গত ১৬ বছরে দুই দফায় আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন খুলনা-৫ (ডুমুরিয়া-ফুলতলা) আসনের সংসদ সদস্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। প্রথমবার ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী। শেষবার দায়িত্ব পান ভূমিমন্ত্রীর। মন্ত্রী হয়েই ঘুষ, দুর্নীতি ও দখলের মহারাজ হয়ে ওঠেন। নদী দখল করে ইটভাটা তৈরি, কলেজ সরকারীকরণ ও বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে নিয়োগ-বদলি বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি টাকার সম্পদ করেছেন তিনি। সাবেক মন্ত্রী নিজে, তাঁর ছেলে ও মেয়ে এই বাণিজ্যের অংশীদার ছিলেন।
খর্ণিয়া সেতুর পাশে হরি নদীর ৯ দশমিক ৮৫ একর জমি অবৈধভাবে দখল করে কে পি ব্রিকস নামে একটি ইটভাটা গড়ে তোলেন নারায়ণ চন্দ্র । ৮-১০ বছর ধরে নদীর চরের মাটি দিয়ে ইট তৈরি করা হতো। এই ইটভাটার মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা আয় করেছেন তিনি। হাইকোর্টের নির্দেশে ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসন সেই ইটভাটা উচ্ছেদ করে।
২০২১ সালে ডুমুরিয়ার ভদ্রাদিয়া গ্রামের ১১ জনের প্রায় ১০০ বিঘা জমি দখল করে সেখানে ইটভাটা তৈরি করার অভিযোগে নারায়ণ চন্দ্র এবং তাঁর দুই ছেলে সত্যজিৎ চন্দ্র, বিশ্বজিৎ চন্দ্রসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে গত ১৫ সেপ্টেম্বর খুলনার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন ওই গ্রামের বীরেশ্বর মল্লিক।
অভিযোগ রয়েছে, চরমপন্থি দল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) খুলনা বিভাগীয় সম্পাদক শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে নারায়ণ চন্দ্রের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। ২০১৪ সালের নভেম্বরে শিমুলের ছোট ভাই শিপলু ভূঁইয়া তাঁর হাতে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ২০১৬ ও ২০২১ সালের নির্বাচনে শিপলু ভূঁইয়া নৌকা প্রতীক নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান হন। এ ছাড়া ডুমুরিয়ার চরমপন্থি দল নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির ক্যাডাররা নারায়ণ চন্দ্রের ছত্রছায়ায় থাকতেন।
ভান্ডারপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা. হিমাংশু বিশ্বাস বলেন, গত ১৬ বছরে নারায়ণ চন্দ্র তিনটি ইটভাটা করেছেন। তিনি এক ছেলের নামে সারের ডিলারশিপ নিয়েছেন। পরিবারের একাধিক সদস্যকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি দিয়েছেন। এ ছাড়া অন্যদের চাকরি দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন।
সীমাহীন দুষ্কর্ম
মন্ত্রী ও তাঁর লোকজনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মানুষের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে গত ৫ ও ৬ আগস্ট। সরকার পতনের পর বিক্ষুব্ধ জনতা তাঁর বাড়িতে হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে দুই তলা বাড়ির আসবাবসহ গ্যারেজে থাকা দুটি গাড়ি পুড়ে যায়।
ডুমুরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, এ অবস্থার জন্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দ ও তাঁর ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক সদস্য বিশ্বজিৎ চন্দ্র চন্দ, কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য চৈতালী হালদার ও মন্ত্রীর এপিএস সমীরণ দে গোরার অপকর্মই দায়ী। তারা লুটপাট করে বিতর্কিত হয়েছেন। মন্ত্রী নিজেই নিয়োগ ও দখল বাণিজ্যে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডুমুরিয়া উপজেলার খর্ণিয়া এলাকায় নদীর চর দখল করে কেপিবি নামে দুটি ইটভাটা তৈরি করেন নারায়ণ চন্দ্র। মন্ত্রীর মেঝ ছেলে সত্যজিৎ চন্দ্র বিসিআইসির সার ও সেনা কল্যাণ সংস্থার সিমেন্টের ডিলার।
সত্যজিতের মালিকানাধীন ঊষা এন্টারপ্রাইজ গত ১৫ বছর ধরে এককভাবে সারের ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছে। বিলাসবহুল টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার গাড়িতে চলাফেরা করেন তিনি।
প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের একটি সূত্র জানায়, গত ১৬ বছরে ডুমুরিয়ার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন মন্ত্রী ও তাঁর ছেলে-মেয়েরা। নিয়োগ পেয়েছেন নিজ পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনও। এর মধ্যে ডুমুরিয়া কলেজে প্রভাষক পদে নিয়োগ পেয়েছেন পুত্রবধূ সুলগ্না বসু, লাইব্রেরিয়ান পদে কেয়া রানী চন্দ্র, প্রভাষক পদে নিয়োগ পেয়েছেন মন্ত্রীর সাবেক এপিএস প্রভাষক সমীরণ দের শ্যালক শোভন দে, মাইকেল রায়, সাবেক এপিএস সত্যম রায়, ভাতিজা জয়ন্ত কুমার দে, বিপ্লব কুমার দে, মিঠুন কুমার মল্লিক, নাতি দ্বীপ চন্দ্র চন্দ, প্রসেনজিৎ বিশ্বাস, তাপস কুমার রাহা, চণ্ডিদাস কুণ্ডু, অর্চনা রানী ও সাধন কুমার দাস।
খুলনা জেলার মধ্যে মাছ ও সবজির জন্য ডুমুরিয়া বিখ্যাত। এ উপজেলাটি খাল বিল নদী-নালা দ্বারা বেষ্টিত। এখানে ২০ একর পর্যন্ত ১৩৫টি এবং ২০ একরের ঊর্ধ্বে ৩৩টি জলমহাল রয়েছে।
জলমহালগুলো প্রকৃত মৎস্যজীবীদের (জেলে) দিয়ে পরিচালিত হওয়ার কথা। তবে নারায়ণ চন্দ্রের অনুসারীরা নদী-খালের কয়েকশ স্থানে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছেন। অভিযোগ রয়েছে, মাছচাষীদের কাছ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৪ কোটি টাকা আয় করছেন নারায়ণ চন্দ্র ও তাঁর অনুসারীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, গত ১৬ বছরে উপজেলার টিআর, কাবিটা ও বিশেষ বরাদ্দে বিভিন্ন উন্নয়ন খাতে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। কিন্তু গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে দৃশ্যমান কাজ হয়নি। বরাদ্দের সিংহভাগই হরিলুট হয়েছে।
২০১৮ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ডুমুরিয়া উপজেলার একটি কলেজ সরকারীকরণ হবে। কলেজটি অবশ্যই উপজেলা সদর থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে হতে হবে। তবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপক্ষো করে তৎকালীন মৎস্যমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্রের ডিও লেটারের মাধ্যমে উপজেলা সদর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে শাহপুর-মধুগ্রাম কলেজকে সরকারি করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, এজন্য ৫ কোটি টাকা ঘুষ নেন তিনি। ২০২৪ সালের প্রথম দিকে মাগুরখালী স্বর্ণদ্বীপ কলেজকে এমপিওভুক্ত করতে তিনি সাড়ে ৩ কোটি টাকা উৎকোচ গ্রহণ করেন বলে অভিযোগ কলেজের একাধিক শিক্ষক-কর্মচারীর।
বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, পুলিশসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে নিয়োগ, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং নিজ এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সুবিধাজনক স্থানে বদলি করার বিনিময়ে তিনি গত ১৬ বছরে আয় করেছেন কোটি কোটি টাকা।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বর থেকে ধর্ষণের শিকার এক নারীকে অপহরণের অভিযোগে গত ২৯ সেপ্টেম্বর সাবেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেন ভুক্তভোগী নারী। খুলনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলাটি দায়ের করা হয়। সাবেক স্কুল শিক্ষক নারায়ণ চন্দ্র খুলনা-৫ আসন থেকে পাঁচবার সংসদ সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯ বছর ধরে ডুমুরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।
সম্পদের তথ্যে ছলচাতুরি
নির্বাচনের হলফনামায় সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। ২০১৮ সালে তাঁর বার্ষিক আয় দেখান ২১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। সম্পদ ছিল ৬৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকার। ২০২৪ সালে দেওয়া হলফনামায় তিনি বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ১৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা। পাঁচ বছরে সম্পদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ২৭ লাখ টাকায়। সম্পদের মধ্যে ব্যাংকে জমা ৫৫ লাখ টাকা, ৪ দশমিক ১৭ একর কৃষিজমি, কিছু অকৃষি জমি, একটি দালান ও একটি সেমিপাকা ভবন রয়েছে। ব্যাংকে তাঁর ঋণ ১ কোটি ৯৯ লাখ ৫৭ হাজার টাকা।
তবে স্থানীয়রা জানান, এর বাইরেও নারায়ণ চন্দ্রের একাধিক ইটভাটা, কৃষিজমি, ঢাকা ও কলকাতায় ফ্ল্যাট রয়েছে। কিন্তু এসব সম্পদের তথ্য কখনও প্রকাশ করেননি তিনি।
আ’লীগ নেতারাও ক্ষুব্ধ
ডুমুরিয়ার আটলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রতাপ কুমার রায় বলেন, সাবেক মন্ত্রী উপজেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজের পরিবারের লোকজন ও অযোগ্যদের নিয়োগ দিয়েছেন। এলাকায় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ দিয়েছেন পছন্দের লোকজনকে। দলের প্রতি তাঁর কোনো আন্তরিকতা ছিল না। অন্যায়-অবিচারের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছেন তিনি।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম বলেন, ছদ্মবেশে ভারতে পালানোর সময় তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন। এটাই হলো অপকর্মের শেষ পরিণতি।
স্থানীয় অনেকে বলছেন, কলকাতার সল্টলেকে নারায়ণ চন্দ্রের একটি বাড়ি রয়েছে। ওই বাড়িতে থাকেন মন্ত্রীর নাতি সৈকত বসু। নারায়ণ চন্দ্র ও তাঁর বড় ছেলে ড. বিশ্বজিৎ চন্দ্র হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন প্রতিবেশী দেশে। সে কারণে এ দেশে তাদের সম্পদ কম।
খুলনা গেজেট/এনএম