গত ১২ জুন তৃতীয়বারের মতো খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) মেয়র নির্বাচিত হন তালুকদার আবদুল খালেক। গত ৩ জুলাই মেয়র হিসেবে শপথও গ্রহণ করেছেন তিনি। কিন্তু আইনের ফাঁকে পড়ে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না তিনি।
স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনের ২১ ধারায় মেয়রের অবর্তমানে মেয়র প্যানেলের সদস্যদের দায়িত্ব পালনের কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু নির্বাচিত ৩ জন প্যানেল মেয়র থাকলেও তারা দায়িত্ব পাচ্ছেন না। ফলে গত সাড়ে ৩ মাস কেসিসির মেয়রের চেয়ারটি ফাঁকা পড়ে আছে।
সিটি করপোরেশনের শীর্ষ পদটি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের জন্য সংরক্ষিত। কিন্তু আইনের ফাঁকে পড়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কেউই মেয়রের দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকলেও কেসিসির আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা এখন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার হাতে ন্যস্ত।
এ অবস্থায় স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন-২০০৯ এবং নির্বাচন কমিশনের সিটি করপোরেশন নির্বাচনী আচরণবিধি মালা সংশোধনের দাবি উঠেছে।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনটি পাশ হয় ২০০৯ সালে। এই আইন প্রণয়নের পর থেকেই ৫ বছর পূর্ণ মেয়াদ দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না মেয়ররা। আইনের ৩৪ ধারার (খ) উপধারায় বলা হয়েছে মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৮০ দিন অর্থাৎ ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। আইন অনুযায়ী ৬ মাসের মধ্যেই তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনী আচরণবিধি মালা অনুযায়ী মেয়র পদটি সরকারি সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত। এই পদে থাকা ব্যক্তিরা নির্বাচনের অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হন। এজন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে ৪/৫ মাস আগেই পদত্যাগ করতে হচ্ছে মেয়রদের।
দেখা গেছে, ২০০৮ সালে নির্বাচনে প্রথমবার বিজয়ী হন বর্তমান সিটি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক। ২০১৩ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য ৫ মাস আগেই পদত্যাগ করতে হয়েছিলো তাকে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আবারও মেয়র নির্বাচিত হন তালুকদার আবদুল খালেক। এবারও সাড়ে ৫ মাস আগে পদত্যাগ করতে হয়েছে তাকে। অর্থাৎ ৫ বছরের জন্য মেয়র নির্বাচিত হলেও দুই বারই তাকে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে সাড়ে ৪ বছর করে। এতে একদিকে যেমন প্রতিশ্রুতির কিছু কাজ অসম্পূর্ণ থেকে গেছে, অন্যদিকে নির্বাচিত মেয়রের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে নগরীর মানুষ।
সূত্রটি জানায়, ২০০৯ সালে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন পাশ হওয়ার পর কেসিসির ৩ জন মেয়র দায়িত্ব পালন করেছেন। এর মধ্যে ২০১৩ সালে নির্বাচিত মেয়র মনিরুজ্জামান মনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেননি। এ কারণে তিনি পরিষদের মেয়াদের শেষদিন পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। যদিও বরখাস্ত হওয়ার কারণে তিনিও পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি।
সূত্রটি জানায়, গত ১২ জুনের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ৩ জুলাই শপথগ্রহণ করেন তালুকদার আবদুল খালেক। আইন অনুযায়ী দায়িত্বগ্রহণের জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে ১১ অক্টোবর পর্যন্ত। এসব অসঙ্গতি দূর করে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে আইনটি সংশোধন ও বিধি প্রণয়ন করা জরুরী।
॥ প্যানেল মেয়ররা দায়িত্ব পাচ্ছেন না ॥
স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনের ২১ ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘পদত্যাগ, অপসারণ অথবা মৃত্যুজনিত কারণে মেয়রের পদ শুন্য হলে শুন্য পদে নব নির্বাচিত মেয়র কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে মেয়রের প্যানেলের কোন সদস্য মেয়রের সকল দায়িত্ব পালন করবেন।’ ইতোপূর্বেও আইন মেনে প্যানেল মেয়ররাই ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এবারই ঘটেছে ব্যত্যয়।
কেসিসি থেকে জানা গেছে, নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য গত ১১ মে পদত্যাগ করেন তালুকদার আবদুল খালেক। গত ১১ মে মেয়রের পদত্যাগের দিনই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে এক অফিস আদেশ জারি করা হয়। সেখানে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে আর্থিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব দেওয়া হয়।
কেসিসি কর্মকর্তারা জানান, ২০১৩ সালে নির্বাচনের আগে পদত্যাগ করেন তৎকালীন মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক। ওই সময়ও মেয়র প্যানেলের সদস্যরা কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। নির্বাচনকালীন ২৫ দিন কেসিসির প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচনের পরে মেয়র প্যানেলের ১নং সদস্য আজমল আহমেদ তপনকে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সাড়ে ৩ মাস ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পালনের পর তিনি নির্বাচিত মেয়র মনিরুজ্জামান মনির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন।
কাউন্সিলরা জানান, প্যানেল মেয়র পদকে সম্মানজনক পদ হিসেবে দেখা হয়। মেয়রের অবর্তমানে ‘ভারপ্রাপ্ত মেয়র’ হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ থাকায় জেষ্ঠ্য কাউন্সিলররা প্যানেল মেয়র হতে চেষ্টা করেন। মেয়র প্যানেল নির্বাচন নিয়ে তাদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ দেখা যায়।
কেসিসির বর্তমান পরিষদের ৯ জন কাউন্সিলর মেয়র প্যানেল নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে মেয়র প্যানেলের ১ নং সদস্য হিসেবে ১৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আমিনুল ইসলাম মুন্না, ২নং সদস্য হিসেবে ২৫ ওয়ার্ড কাউন্সিলর আলী আকবর টিপু ও ৩নং সদস্য হিসেবে সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মেমরী সুফিয়া রহমান শুনু নির্বাচিত হন। কিন্তু দায়িত্ব পালনের সুযোগ না পেয়ে হতাশ তারা।
এ ব্যাপারে মেয়র প্যানেলের ১ নং সদস্য আমিনুল ইসলাম মুন্না বলেন, এই সাড়ে ৩ মাসে অসংখ্য মানুষ, অসংখ্যবার এই প্রশ্ন করেছে। আমি বিব্রত।
প্যানেল মেয়র-২ আলী আকবর টিপু বলেন, মন্ত্রণালয় অন্যায়ভাবে এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে। এটা ঠিক নয়।
এ ব্যাপারে সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোভেট কুদরত ই খুদা বলেন, স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন এবং নির্বাচনী আচরণবিধিমালার ফাঁক ফোকরের কারণে নির্বাচিত মেয়র দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। এ অবস্থায় আইনটি সংশোধন করা এখন সময়ের দাবি।
খুলনা গেজেট/এইচ/এমএম