স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসা এবং তাদের জন্য অকৃত্রিম কিছু করার প্রবল বাসনা তাঁর এতটাই ছিল যে, জেল-জুলুম-নির্যাতন কোন কোন কিছুই তাঁকে দমাতে পারেনি। তাঁর বাবার একটা পরামর্শ তিনি আজীবন মেনে চলেছেন “সিনসিয়ারিটি অফ পারপাস এন্ড অনেস্টি অফ পারপাস থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না” । সারাটা জীবন মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন, জেল খেটেছেন বহুবার । গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা এবং চরিত্রের নৈতিকতা তার একটা অন্যতম সম্পদ ছিল ।
রাজনৈতিক জীবনে তাঁর একটা বৈশিষ্ট্য কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে, তিনি তার শত্রুভাবাপন্ন প্রতিপক্ষের সঙ্গেও আলোচনায় বসতে দ্বিধা করতেন না। দেশের কাজ করতে গিয়ে অনেক সময়ই অনেকের সাথে তার মতের মিল হয়নি, অনেকের সাথে ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে, কিন্তু তিনি কারো নামে প্রকাশ্যে বা আড়ালে বাজে কথা বলতেন না, কোন নেতিবাচক কথা বলতেন না। যদিও সমাজের শত্রুদের তিনি স্পষ্ট ভাষায় চিহ্নিত করতে কখনো জড়তাবোধ করেননি । যেমন, ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইটিতে তিনি লিখেছিলেন, “আমি নিজে কমিউনিস্ট নই, তবে সমাজতন্ত্রের বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে, ততদিন দুনিয়ার মানুষের ওপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না ।
পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর।” এই বিশ্বাস থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠনের পরে তিনি এমন একটা দেশ গড়ার আহবান রেখেছিলেন যে দেশটা যেন অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্ত থাকে । তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, সারা দুনিয়ার মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত শোষক ও শোষিত। এও বলেছিলেন তিনি শোষিতের পক্ষে । এই কথাটা যে নেহাত কথার কথা ছিল না তা বোঝা যায়, যখন তিনি বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সে দেশের সংবিধানে রাষ্ট্র হিসাবে সমাজতন্ত্রকে অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে স্থান দেবার ব্যবস্থা করেছিলেন । তাঁর তৈরি ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূল মন্ত্র ছিল চারটে – গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ ।
বাংলাদেশ তৈরি হবার আগের সময়পর্বে ফিরে দেখার চেষ্টা করলে দেখা যায় যে, বঙ্গবন্ধু যখন দেখেছিলেন যে পাকিস্তানিরা দেশকে ভুল পথে পরিচালিত করছে, পূর্ব পাকিস্তানকে দ্বিতীয় উপনিবেশ হিসেবে গড়ে তুলে শোষণ বঞ্চনা আর পুঁজি পাচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে, দেশের দুর্নীতি বেড়ে যাচ্ছে, খাদ্যাভাব দেখা দিচ্ছে- সেই সময়ে তিনি পাকিস্তানের শাসকদের বিরুদ্ধে ও অন্যান্য দেশবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শুরু করেছিলেন। ১৯৬৬ সালে লেখা ‘আমাদের বাঁচার দাবি ৬-দফা কর্মসূচি’ পুস্তকে তিনি লিখেছিলেন – ‘জনগণের দুশমনদের ক্ষমতা অসীম, তাদের বিত্ত প্রচুর, হাতিয়ার এদের অফুরন্ত, মুখ এদের দশটা, গলার সুর এদের শতাধিক। এরা বহুরূপী’।
‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ তার ও বাঙ্গালী জাতির জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সূচনা করেছিল । ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব’ শিরোনামে সেই মামলার বিচারের বিবরণ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকল । এই ঘটনার ফলশ্রুতিতে দেশজুড়ে তাঁর কথা পৌঁছে যেতে একদিকে যেমন সুবিধা হয়েছিল, তেমনি রাজনৈতিক সংগঠনের বিস্তারে সহায়ক পরিস্থিতি তৈরি করতে সুবিধাজনক আবহাওয়া তৈরি হয়ে গিয়েছিল । তাঁর তৈরি রাজনৈতিক সংগঠন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার জন্য ও জয়লাভ করার জন্যে সার্বিকভাবে অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করেছে একথা আজ সর্বজনস্বীকৃত।
দেশের জাতীয় ভাষা কি হবে সেই নিয়ে তাঁর স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ লোকের মাতৃভাষা ছিল বাংলা । তবু তিনি বাংলা, উর্দু দুটোকেই রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলেন। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীরা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুলেছিল। যদিও সেই সময়ে কোন পাকিস্তানের কোন প্রদেশের ভাষা উর্দু ভাষা ছিল না তবু পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীরা এই দাবি করেছিল এই যুক্তি দেখিয়ে যে উর্দু ভাষা হলো ইসলামীক ভাষা । দেশকে রক্ষার স্বার্থে সেটাও বঙ্গবন্ধু মেনে নিয়েছিলেন। যদিও তিনি জানতেন যে, এই দাবিটা (উর্দু ভাষা হলো ইসলামীক ভাষা)সঠিক দাবি নয়। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে । আরব দেশের মুসলমানরা আরবি ভাষা বলে, পারস্যের লোকেরা ফারসি ভাষা, তুরস্কের লোকেরা তুর্কি ভাষা, ইন্দোনেশিয়ার লোকেরা ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কথা বলে, মালয়েশিয়ার লোকেরা মালয় ভাষায় কথা বলে, চীনের মুসলমানরা চীনা ভাষায় কথা বলে ।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে তখন তিনি দেশের মানুষের মুখের ভাত কিভাবে জোগাড় হবে, কর্মচারীদের বেতন কিভাবে দেবেন তা নিয়ে চিন্তিত। অর্থের অভাবে প্রয়োজনীয় সড়ক সেতু বানাতে পারছেন না। এমন একটা কঠিন সময়ে তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেন। তারপরে সবাই দেখেছেন, দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটিয়েছিলেন, দেশের মানুষের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করেছিলেন। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশের জন্য সাহায্য আসার ব্যবস্থা করেছিলেন।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বিষয়ে ও ধর্মকে নিজের ঢাল হিসেবে যারা ব্যবহার করে তাদের নিয়ে তাঁর স্পষ্ট বক্ত্যব্য ছিল – “মানুষ যদি সত্যিকারভাবে ধর্মভাব নিয়ে চলত তাহলে আর মানুষে মানুষে এবং রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে এইভাবে যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম হতো না। কিছু মানুষ নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করবার জন্য ধর্মের অর্থ যার যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে চালাতে চেষ্টা করছে।” ধর্মনিরপেক্ষতার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যাও পেয়েছি আমরা তার মুখে। তাঁর মতে, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা, হিন্দুরা, বৌদ্ধরা, খ্রিস্টানরা তাদের নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারোর নাই। অর্থাৎ রাষ্ট্র ও রাজনীতি ধর্মের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকবে কোনো বিশেষ ধর্মকে প্রশ্রয় দেবে না – এটাই তাঁর বক্ত্যব্যের মর্মবস্তু ছিল।
বাঙালি জাতির প্রায় পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গৌরবময় অধ্যায় এনিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই । বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের শ্রেষ্ঠ অবদান একটি স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। একই সাথে বলা যায় তাঁর দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ অবদান হল – খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই দেশে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও আধুনিক সংবিধান প্রবর্তনের ব্যবস্থা করেছিলেন এবং বিশ্বের দরবারে নিজ দেশকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন ।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ।