাকে না। মাঝে মধ্যে মুভিও দেখি। ২৫ নভেম্বর রাত, হঠাৎ রিমোটের বদৌলতে যমুনা টেলিভিশনের স্ক্রলে ব্রেকিং নিউজ লেখা দেখে কমফ্রোটারের মাঝে এলোমেলো শরীরটা কেমন যেন নড়ে উঠলো। রাতে কি আবার ব্রেকিং নিউজ! চোখে লাগালাম পাওয়ারফুল চশমা-স্ক্রল পড়ে রীতিমতো হতবাক, বিস্মিত ও মর্মাহত। ‘ডিয়াগো ম্যারাডোনা আর নেই’। এতো বড় একটা দুঃসংবাদ নিয়ে একজন ক্রীড়ামোদী হয়ে লম্বা রাত পাড়ি দিতে হবে ভাবিনি…।
ম্যারাডোনাকে যখন চিনি তখন বাড়িতে কেবলমাত্র রঙ্গিন টেলিভিশন এসেছে। ছোটখাটো, গাট্টা-গুট্ট, নাদুস-নুদুস মার্কা চেহারা। ওরে বাবা-বল নিয়ে সেই কি দৌড়। ড্রিবলিং, কনট্রলিং, পাস, হেড, মধ্যমাঠ থেকে বল নিয়ে ছুটছেন তো ছুটছেন… এ যেন মুদ্রার তালে তালে গোটা শরীর তিনি নাচাচ্ছেন। তার নাচে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রাও নাচতে বাধ্য হচ্ছেন।
আগেভাগে বলে রাখি আমি আর্জেন্টাইন বা ব্রাজিল কোনো দলেরই সমথক নই। কিন্তু শুরু হলো তাঁর প্রতি আমার ভালোলাগা, ভালোবাসা। সংগ্রহ করতে লাগলাম ভিউকাড, আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন চুরি (তখন ব্যয় বহুল ছিলো) করে বিভিন্ন অ্যাকশনের রঙ্গিন ছবি সংগ্রহ আর টাকা জমিয়ে কিনতে লাগলাম পোষ্টার। ঘরে দরজায়, পড়ার টেবিলের সামনে তাঁর ছবি টানানো দেখে কতো যে বাবার বকা খেয়েছি…।
আর্জেন্টিনোস জুনিয়রের হয়ে ১৬ বছর বয়সে পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। জাদুকরী বাঁ পায়ে মাতিয়েছেন বার্সেলোনা, নাপোলি, সেভিয়া ও নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজ ক্লাব। তবে ম্যারাডোনা অমর হয়ে থাকবেন আর্জেন্টিনার জার্সিতে। ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপের পরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ম্যারাডোনার অমরত্ব। সেই টুর্নামেন্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যারাডোনার দু’টি গোলের কথা ফুটবল ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। প্রথমটি ‘হ্যান্ড অব গড’। রিপ্লেতে দেখা গিয়েছিলো তাঁর হাতে লেগে বল জালে জড়িয়েছিলো। তবে সেই ম্যাচেই তার পরের গোলটি ছিলো চোখজুড়ানো। একের পর এক ফুটবলারকে কাটিয়ে গোল করেছিলেন তিনি, যা মুগ্ধতায় চিরভাস্বর ফুটবলপ্রেমিদের মনে। পরের বিশ্বকাপেও তিনি দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন ফাইনালে।
কে সেরা? পেলে নাকি ম্যারাডোনা- এই বিতর্কে বিভক্ত সারা বিশ্ব। ২০০০ সালে এক অনলাইন জরিপে শতাব্দীর সেরা ফুটবলার হয়েছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। তাঁর মৃত্যুর পর পেলে বলেছেন, ‘বন্ধু তোমার সঙ্গে একদিন স্বর্গে ফুটবল খেলবো।’ ‘ফুটবল ঈশ্বর’ ব্রক্ষা-ছেড়ে ঈশ্বরের কাছে চলে গেছেন।
বিশ্ব ফুটবল মাঠে ১০ নম্বর জার্সি দিয়ে যদি বিচার করা হয়, তবে এক নিঃশ্বাসে সবাই বলবে, ‘লাভ ইউ দিয়াগো ম্যারাডোনা’। এতবড় সুপারস্টার পৃথিবীতে আবার কবে আসবে? আদৌ কি আসবে? আবার পরক্ষণে মনে হয়, ম্যারাডোনা তো একজন শিল্পী, শিল্পীর তো মৃত্যু নেই….।
লেখক : গণমাধ্যম কর্মী।
খুলনা গেজেট /এমএম