মারা গেছেন সাড়ে ৩ বছর আগে। মাস কয়েক আগে তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেছে পরিবার। অথচ ২৮ অক্টোবর বিএনপি’র মহাসমাবেশ থেকে ফেরার পথে মৌচাকে পুলিশের উপর ককটেল ছুড়ে নাশকতা মামলার আসামি হয়েছেন বিএনপি’র সাবেক আইন বিষয়ক সম্পাদক প্রয়াত এডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া। রামপুরা থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) মো. আব্দুর জলিল বাদী হয়ে এ মামলাটি করেন। মামলায় ২৪১ জন আসামির মধ্যে এডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়াকে ২২৬ নন্বর আসামি করা হয়। একই মামলায় ১ বছর আগে মারা যাওয়া মো. নাসির রহমান নামের আরও এক ব্যক্তিকেও আসামি করা হয়েছে। নাসির রামপুরা থানার ২৩নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এজাহারে তাকে ৮৮ নম্বর আসামি দেখনো হয়। এদিকে মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিস্ফোরক আইনে মামলা হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়ার পরিবার।
এডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়ার বড় ছেলে শফিকুর রহমান রানা বলেন, আমার বাবা মহামারি করোনা শুরু হওয়ার আগেই মারা গেছেন। প্রায় সাড়ে ৩ বছর হয়েছে। মৃত্যুর এতদিন পরে কীভাবে একজন মানুষ ককটেল ছোড়ে এটা আমার বোধগম্য নয়। বাবার নামে মামলা হয়েছে, এজাহার দেখে আমিও অবাক হয়েছি। মামলার এজাহারে যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা আমাদের রামপুরার বাসার ঠিকানা।
এই মামলার ২৭ নম্বর আসামি রামপুরা থানা যুবদলের আহ্বায়ক কামাল আহমেদ দুলু বলেন, এগুলো সব গায়েবি মামলা। ওইদিন রামপুরা এলাকায় এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। কিন্তু মামলা ঠিকই হয়েছে। ২০১৮ সালের একটি নাশকতার মামলায় সানাউল্লাহ স্যার আসামি ছিলেন। ওই মামলায় আমিও আসামি ছিলাম। এজাহার দেখে মনে হচ্ছে, আগের মামলাটি কপি পেস্ট করে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। শুধুমাত্র নতুন একটি তারিখ দেয়া হয়েছে। বাকি সব ঠিক আছে।
এদিকে দুটি এজাহার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে রাজধানীর রামপুরা থানায় হওয়া একটি নাশকতার মামলা নং ৪৫(৯)১৮ সঙ্গে বিএনপি’র মহাসমাবেশের পরদিন গত ২৯শে অক্টোবরের ২৯(১০)২৩ মামলার হুবহু মিল রয়েছে। দুটি মামলার ঘটনাস্থল, অপরাধের ধরন, ধারা ও আসামিরা প্রায় একই। শুধুমাত্র আসামিদের ক্রমিক কিছুটা অদলবদল করা হয়েছে। কাউকে আগে আনা হয়েছে, কাউকে পেছনে নেয়া হয়েছে। তবে মামলা দুটির বিবরণ অনুরূপ রাখা হয়েছে। ২০১৮ সালের মামলায় এডভোকেট সানাউল্লা মিয়াকে ২০০ নম্বর আসামি করা হলেও ২৯ তারিখের মামলায় তাকে ২২৬ নন্বর আসামি দেখানো হয়েছে। মামলায় হত্যার উদ্দেশ্যে পুলিশের উপর ককটেল ছোড়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।
আইনজীবী সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, এজাহারে স্যারের নাম দেখে লজ্জিত হয়েছি। এটা কীভাবে সম্ভব হলো? সানাউল্লাহ মিয়া কি কোনো সাধারণ ব্যক্তি? তিনি একজন পাবলিক ফিগার ছিলেন। তাহলে মারা যাওয়ার পরেও তার নাম কীভাবে এজাহারে আসে?
বিএনপি’র আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, আসলে পুরো দেশটাই এখন কারাগার। মৃত জীবিত কেউই মামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। তবে একটি প্রশ্ন হলো সানাউল্লাহ মিয়া কি কোনো সাধারণ মানুষ? তাকে কীভাবে এজাহারভুক্ত করা হয়। এটা তার পরিবারকে হেয় করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবেই করা হয়েছে। আমরা এ ঘটনার নিন্দা জানাই।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, বিএনপি জামায়াতের মহাসমাবেশের দিন সমাবেশস্থল থেকে নাশকতা, হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও সরকারি সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করে পালিয়ে এসে আসামিরা মালিবাগ মোড়ে ১৪০০ থেকে ১৫০০ জন লোক জড়ো হয়। পরে তারা মৌচাক মার্কেটের দিক হতে পুলিশের উপর আক্রমণ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও ককটেল ছুড়তে ছুড়তে মালিবাগ রেলগেট পার হয়ে এসে রামপুরা পুলিশ বক্সে হামলা করে ক্ষতিসাধন করে। পুলিশ বাধা দিতে গেলে তাদের উপর চড়াও হয়ে ইটপাটকেল ও ৮ থেকে ১০টি ককটেল নিক্ষেপ করে পুলিশকে হত্যার চেষ্টা করে। রাস্তার উপর গুরুতর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দাঙ্গা সৃষ্টি করে পুলিশের কাজে বাধা প্রদান করেন। আসামিদের সহিংসতায় এএসআই মো. রাজন শেখ, জয়নাল আবেদিন, মো. জসিম উদ্দিন গুরুতর আহত হয়ে মুগদা হাসপাতালে ভর্তি হন। এতে ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ বিপুল পরিমাণ ককটেল, ইটের টুকরো, কাঁচের টুকরো, লোহার পাইপ ও রামদা উদ্ধার করে। এ ঘটনায় পেনাল কোডের ১৪৩/১৪৭/১৪৮/১৪৯/১৮৬/৪২৭/৩৫৩/৩৩২/৩৩৩/৩০৭/১১৪সহ ১৯০৮ সালের বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের ৩/৪/৬ ধারায় অভিযোগ আনা হয়।
উল্লেখ্য, এডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া দীর্ঘদিন আইন পেশার পাশাপাশি বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। এক এগারো সরকারের সময় খালেদা জিয়ার মামলা পরিচালনা করে সবার নজরে আসেন। বিএনপি’র আইন বিষয়ক সম্পাদক থাকার সময় তিনি কয়েকটি মামলার আসামি হন। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর স্ট্রোক করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কয়েক মাস হাসপাতালে ভর্তি থেকে ২০২০ সালের ২৭শে মার্চ তিনি মারা যান। সানাউল্লাহ মিয়া জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। তিনি ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন।
খুলনা গেজেট/এনএম