পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল দল কি এবার মুসলিম ভোটে তাদের একচেটিয়া আধিপত্য হারাচ্ছেন? এইরকম একটা গুঞ্জন কিন্তু সারা পশ্চিমবঙ্গে চাউর হয়েছে। কিন্তু কেন? প্রাথমিক ও প্রত্যক্ষ যে কারণটি বলা যায় সেটা হল, মুসলিমরা মনে করছেন তৃণমূলকে ভোট দেওয়া মানেই সেই প্রতিনিধির বিজেপিতে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অর্থাৎ তৃণমূলের সর্বশেষ পরিণতি বিজেপি হয়ে যাওয়া। ঘাসফুল পরিণত হয়ে যাচ্ছে পদ্মফুলে। আর এই আতঙ্ক মুসলিমদের মধ্যে বেড়ে গেছে কয়েকগুন।
মুসলিমরা এটাও পর্যবেক্ষণ করছেন যে, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে যে বা যারা বিজেপির প্রার্থী ছিলেন তাদের কেউ কেউ তৃণমূলের প্রার্থী। তাহলে তার উপর নির্ভর করবেন কী করে? এই দলবদলের হিড়িক যদি হয় তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোট কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ, তাহলে অভ্যন্তরীণ কারণ আরো কয়েকগুণ।
২০১১ সালে তৃণমূল যখন ক্ষমতায় আসে তখন বলা হয়েছিল সাচার কমিটির রিপোর্টের সুপারিশগুলো যথাযথ কার্যকর করা হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে সাচারকমিটির সুপারিশ ঠিকঠাক কার্যকর করা হয়নি। বামশাসনে যেখানে সংখ্যালঘুদের চাকুরির হার ছিল প্রায় সাড়ে চার শতাংশ, সেখানে তা কমতে কমতে হয়েছে দেড় শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে একটি সাধারণ হিসাবে দেখা যাচ্ছে ত্রিশ শতাংশের কাছাকাছি সংখ্যালঘুদের বসবাস, সেখানে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে চাকুরির হার দুই শতাংশের কম। কলকাতা মহানগরীর এশিয়ার সুপ্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলকাতা মাদ্রাসা কলেজ ২০০৭ সালে আলেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছিল বাম সরকারের আমলেই এবং তা ছিল সংখ্যালঘু মর্যাদাপ্রাপ্ত। আজ সেই আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় তার সংখ্যালঘু মর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে। কলকাতার পার্কসার্কাস-বেনিয়াপুকুর এলাকায় নব্বইয়ের দশকে বামজমানায় সংখ্যালঘু মর্যাদা নিয়ে গড়ে উঠেছিল মিল্লি আল আমিন কলেজ।আজ সেই কলেজের শেষ অবস্থা। কলকাতার বিখ্যাত আব্দুল হালিম লেনে ‘দি ক্যালকাটা ইউনানি মেডিকেল কলেজ-হাসপাতাল’ আজো সরকারি অনুমোদন পেল না। মুসলিমদের আরো ক্ষোভের কারণ এবছরের বিধানসভা নির্বাচনে সংখ্যালঘু অনুপাতে তৃণমূল মনোনয়ন দেয়নি। পশ্চিমবঙ্গে ২৯৪ টি আসনের মধ্যে সংখ্যালঘু অনুপাতে ৮৭ জনের নমিনেশন পাওয়ার কথা, সেখানে মাত্র ৪৩। মুসলিম সমাজে বা মুসলিম এলাকায় কেবল সেন্টিমেন্টের খেলাটি খেলেছেন মমতা দেবী। আর বিজেপির জুজু দেখিয়েছেন। চাকুরি- বাকরি বা সংখ্যালঘু কর্মসংস্থান নিয়ে সেরকম কোনো কিছু করতে পারেননি বলে সংখ্যালঘুদের ক্ষোভ বাড়ছে। বাম-কংগ্রেস ও ফুরফুরার পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকীর আই এস এফ মিলে যে সংযুক্ত মোর্চা হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে আব্বাস সিদ্দিকী এই সব প্রশ্নগুলো বেশি বেশি করে উত্থাপন করছেন। আর সংখ্যালঘু এলাকাগুলোতে সংযুক্ত মোর্চার নির্বাচনী সভাগুলোতে উপচে পড়া ভিড় হচ্ছে।
আঠাশে ফেব্রুয়ারির ব্রিগেড সমাবেশের পর দ্বিতীয় যে সভাটি সংযুক্ত মোর্চা করেছে দক্ষিন চব্বিশ পরগণার ভাঙড়ে তা ছিল আরেকটি ব্রিগেড, যেন জনজোয়ার। সংযুক্ত মোর্চার সভাগুলিতে উপচে পড়া ভিড় হচ্ছে। আর তার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী ওরফে সকলের প্রিয় ভাইজান। পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের শিক্ষার হার ক্রমশ বাড়ছে। এর প্রধান কারণ মুসলিম মিশনের ভূমিকা। এ ক্ষেত্রে আইকন হল আল আমিন মিশন। মুসলিমদের বক্তব্য, ভারতীয় সংবিধানের ৩০। ৩০ এ ধারানুযায়ী আর্থিক সহায়তা দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে আরো চাঙ্গা করা যেত। সেদিকে কোনো নজর নেই। দশ হাজার মাদ্রাসার অনুমোদন আজো বিশ বাঁও জলে। মুসলিমদের নিজেদের সম্পদ ওয়াকফ সম্পত্তি আজ বেদখল। এই ওয়াকফ সম্পত্তিগুলি কোনোভাবেই কাজে লাগাতে পারেনি তৃণমূল সরকার। এর ফলে নানাকারণে তৃণমূলের উপর ক্ষোভ বেড়েই চলেছে। বামজমানায় আর এস এস সেভাবে বাড়তে পারেনি। এখন পশ্চিমবঙ্গে আর এস এসের সদস্য সংখ্যা কয়েক লাখ। সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজের প্রতি অবজ্ঞাসুলভ মনোভাবই তৃণমূলের প্রতি মুসলিমদের ক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছে। আব্বাস সিদ্দিকী সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়ে নিতে চাইছেন। তবে বাস্তবে তা কতটুকু সফলতার মুখ দেখবে, তার জন্য আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।
খুলনা গেজেট/এনএম