জানাযার নামায আদায় সংক্রান্ত মাসআলাঃ
• এই নামায ফরজে কিফায়া। সমাজের কিছু লোক অথবা শুধুমাত্র একজন ব্যক্তিও যদি আদায় করে নেয়, তাহলে সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। কেননা জানাযার জন্য জামাত হওয়া শর্ত নয়। কিন্তু কেউ যদি আদায় না করে, সেক্ষেত্রে সকলে গুনাহগার হবে। -বাদায়েউস সানায়ে ১/৪৬
• পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জন্য যেমন সময় নির্ধারিত রয়েছ, জানাযার জন্য অনুরূপ কোন সময় নির্ধারিত নেই। বরং যখনই জানাযা উপস্থিত হবে তখনই তা আদায় করা সহীহ হবে। এমনকি নিষিদ্ধ ওয়াক্তসমূহেও জানাযার নামায আদায় করতে সমস্যা নেই। তবে অন্যান্য নামাযের মত শরীর, কাপড় ও স্থান পাক থাকা, কিবলামুখী হওয়া ও নিয়ত করা ইত্যাদি জরুরি। -রদ্দুল মুহতার ৩/১০৩
• জানাযার নামাযের ইমামতির জন্য ইমামকে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া শর্ত। জানাযার ক্ষেত্রেও অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির ইমামতি সহীহ নয়। -আদ্দুররুল মুখতার ৩/১০৪
• জানাযা নামায কেবলমাত্র একবার পড়াই বিধান। এক মৃতের একাধিক জানাযা নামায সুন্নাহসম্মত নয়। সুতরাং মৃতের অলী জানাযা পড়ে নিলে বা তার সম্মতিতে জানাযা পড়া হয়ে গেলে দ্বিতীয় বার জানাযা পড়া বিদআত ও মাকরূহ। নাফে রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَانَ ابْنُ عُمَرَ إِذَا انْتَهَى إِلَى جِنَازَةٍ وَقَدْ صُلِّيَ عَلَيْهَا دَعَا وَانْصَرَفَ وَلَمْ يُعِدِ
الصلاة
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. কোনো জানাযায় পৌঁছতে পৌঁছতে জানাযা নামায শেষ হয়ে গেলে মৃতের জন্য দুআ করে ফিরে আসতেন। দ্বিতীয় বার জানাযা পড়তেন না। (মুছান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৬৫৪৫।
বিখ্যাত তাবেঈ ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. এক মাইয়েতের একাধিক জানাযা পড়তে নিষেধ করেছেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ১২০৭০)
عَنِ الْحَسَنِ ، أَنْهُ كَانَ إِذَا سُبِقَ بِالْجِنَازَةِ يَسْتَغْفِرُ لَهَا وَيَجْلِسُ أَوْ يَنْصَرِفُ
হাসান বসরী রাহ. সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি মৃতের জানাযা নামায না পেলে মৃতের জন্য ইসতেগফার করতেন। অতপর বসতেন অথবা ফিরে যেতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, ১২০৭১)
সালেহ ইবনে নাবহান রাহ. বলেন,
كَانَ أَصْحَابُ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا تَضَايَقَ بِهِمَ الْمَكَانُ رَجَعُوا ، وَلَمْ يُصَلُّوا
সাহাবাগণ রা. জানাযা নামাযের জায়গা সংকীর্ণ হলে (মসজিদে) নামায না পড়ে ফিরে যেতেন, (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ১২০৯৭)
এসব বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, সাহাবা তাবেঈনের যুগে দ্বিতীয়, তৃতীয় জানাযার প্রচলন ছিল না। একাধিক জানাযা যদি জায়েয হত তবে তারা ফিরে যেতেন না।
মৃতের জানাযা নামায হয়ে যাওয়ার পর হাদীসের নির্দেশনা মোতাবেক লাশ দ্রুত দাফন করে দেওয়া শরীয়তের নির্দেশ। দ্বিতীয় বা তৃতীয় জানাযার জন্য লাশ রেখে দেওয়া নিয়ম পরিপন্থী। সুতরাং বর্তমানে যে একবার জানাযা নামায হয়ে যাওয়ার পর পরবর্তীতে জানাযা পড়ার জন্য লাশ রেখে দেয়া হয় বা অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয় এটা শরীয়তসম্মত নয়। এটা সুস্পষ্টভাবে সুন্নাহ ও সালাফের আমল পরিপন্থী। তাই এ থেকে বিরত থাকা কর্তব্য।
-আলমাবসূত, সারাখসী ২/৬৭; শরহু মুখতাসারিত তহাবী ২/২১৮; বাদায়েউস সানায়ে ২/৪৭; ইলাউস সুনান ৮/২৮৮
জানাযা নামায সহীহ হওয়ার জন্য লাশ সামনে উপস্থিত থাকা আবশ্যক। অনুপস্থিত লাশের গায়েবানা জানাযা নামায আদায়ের বিধান নেই। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর জীবদ্দশায় অসংখ্য সাহাবী মদীনার বাইরে দূর-দূরান্তে শহীদ হয়েছেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে তাদের গায়েবানা জানাযা পড়ার কোনো ঘটনা বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নেই। অথচ রাসূলুল্লাহ ﷺ সাহাবায়ে কেরামের জানাযা নামায পড়ার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী ছিলেন। এজন্য তিনি বলে দিয়েছিলেন যে-
مَا مَاتَ مِنْكُمْ مَيْتٌ مَا كُنْتُ بَيْنَ أَظْهُرِ كُمْ إِلَّا أَذَنْتُمُونِي بِهِ فَإِنْ صَلَاتِي عَلَيْهِ رَحْمَةٌ
তোমাদের কেউ মারা গেলে আমাকে জানাবে। কেননা আমার জানাযা নামায মৃতের জন্য রহমত। (সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৩০৮৩)
তদ্রূপ খোলাফায়ে রাশেদীন থেকেও গায়েবানা জানাযা নামায পড়ার প্রমাণ নেই। অথচ তাদের খেলাফতকালে বিভিন্ন মুজাহিদ শহীদ হয়েছেন। গায়েবানা জানাযা নামায যদি সুন্নাহসম্মত হত তাহলে সাহাবীগণ অবশ্যই উক্ত সুন্নাহর অনুসরণ করতেন। কখনো পরিত্যাগ করতেন না।
আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রাহ. যাদুল মাআদ গ্রন্থে লেখেন, অনুপস্থিত লাশের গায়েবানা জানাযা নামায রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাহ ও আদর্শ ছিল না। কেননা অসংখ্য মুসলমান দূর-দূরান্তে ইন্তেকাল করেছেন। কিন্তু তিনি তাদের গায়েবানা জানাযা পড়েননি। (যাদুল মাআদ ১/১৪৮)
সুতরাং বর্তমানে যেসব অনুপস্থিত লাশের গায়েবানা জানাযা পড়া হয় তা সুন্নাহসম্মত নয় এবং সালাফের আমলের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তাই এ প্রথা অবশ্যই বর্জনীয়।
উল্লেখ্য যে, কেউ কেউ গায়েবানা জানাযা প্রমাণ করার জন্য রাসূলে কারীম ﷺ কর্তৃক নাজাশী রা. -এর জানাযা পড়াকে দলীল হিসেবে পেশ করতে চান। কিন্তু পুরো বিষয়টা সামনে রাখলে এ কথা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, নাজাশীর জানাযা পড়ার ঘটনাটি বর্তমানে প্রচলিত গায়েবানা জানাযার জন্য দলীল হতে পারে না। কারণ সেটি ছিল বিশেষ একটি ঘটনা, যা ব্যাপকভাবে গায়েবানা জানাযা জায়েয হওয়াকে প্রমাণ করে না। এছাড়া মুসনাদে আহমদ ও সহীহ ইবনে হিব্বানে নাজাশীর জানাযা সম্পর্কিত একটি হাদীস দ্বারা বোঝা যায় যে, নাজাশীর লাশ কুদরতিভাবে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সামনেই উপস্থিত ছিল।
ইমরান ইবনে হুসাইন রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, তিনি বলেন,
إِنْ أَخَاكُمُ النَّجَاشِيَ تُوُفِّيَ فَصَلُّوا عَلَيْهِ. قَالَ: فَصَفْ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَصَفَفْنَا خَلْفَهُ فَصَلَّى عَلَيْهِ، وَمَا نَحْسِبُ الْجِنَازَةَ إِلَّا مَوْضُوعَةٌ بَيْنَ يَدَيْهِ
তোমাদের ভাই নাজাশী ইন্তেকাল করেছে। সুতরাং তোমরা তার জানাযা আদায় কর। ইমরান রা. বলেন, অতপর রাসূলে কারীম ﷺ দাঁড়ালেন। আর আমরা তাঁর পেছনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালাম। অতপর তিনি তার জানাযা পড়ালেন। আমাদের মনে হচ্ছিল যে, নাজাশীর লাশ তাঁর সামনেই রাখা ছিল। -মুসনাদে আহমদ, হাদীস ২০০০৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৩০৯৮
আর অনেক মুহাদ্দিস নাজাশীর জানাযা সংক্রান্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেছেন, এ ঘটনাটি বিশেষ এক প্রয়োজনের কারণে সংঘটিত হয়েছিল। তা হল, নাজাশীর মৃত্যু হয়েছিল এমন এক ভূখণ্ডে যেখানে তার জানাযা পড়ার মতো কোনো (মুসলিম) ব্যক্তি ছিল না। তাই আল্লাহর রাসূল ﷺ সাধারণ নিয়মের বাইরে তার জানাযা পড়িয়েছেন।
উলামায়ে কেরাম এ ঘটনার আরো অন্যান্য ব্যাখ্যাও প্ৰদান করেছেন। যা হোক, এটা ছিল নববী জীবনের স্বাভাবিক রীতি বহির্ভূত মাত্র একটি ঘটনা। এর উপর ভিত্তি করে ব্যাপকভাবে প্রচলিত গায়েবানা জানাযাকে বৈধ বলার সুযোগ নেই। কেননা অনুসৃত সুন্নাহর সাথে এটির কোনো মিল নেই।
এছাড়া যে লাশের কোথাও জানাযার ব্যবস্থা আছে এবং তার জানাযা হয়েছে বা হচ্ছে তার গায়েবানা জানাযা পড়ার একটি ঘটনাও হাদীসের কিতাবে পাওয়া যায় না। তাই এটি অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
-সহীহ বুখারী, হাদীস ৪০৯০; নাসবুর রায়া ২/২৮৩; যাদুল মাআদ ১/৫০২; উমদাতুল কারী ৮/১১৯; ফয়যুল বারী ২/৪৭০; ফাতহুল কাদীর ২/৮০, ৮১; আলমাবসূত, সারাখসী ২/৬৮; বাদায়েউস সানায়ে ২/৪৮; রদ্দুল মুহতার ২/২০৯; ইলাউস সুনান ৮/২৮৩
জানাযার ফরজ ও সুন্নাতঃ
জানাযার ফরজ ২টিঃ
(১) ইমাম ও মুক্তাদি সকলের জন্য চার তাকবীর বলা। (২) দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করা। -শামী -৩/২০৯
জানাযার সুন্নাত ৩টিঃ
(১) সানা পড়া।
(২) দরূদ শরীফ পড়া।
(৩) মায়্যিতের জন্য নির্ধারিত দু’আ পড়া।
জানাযা সহীহ হওয়ার জন্য শর্ত দুই ধরণেরঃ
যে সকল শর্ত নামাযীদের মাঝে পাওয়া জরুরি-
যে সকল শর্ত নামাযীদের মাঝে পাওয়া জরুরি তা ০৬ (ছয়) টিঃ
(১) শরীর পাক।
(২) কাপড় পাক।
(৩) নামাযের স্থান পাক।
(৪) ছতর আবৃত থাকা।
(৫) কেবলামুখী হওয়া।
(৬) নিয়ত করা।
যে সকল শর্ত মৃতের মাঝে পাওয়া জরুরি তাও ০৬ (ছয়) টিঃ
(১) মৃতের মুসলমান প্রমাণিত হওয়া।
(২) মৃতের শরীর এবং কাফন নাপাকী থেকে পবিত্র হওয়া। (তবে হ্যা, যদি গোসল ও কাফন সম্পন্ন করার পরে নাপাকী নির্গত হয়, তাহলে কোন সমস্যা নেই, নামায সহীহ হয়ে যাবে। উক্ত নাপাকী ধৌত করা জরুরি নয়।)
(৩) মৃতের সতর আবৃত থাকা।
(৪) মৃতের লাশ নামাযীদের সম্মুখে উপস্থিত থাকা। (যদি নামাযীদের পেছনে থাকে, তাহলে জানাযা সহীহ হবে না।)
(৫) মায়িত/লাশ বহনের খাটিয়া জমিনে থাকা। (সুতরাং বিনা ওজরে জমিন থেকে উপরে অথবা কোন যানবাহনে লাশ রাখলে, জানাযা সহীহ হবেনা।
(৬) মৃতের লাশ জানাযার স্থানে উপস্থিত থাকা। (সুতরাং যদি জানাযার স্থান থেকে লাশ অনুপস্থিত থাকে, তাহলে জানাযা সহীহ হবেনা। অতএব, ‘গায়েবানা জানাযা’ যা কোন কোন এলাকায় প্রচলন রয়েছে, তা জানাযার সঠিক পদ্ধতি নয়। -আলবাহরুর রায়েক ২/৩১৫; মাজমাউল আনহুর ১/১৮২
লেখক : হাফেজ মাও. মুফতি জুবায়ের হাসান