জানাজার নামাজ আদায়ের তরিকা-
মৃত ব্যক্তিকে সামনে রেখে তার মাগফিরাত কামনার জন্য সকলে একত্রিত হয়ে যে দুআ পড়া হয়, তাকে জানাজার নামাজ বলে। আদবের সহিত বিনয়ের সাথে দাঁড়াবে। তারপর নিয়ত করবে, (যেমন, আমি আল্লাহর ওয়াস্তে এই মায়্যেতের জন্য দুআ করার উদ্দেশ্যে জানাজার ফরযে কেফায়ার নামাজ চার তাকবিরের সহিত কেবলামুখী হয়ে এই ইমামের পিছনে আদায় করছি।
এই ভাবে নিয়তের পর ১ম তাকবির বলবে, তারপর ছানা পড়বে। জানাজার নামাযে ক্বিরাত পড়ার বিধান নেই। তাই সূরা ফাতিহা পড়বে না। তবে কেউ দুআ হিসেবে সূরা ফাতেহা পড়তে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে শুধু ছানা পড়াটাই উত্তম কেননা অধিকাংশ সাহাবি ও তাবেয়িদের আমল এমনটিই ছিল:
سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ وَتَبَارَكَ اسْمُكَ وَتَعَالَى جَدُّكَ وَجَلَّ ثَنَاءُكَ وَلَا إِلَهَ غَيْرُكَ
উচ্চারণঃ সুবহা-নাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা, ওয়া তাবারা কাসমুকা ওয়া তাআলা জাদ্দুকা, ওয়া জাল্লা ছানা উকা ওয়া লা- ইলাহা গাইরুক।
অনুবাদঃ হে আল্লাহ আমরা তোমার পবিত্রতার গুণগান করিতেছি। তোমার নাম মঙ্গলময় এবং তোমার সম্মান ও মর্যাদা অতি শ্রেষ্ঠ, তোমার জন্য প্রশংসা, তুমি ব্যতীত আর কেহই উপাস্য নাই। ছানার পর ২য় তাকবির বলবে, তারপর দরুদে ইব্রাহিম পড়বে।
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَ اهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ – اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَا هِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَّجِيدِتُ
উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা সাল্লিআলা মুহাম্মাদিও ওয়া আলা আ-লি মুহাম্মাদ, কামা- সাল্লাইতা আলা- ইব্রাহিমা ওয়া আলা- আ-লি ইব্রাহিম, ইন্নাকা হামিদুম্মাজিদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদিও ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদ, কামা বারাকতা আলা- ইব্রাহিমা ওয়া আলা- আ-লি ইব্রাহিম, ইন্নাকা হামিদুম্মাজিদ।
অনুবাদঃ যে আল্লাহ! মুহাম্মদ ﷺ এবং তাঁহার বংশধরগণের উপর ঐরূপ রহমত অবতীর্ণ কর যে-রূপ রহমত হজরত ইব্রাহিম আ. এবং তাঁহার বংশধরগণের উপর অবতীর্ণ করিয়াছ। নিশ্চয়ই তুমি প্রশংসা ভাজন এবং মহিমান্বিত। হে আল্লাহ! মুহাম্মদ ﷺ এবং তাঁহার বংশধরগণের উপর সেইরূপ অনুগ্রহ কর যে রূপ অনুগ্রহ ইব্রাহিম আ. এবং তাঁহার বংশধরগণের উপর করিয়াছ। নিশ্চয়ই তুমি প্রশংসা ভাজন এবং মহিমান্বিত।
দরুদে ইব্রাহিমের পর ৩য় তাকবির বলবে, তারপর মৃত ব্যক্তির জন্য দুআ পড়বে।
أَلَّهُمَّ اغْفِرْ لِحَيْنَا وَمَيِّتِنَا وَشَاهِدِنَا وَغَائِبِنَا وَصَغِيْرِنَا وَكَبِيْرِنَا وَذَكَرِنَا وَانْثَانَا اللَّهُمَّ مَنْ أَحْيَيْتَهُ مِنَّا فَأَحْيِهِ عَلَى الإِسْلَامِ وَمَنْ تَوَفَّيْتَهُ مِنَّا فَتَوَفَّهُ عَلَى الإِيمَانِ
উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মাগফিরলি হাইয়্যিনা ওয়া মাইয়্যিতিনা ওয়া শাহিদিনা ওয়া গায়িবিনা ও ছাগিরিনা ও কাবিরিনা ওয়া যাকারিনা ওয়া উনছানা। আল্লাহুম্মা মান আহইয়াইতাহু মিন্না ফাআহয়িহি আলাল ইসলাম, ওয়ামান তাওয়াফ্ ফাইতাহু মিন্না ফাতাওয়াফ ফাহু আলাল ইমান।
অনুবাদঃ হে আল্লাহ্ আমাদের জীবিত ও মৃত উপস্থিত ও অনুপস্থিত বালক ও বৃদ্ধ পুরুষ ও মহিলাদের ক্ষমা কর। হে আল্লাহ আমাদের মধ্যে যাদের তুমি জীবিত রাখ তাদেরকে ইসলামের ওপর জীবিত রাখিও। আর যাদেরকে মৃত্যু মুখে পতিত কর। তাদেরকে ইমানের সাথে মৃত্যু দান করিও।
মাইয়্যিত যদি নাবালক ছেলে হয় তবে নিচের দুআ পড়বে।
اللَّهُمَّ اجْعَلْهُ لَنَا فَرْعًا وَاجْعَلْهُ لَنَا أَجْرًا وَذُخْرًا وَاجْعَلْهُ لَنَا شَافِعًا وَمُشَفَعًا
উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মাজ্ আল হুলানা ফারতাঁও ওয়াজ্ আল হুলানা আজরাও ওয়া যুখরা, ওয়াজ্ আল হুলানা শাফিয়াও ওয়া মুশাফফায়া।
অনুবাদঃ হে আল্লাহ! তাকে আমাদের জন্য অগ্রগামী কর ও তাকে আমাদের পুরস্কার ও সাহায্যের উপলক্ষ্য কর এবং তাকে আমাদের সুপারিশকারী ও গ্রহণীয় সুপারিশকারী বানাও। মাইয়্যিত যদি নাবালিকা মেয়ে হয় তবে নিচের দুআ পড়বে।
اللَّهُمَّ اجْعَلْهَا لَنَا فَرْعًا وَاجْعَلْهَا لَنَا اَجْرًا وَذُخْرًا وَاجْعَلْهَا لَنَا شَافِعَةٌ وَمُشَفّعةً
উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মাজ্ আল হা-লানা ফারতাঁও ওয়াজ্ আল হা- লানা আজরাঁও ওয়া যুখরা, ওয়াজ্ আল হা-লানা শাফিআতাউ ওয়া মুশাফফায়াহ্।
অনুবাদঃ হে আল্লাহ! তাকে আমাদের জন্য অগ্রগামী কর ও তাকে আমাদের পুরস্কার ও সাহায্যের উপলক্ষ্য কর। এবং তাকে আমাদের সুপারিশকারী ও গ্রহণীয় সুপারিশকারী বানাও।
মৃত ব্যক্তির জন্য নির্ধারিত দুআ পাঠ করার পর ৪র্থ তাকবির বলবে, তারপর সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করবে। জানাজা নামাযে সালাম ফিরানোর সময় হাত কখন ছাড়বে- এ সম্পর্কে ফিকহবিদগণ থেকে দুই ধরনের মত রয়েছে। একটি মত হল, চতুর্থ তাকবির বলার পর উভয় হাত ছেড়ে দিবে এবং এরপর সালাম ফিরাবে। আরেকটি মত হল, উভয় সালাম ফিরানো পর্যন্ত হাত বেঁধে রাখবে। সালাম ফিরানোর পর উভয় হাত ছেড়ে দিবে।
সুতরাং জানাজা নামাযে সালাম ফিরানোর সময় উপর্যুক্ত যে কোনো পদ্ধতিই অবলম্বন করা যেতে পারে। তবে অধিকাংশ ফকিহ এর ভাষ্য অনুযায়ী দ্বিতীয় মতটি আমলের ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। অনেকে আরও একটি পদ্ধতির কথা বলেন এবং কোন কোন এলাকায় তার প্রচলনও রয়েছে, অর্থাৎ ডানদিকে সালাম ফিরিয়ে ডান হাত ছেড়ে দেওয়া এবং বাম দিকে সালাম ফিরিয়ে বাম হাত ছাড়া তা দলিলের নিরিখে তা সহিহ নয়।
-খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/২২৫; আসসিআয়াহ ২/১৫৯; হেদায়া, ফাতহুল কাদীর ১/২৫০; আদ্দুররুল মুখতার ১/৪৮৭-৪৮৮
দাফন করার নিয়ম-
• মৃত ব্যক্তির লাশ কবরের পশ্চিম পার্শ্বে রাখবে।
• কেবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে মৃতব্যক্তিকে সতর্কতার সাথে নামাবে।
• কবরে রাখার সময় নিম্নোক্ত দুআ পড়া মুস্তাহাব।
بسم الله و على ملة رسول الله
অর্থঃ আল্লাহর নামে, আল্লাহর রাসুলের ধর্মের উপর তাকে রাখলাম।
• মৃতব্যক্তিকে কেবলামুখী করে ডান কাতে শুইয়ে দেয়া সুন্নাত। চিত করে শুইয়ে শুধু মুখ কেবলামুখী করা যথেষ্ট নয়।
• কবরে রাখার পর কাফনে যে গিরা দেয়া হয়েছিল তা খুলে দিবে।
• মহিলাকে কবরে রাখার সময় পর্দা করা মুস্তাহাব। তবে যদি শরীর প্রকাশ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে পর্দা করা ওয়াজিব।
• কাঠ, বাঁশ, কাগজ ইত্যাদি দিয়ে ঢেকে দিবে এবং ফাঁকাগুলো বন্ধ করে দিবে।
• তারপর মাটি ফেলবে। মাথার দিক থেকে মাটি ফেলা মুস্তাহাব।
• প্রত্যেক ব্যক্তি উভয় হাতে মাটি নিয়ে ৩ বার ফেলবে। প্রথমবার ফেলার সময় (তোমাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে), দ্বিতীয়বার (এখানেই তোমাকে ফিরিয়ে আনা হল), তৃতীয়বার (এখান থেকেই তোমাকে পুনরায় বের করা হবে) পড়বে।
• কবরের উপরের দিক এক বিঘত বা তার চেয়ে বেশি পরিমাণ উঁচু করা মুস্তাহাব।
• মাটি দেয়া শেষ হলে কবরের উপর পানি ছিটিয়ে দিবে। দাফন শেষ হলে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন তেলাওয়াত, দুআ, তাসবিহ পড়া মুস্তাহাব।
কবর খনন পদ্ধতি-
• যে-সব জায়গার মাটি শক্ত ও মজবুত সেসব জায়গায় লাহদ (বোগলি) কবর খনন করা সুন্নত।
সেটা হল-স্বাভাবিকভাবে চার কোনা করে মাটি খোড়ার পর নিচে পশ্চিম (কিবলার) দিক দিয়ে একটি গর্ত করবে এবং পশ্চিম দিকের ঐ গর্তের মধ্যে লাশ রাখবে।
• যে-সব জায়গার মাটি নরম, লাহদ কবর করলে মাটি ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা আছে, সেসব জায়গায় সিন্দুক কবর করবে। অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবে চার কোনা করে মাটি খোড়ার পর নীচের দিকে গিয়ে মাঝ বরাবর একটি গর্ত করবে এবং সেখানে লাশ রাখবে।
আর কবরের গভীরতা সর্বনিম্ন নাভি পর্যন্ত থেকে সর্বোচ্চ একজন মধ্যম গড়নের ব্যক্তি দু’হাত উপরে তুলে দাঁড়ালে যতটুকু লম্বা হয় ততটুকুর মধ্যে রাখবে। তবে উপরের পরিমাণের মধ্যে যে এলাকায় যেটা প্রচলন সে এলাকায় সে পরিমাণই গভীর করা উচিত।
কবরের দৈর্ঘ্য হবে মৃতের দৈর্ঘ্য সমান এবং প্রস্থ হবে দৈর্ঘ্যের অর্ধেক বা তার চেয়ে কিছুটা কম।
-সহিহ মুসলিম, হাদিস-৯৬৬; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৬৬
—
হাফেজ মাও. মুফতি জুবায়ের হাসান
ইমাম ও খতিব (অ.দা.), কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা-৯২০৩, বাংলাদেশ
মোবাইলঃ ০১৯২০ ৬৫০৭৯৯, ০১৭৯৫ ৫৯৭৭৭৫
ই-মেইলঃ mh.zubair.hasan@gmail.com