বৃটিশ শাসন আমল (১৮৫৭-১৯৪৭)। তখন খুলনা শহরের পরিধি স্বল্প পরিসরের। যশোর থেকে পৃথক হয়ে ১৮৮২ সালে খুলনা পৃথক জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৮৮৬ সালে খ্রীষ্ট্রান ধর্ম প্রচারের জন্য কয়েকজন ধর্মযাজক খুলনা অঞ্চলে আসেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ইউ বিয়াস্কী। কৃষ্ণনগর ধর্ম প্রদেশের অধীনে খুলনা শহরকে কেন্দ্র করে তারা জনকল্যাণমূলক কাজে সম্পৃক্ত হন। বৃটিশ জামানায় ভারত বর্ষে তখন লর্ড লিনলিথগাও (১৯৩৬-১৯৪৩) ভাইসরয়। তিনি খ্রীষ্টান ধর্মালম্বীদের কিছু সুযোগ সুবিধা দেন। কৃষ্ণনগরের মিশনের কর্মকর্তারা ১৯৩৯ সালে খুলনা শহরের আহসান আহম্মেদ রোডে কিছু জায়গা কেনেন। ১৯৪০ সালে খানজাহান আলী রোড ও আহসান আহম্মেদ রোডের সংযোগস্থলে কেনা জায়গায় গড়ে ওঠে সেন্ট যোসেফস এম ই স্কুল। পরবর্তীতে নামকরণ করা হয় সেন্ট যোসেফস হাইস্কুল। (ড. শেখ গাউস মিয়া রচিত মহানগরী খুলনা ইতিহাসের আলোকে) ।
বৃটিশ জামানা থেকে আজ পর্যন্ত এটি মেধাবী শিক্ষার্থীদের পীঠস্থান। ৮৩ বছর বয়সী এ প্রতিষ্ঠান ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণ আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা স্মৃতি ধারণ করে আসছে। এখানকার শিক্ষার্থী প্রয়াত এড. মনোরঞ্জন দাস (পরবর্তীতে খুলনা জেলা ছাত্রলীগের আহবায়ক ও ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী) ও মোহাম্মাদ মাজহারুল হান্নান (পরবর্তীতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ) ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেঃ মোঃ আইয়ুব খানের আমলে এখানে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন দানা বাঁধে। বিশেষ করে রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান নামক মামলা দায়েরের পর এখানকার শিক্ষার্থীরা ফুঁসে ওঠে। ৬৯`র প্রেক্ষাপটের স্মৃতিচারণ করে এখানকার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী জালাল উদ্দিন রুমী (এখন খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য) বলেন, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে আসলেই সব শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা ক্লাশ বর্জন করে রাস্তায় নামত। শিক্ষার্থীদের কন্ঠে শ্লোগান “জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।” তিনি উল্লেখ করেন, এখানকার প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় রাজনীতিতে অবদান রাখেন। বিশেষ করে ১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে প্রাক্তন শিক্ষার্থী শেখ আব্দুস সালাম, স ম বাবর আলী, এড. মনোরঞ্জন দাস, ইস্কান্দার কবীর বাচ্চু, শেখ আব্দুল কাইয়ুম বলিষ্ঠ সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা খুলনা জেলা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব পর্যায়েও ভূমিকা রাখেন। পূর্ব পাকিস্তান জামানার সর্বশেষ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। এ অভূতপূর্ব বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়া শুরু করে। একপর্যায়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেঃ আগা ইয়াহিয়া খান একাত্তরের ৩ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশন আহবান করেন। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়, একাত্তরের ১ মার্চ। সকাল থেকে খুলনা শহরে ইথারে ইথারে খবর ভেসে আসে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট রেডিও ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। দুপুর ১টা নাগাদ প্রেসিডেন্টের ভাষণের পরিবর্তে রেডিওতে জাতীয় সংসদের ৩ মার্চ এ অধিবেশন স্থাগিতের ঘোষণা প্রচারিত হয়। রেডিওতে এ ঘোষণার প্রতিবাদে খুলনা শহরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছাত্রজনতা জঙ্গি মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। স্বোচ্চার কণ্ঠে ছাত্র জনতার শ্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ছয় দফা না এক দফা স্বাধীনতা স্বাধীনতা, বীর বাঙালি অস্ত্রধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে শহরে দেওয়াল লিখনের প্রয়োজন হয়। মার্চের প্রথমে গভীর রাতে দেওয়াল লিখনের নেতৃত্ব দেন জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক ও এ প্রতিষ্ঠনের প্রাক্তন শিক্ষার্থী শেখ আব্দুল কাইয়ুম। অন্যানের মধ্যে অংশ নেন এ প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থী আ ব ম নূরুল আলম, অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী সুশান্ত কুমার, নন্দী, আব্দুস সবুর, তালুকদার আব্দুল খালেক, ইউসুফ আলী ভুইয়া, নুরুল ইসলাম খোকন ও শামসুদ্দোহা টিপু। ছাত্রলীগ এতে মুখ্য ভুমিকা পালন করে। শহরের আহসান আহমেদ রোডস্থ টি এন্ড টি অফিস (অধুনালুপ্ত), পিকচার প্যালেস ভবন, নগর ভবন ও তৎকালীন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান (আজকের বাংলাদেশ ব্যাংক), খুলনার প্রধান গেটে গভীর রাতে দেওয়াল লিখন হয়।
সেন্ট যোসেফস হাইস্কুলের প্লাটিনাম জুবলী উপলক্ষে স্মরণিকা জ্যোতিতে বিদ্যালয়ের ইতিহাস নামক প্রবন্ধে সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ অহিদুল্লাহ উল্লেখ করেন, ১৯৭১ সালের ১৮ জানুয়ারি অমিয় গাব্রিয়েল মল্লিক প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদেন (তিনি প্রথম বাঙালি প্রধান শিক্ষক)। এ সময়ের শিক্ষকরা হচ্ছেন মহিউদ্দিন আহমেদ গোরা, বীরেন্দ্র নাথ রায়, পরিমল রঞ্জন দাস, মোঃ হাবিবুর রহমান, এসএম রফিকুল আলম মানিক, আব্দুল জব্বার খান, নৃপেন্দ্র কুমার দেবনাথ, অজিত কুমার সাহা, রতন কুমার সাহা, সিরাজুল ইসলাম, রমেশ চন্দ্র দেবনাথ, হিমাংশু কীর্ত্তনিয়া, ওয়ালিউর রহমান, মাওলানা খেলাফত হোসেন, এসএম মনজিলুর রহমান, দুলাল কৃষ্ণ দাস, কালি কিংকর সাহা, জলধর সরকার, গাব্রিয়েল হাওলাদার, সমেরন্দ্র নাথ ফৌজদার, আজিম উদ্দিন আহমেদ প্রমূখ।
১ মার্চ সরকারী বিএল কলেজে বিএ অনার্স পরীক্ষা চলছিল। কলেজের অধ্যক্ষ এবি চৌধুরী সে দিন বেতারের ঘোষণা এবং সংসদ অধিবেশন স্থাগিতের খবর পরীক্ষার্থীদের অবহিত করেন। খবর পেয়ে এ প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও বিএল কলেজ ছাত্র সংসদের তৎকালীন ভিপি স ম বাবর আলীর নেতৃত্বে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা বর্জন করেন। তারা কলেজ অঙ্গন থেকে জঙ্গি মিছিল বের করে। বিকেলে ছাত্রলীগের উদ্যোগে আযমখান কমার্স কলেজ থেকে বিক্ষোভ মিছিল হাদিস পার্কের উদ্দেশ্যে বের হয়।
৩ মার্চ স্বাধীনতার দাবিতে স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল পার্ক ( আজকের শহীদ হাদিস পার্ক) থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জঙ্গি মিছিল বের হয়। লোয়ার যশোর রোডস্থ টেলিফোন এক্সচেঞ্জ থেকে বেলুচ পুলিশ মিছিলের ওপর গুলি চালায়। গুলিতে সাত জন শহীদ হয়। মিছিলের নেতৃত্ব দেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আব্দুল আজিজ, সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান খান, জাতীয় পরিষদের সদস্য সালাহ উদ্দিন ইউসুফ, এম এ গফুর, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এ্যাডভোকেট মোমিন উদ্দীন আহমেদ, এড. মোঃ এনায়েত আলী সানা, জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকু, ছাত্রলীগ নেতা বিএল কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি ও সেন্ট যোসেফস হাইস্কুলের প্রাক্তন ছাত্র স ম বাবর আলী প্রমূখ।
৩ মার্চ বিকেলে ছাত্র সমাজ শহরের কালীবাড়ি রোড ও কেডি ঘোষ রোডের কয়েকটি বন্দুকের দোকান লুট করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করে। এতে অন্যান্যের মধ্যে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থী শেখ আব্দুল কাইয়ুম, ইঞ্জিনিয়ার সাইফুল ইসলাম, মতিউর রহমান তরফদার অংশ নেন। ৭ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের খুলনা কমিটি গঠিত হয়। ছাত্রলীগের মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণে এখানে আহবায়ক মনোনিত করা সম্ভব হয়নি। বিএল কলেজ ছাত্র সংসদের তৎকালীন ভিপি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী স ম বাবর আলী ও হুমায়ুন কবীর বালুকে যুগ্ম আহবায়ক করা হয়। এ কমিটির সদস্যরা হচ্ছেন শেখ আব্দুল কাইয়ুম ( প্রাক্তন ছাত্র, সেন্ট যোসেফস হাইস্কুল), ইস্কান্দার কবীর বাচ্চু (প্রাক্তন ছাত্র, সেন্ট যোসেফস হাইস্কুল), শেখ শহীদুল হক, হায়দার গাজী সালাউদ্দিন রুনু, হেকমত আলী ভুঁইয়া, শাহ আবুল কালাম, ফ ম সিরাজ, মাহবুবুল আলম হিরণ, শেখ শওকত আলী ও মিজানুর রহমান। ছাত্রলীগের ত্যাগী কর্মীদের নিয়ে জয় বাংলা বাহিনী গঠন করা হয়। জয় বাংলা বাহিনীর প্রধান ছিলেন জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক ও এ প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ছাত্র শেখ আব্দুল কাইয়ুম। এ বাহিনী জিলা স্কুল মাঠে প্রতিদিন বিকেলে স্কুলের ক্যাডেটদের ডামী রাইফেল নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীরা হচ্ছেন, ইউসুফ আলী ভুঁইয়া, আব্দুস সবুর, নুরুল ইসলাম খোকন, সাখাওয়াত হোসেন, শামছুদ্দোহা টিপু প্রমূখ। ২৩ মার্চ সকাল ১০টায় সাদা পোষাকে সুসজ্জিত হয়ে জয় বাংলা বাহিনী মিউনিসিপ্যাল পার্কে উপস্থিত হয়।
জয় বাংলা বাহিনীর প্রধান, এ প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থী শেখ আব্দুল কাইয়ুম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। খুলনায় এই প্রথম পতাকা উত্তোলন। পাকিস্তানী বাহিনী প্রথমে সার্কিট হাউসে পর্যায়ক্রমে নূরনগর, শিপইয়ার্ড, পিএমজি, রুজভেল্ট জেটি, খালিশপুর পিপলস মিল, আজকের অফিসার্স ক্লাব ও গল্লামারীস্থ বেতার কেন্দ্রে সেনা ছাউনী ফেলে। এখানে পাকবাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন ২২ রেজিমেন্টের লেঃ কর্ণেল শামস। তার নেতৃত্বে স্বাধীনতা প্রত্যাশীদের তালিকা ও হত্যার নীল নকশা তৈরি হয়।
বঙ্গবন্ধুর পূর্ব নির্দেশ মোতাবেক স্থানীয় ছাত্র-যুবকরা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ২৬ মার্চ খানজাহান আলী রোডস্থ কবীর মঞ্জিলে ( আলিয়া মাদ্রাসার অদূরে) বিপ্লবী পরিষদের কমিটি গঠন করা হয়। বিপ্লবী পরিষদের কার্যালয় এ প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ইস্কান্দার কবীর বাচ্চুর পৈত্রিক সম্পত্তি। সিদ্ধান্ত হয় এ পরিষদ-ই খুলনা জেলায় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেবে। কমিটির চেয়ারম্যান শেখ কামরুজ্জামান টুকু। সদস্যবৃন্দ কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা এ্যাড: কেএম জামান, বিএল কলেজ ছাত্র সংসদের তৎকালীন ভিপি স ম বাবর আলী, শেখ আব্দুল কাইয়ুম ও ডা. অশিকুর রহমান।
পাকবাহিনী ২৬ মার্চ সকাল থেকে খুলনা শহরে কনভয়যোগে টহল দিতে শুরু করলে বিপ্লবী পরিষদের সদর দপ্তর খানজাহান আলী রোড থেকে পূর্ব রূপসায় স্থানান্তর করা হয়। রূপসা নদীর পূর্ব পাড়ে রেলস্টেশনের পাশে জাহানারা মঞ্জিলে বিপ্লবী পরিষদের চেয়ারম্যান অবস্থান নেন। এখানেই গড়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প, এটাই জেলার প্রথম ক্যাম্প। ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ৪ এপ্রিল গল্লামারীস্থ রেডিও পাকিস্তান, খুলনা কেন্দ্র দখলের জন্য যুদ্ধ করে। বেতার কেন্দ্র দখলের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যায়। ভারতের হাফলং ও দেরাদুনে মুজিব বাহিনীর অধিনায়ক (দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল) তোফায়েল আহমেদের তত্ত্বাবধায়নে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। শত্রু সেনাদের পরাজিত করার জন্য পর্যায়ক্রমে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে যুদ্ধে অংশ নেয়। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ শিক্ষার্থী মুজিব বাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।
ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিনে শহরের স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। এখানকার শিক্ষার্থীরা অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেয়। তখনকার দিনে মাধ্যমিক পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জিলা স্কুল, সেন্ট যোসেফস হাইস্কুল, মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বিকে ইউনিয়ন ইন্সিটিটিউট, ইকবালনগর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, পল্লীমঙ্গল হাইস্কুল, দৌলতপুর মুহসিন হাইস্কুল, সেনহাটি হাইস্কুল, রূপসার নৈহাটী মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এ প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা হচ্ছেন মরহুম শেখ আব্দুস সালাম, (জেলা মুজিববাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার), স ম বাবর আলী (১৯৭৩ সালে সংসদ সদস্য), মরহুম ইস্কান্দার কবীর বাচ্চু, শেখ আব্দুল কাইয়ুম (জয় বাংলা বাহিনীর প্রধান, খুলনা), মরহুম এ্যাড. শেখ আব্দুস সাত্তার, মরহুম খন্দকার সাজ্জাদ আলী, প্রয়াত এ্যাড. মনোরঞ্জন দাস, আশরাফুল আলম টুটু, এড. আ ব ম নূরুল আলম, তৌফিক উদ্দীন আহমেদ, (শ্রীউলা, সাতক্ষীরা), মেজর (অবঃ) শেখ জামসেদ হোসেন, এম এম ওয়াহিদুন্নবী, বাগমারার প্রয়াত তপন কুমার বিশ্বাস, হুমায়ুন কাদির খান দুলাল, প্রকৌশলী হারুণ অর রশিদ, ড: সরদার নুর নেওয়াজ, ইঞ্জিনিয়ার সাইফুল ইসলাম, মরহুম এড. ফিরোজ আহমেদ (জেলা আইনজীবী সমিতির ,সদস্য), মরহুম খন্দকার খায়রুল কবীর লনি , শেখ মাহতাব আলী, (কাচনা, মোল্লাহাট, বাগেরহাট), আব্দুল্লাহ হিল সাফী, মতিউর রহমান তরফদার, আতিয়ার রহমান তরফদার, মনোয়ার সানি ফরিদ (জার্মান প্রবাসী), বীরেন দাস বিরু (স্বাধীন বাংলা ফুটবল টিম), আনোয়ার কবির, হুমায়ূন কবির বাবুল।
সেন্ট যোসেফস হাইস্কুলের প্লাটিনাম জুবলী উপলক্ষে জ্যোতি নামক স্মরণিকায় স্বাধীনতা সংগ্রামী (প্রাক্তন শিক্ষার্থী) আব্দুল্লাহ হিল সাফী ‘১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের স্কুল’ নামক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ১৯৬৯ সালে ক্লাশ নাইনে পড়াকালীন সময়ে গণ আন্দোলনে অংশ নেই। সেই সাথে ছিল সকল শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ। এটি এ প্রতিষ্ঠানের বড় অর্জন। এ প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৭১ সালে আমি তখন এসএসসি পরীক্ষার্থী। ২৫ মার্চ সারা দেশে গণহত্যা শুরু হলে সহপাঠী মতিউর রহমান তরফদারকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে আশাশুনি হয়ে ভারতে যাই। বিহারের চাকুলিয়ায় ২১দিন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। খুলনার পিপলস জুট মিলের শ্রমিক তৈয়েবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ বাগেরহাটের চিতলমারী পৌঁছায়। পরে সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন তাজুল ইসলামের সাথে যোগ দেই। বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্কুলে ফিরে ১৯৭২ সালে এস এস সি পরীক্ষায় অংশ নেই। এ প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নৃপেন্দ্র নাথ দেবনাথকে রাজাকাররা হত্যা করে।
স্বাধীনতা সংগ্রামী এ প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মতিউর রহমান তরফদার স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে মার্চের প্রথম দিকে খুলনায় বন্দুকের দোকান লুটে সহপাঠী ইঞ্জিনিয়ার সাইফুল ইসলামসহ আমরা কয়েকজন অংশ নেই। গর্বিত স্বাধীনতা সংগ্রামী মতিউর রহমান বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার তেলিখালী গ্রামের লুৎফর রহমান তরফদারের পুত্র (ভারতীয় তালিকায় ক্রমিক নং ৪৪৯৭৪ এবং লাল মুক্তিবার্তা ০৪০৩০৮০০২৯)। তিনি বলেন, ভারতের বিহারের চাকুলিয়ায় প্রশিক্ষণকালীন মাসিক ভাতা ২৫ টাকা ছিল। ১৪ আগস্ট প্রশিক্ষণ শেষে ৩শ’ মুক্তিযোদ্ধার সাথে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করি। বাগেরহাটের রামপালের কালের খাঁর বেড় ও ফকিরহাটের যাত্রাপুর ক্যাম্পে অবস্থান করি। শত্রুদের মোকাবেলা করে আমরা দেশের স্বাধীনতা অর্জন করি।
স্মৃতিচারণের একপর্যায়ে তিনি বলেন, খালিশপুরের চরেরহাট পাকবাহিনীর হাতে আমাদের সহপাঠী দোলখোলার অধিবাসী জাহাঙ্গীর হোসের শহীদ হন।
বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স মুজিব বাহিনী খুলনা জেলা ৭১ গ্রন্থে এ প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ছাত্র এ্যাড: আ ব ম নূরুল আলম উল্লেখ করেন, ৭১’র মার্চের শুরুতেই তৎকালীন স্টেট ব্যাংক, খুলনা ( আজকের বাংলাদেশ ব্যাংক), নগর ভবন ও পিকচার প্যালেস মোড়ে বীর `বাঙ্গালী অস্ত্রধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর” শ্লোগান দেওয়ালে লিখে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে
জনমত সৃষ্টিতে অংশ নেই। তিনি স্মৃতিচারণের একপর্যায়ে উল্লেখ করেন, ১-২৩ মার্চ স্থানীয় পিটিআই মাঠে জয় বাংলা বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। ২৩ মার্চ তিনি পিটিআই মাঠে পতাকা উত্তোলন করেন। ২৫ মার্চ খুলনা জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে খুলনা শহরে প্রাথমিক প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। বিএলএফ’র সদস্য হিসেবে ভারতের হাফলং এ বিশেষ গেরিলা প্রশিক্ষণে অংশ নেন। তিনি সাতক্ষীরার তালা থানার জেঠুয়া, মাগুরা, আশাশুনি থানার বুধহাটা, পাইকগাছা থানার কপিলমুনি যুদ্ধে অংশ নেন। গল্লামারীস্থ রেডিও সেন্টার যুদ্ধে ১৭ ডিসেম্বর অংশ নিয়ে খুলনা শহর শক্রু মুক্ত করেন।
এ প্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সমেরন্দ্র নাথ ফৌজদার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, আমাদের গর্ব সকল শিক্ষকই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন। এমন উদাহরণ অন্যকোন প্রতিষ্ঠানে নেই। তিনি বলেন, ভারতে পৌঁছে শরণার্থী ক্যাম্পে ত্রাণ বিতরণ করেছি। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সহযোগিতা করেছি। ১৯৬৭ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত তিনি এ প্রতিষ্ঠানের গণিত ও ভুগোলের শিক্ষক ছিলেন।
এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা খুলনা ও সাতক্ষীরার বিভিন্নস্থানে বিশেষ করে গল্লামারী বেতার কেন্দ্র, পাইকগাছা হাইস্কুল, বারোআড়িয়া, বুধহাটা, জেঠুয়া, কপিলমুনি, পারুলিয়া, খানজিয়া ও কালিগঞ্জের যুদ্ধে অংশ নেন। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের একটি অংশ খুলনার ফুলতলা থানার ডাবুরের মাঠে, অপর অংশ ঢাকা স্টেডিয়ামে স্বাধীনতার স্থাপতি বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র জমা দেন। এসএসসি পরীক্ষার্থীরা বিজয়ী বেশে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরে মুক্ত বাতাসে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করে বিজয় উল্লাস করে।
তথ্য সূত্রঃ
১। ড. শেখ গাউস মিয়া রচিত মহানগরী খুলনা ইতিহাসের আলোকে
২। স ম বাবর আলী রচিত স্বাধীনতার দূর্জয় অভিযান
৩। সেন্ট যোসেফস এর প্লাটিনাম জুবলীর স্মরণিকা জোত্যি
৪। বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স, মুজিববাহিনী খুলনা জেলা ৭১।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, খুলনা গেজেট ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, খুলনা প্রেসক্লাব।