মৌসুম বা ঋতু মানবজীবনে বড় প্রভাব বিস্তারকারী একটি বিষয়। আমাদের জীবন চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে এ অদৃশ্য বস্তুটি। শীতকলে খাওয়া-থাকা, পোষাক-পরিচ্ছদসহ সব কিছুই গরমের লাইফস্টাইল থেকে একেবারেই ভিন্ন হয়। তাই ঋতুভেদে আমাদের প্রস্তুতিও হয় ভিন্ন রকম। শীত আসার আগে শীতের প্রস্তুতি। গরমের আগে গরমের।
বিষয়টিকে যদি একটু অন্যভাবে দেখা হয়, তবে তা নিচের কথাগুলির সাথে হুবহু মিলে যায়। মাহে রমজানও তো একটি মৌসুম। তবে এটা কোন প্রাকৃতিক মৌসুম নয় বরং রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মৌসুম। শীতের মৌসুমে যেমন হরেক রকমের সবজি সহজলভ্য হয়। গরমের দিনে সহজে অনেক ফল পাওয়া যায়। তদ্রুপ রমজান হলো এসব বিষয়গুলি সহজে পাওয়ার মৌসুম। এসময় আল্লাহর ব্যাপক রহমত বান্দার প্রতি বর্ষিত হয় এবং এসময় মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভও অন্য সময়ের তুলনায় খুবই সহজতর।
সুতরাং বুদ্ধিমানের কাজ হলো সুযোগের সঠিক ব্যবহার করা। মৌসুমী পন্য মৌসুমেই গুছিয়ে নেওয়া। আর তার জন্য জরুরী পূর্ব প্রস্তুতি।
রমজান সমাগত প্রায়। চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়েই শুরু হতে যাচ্ছে এই মহাপূন্যময় মাস। যখন মহান আল্লাহর রহমতের চাদর সকলের তরে ব্যাপক করা হয়। মাগফিরাতের বারিতে ধুয়ে মুছে পবিত্র হয়ে যায় গোনাহের যত কালিমা। আর নাজাতের পরওয়ানা পেয়ে মুমিন বান্দা হয় ধন্য। তাই রমজান মৌসুমের এই প্রাপ্তিগুলি লুফে নিতে নিন্মে কিছু সহজ প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা উল্লেখ করা হলো।
দৌহিক প্রস্তুতি : প্রত্যেকটি ইবাদত আদায়ের জন্য কিছু প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম থাকে। যেমন জাকাত আদায়ের জন্য অর্থ দরকার। তেমনি রোজা এমন একটি ইবাদত যা আদায়ের মৌলিক পুজি হলো সুস্বাস্থ্য। সুতরাং রমজানের আগে স্বাস্থ্যের সুষ্ঠ পরিচর্যার বিকল্প নেই। অন্যথায় রমজানে শরীর দুর্বল হয়ে পড়লে বা অসুস্থ হয়ে গেলে এই মহাপূণ্য থেকে অনিচ্ছা সত্তেও বঞ্চিত থাকতে হবে। এদিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রিয় নবীজি সা. অর্ধ শাবানের পর আর রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, যখন শাবানের অর্ধেক গত হয়ে যায় তখন তোমরা আর রমজান পর্যন্ত কোন নফল রোজা রেখ না। (তিরমিজি-৭৩৮)
মানসিক প্রস্তুতি : কোন কাজের জন্য উক্ত বিষয়ের ব্যপারে মানুষিক প্রস্তুতি অতিব গুরুত্বপূর্ণ। রমজানে না খেয়ে থাকার বিষয়টি চিন্তা করতেই অনেকে ঘাবড়ে যান। আবার অনেকে কাজের বাহানায় বা সামান্য অসুস্থতার অজুহাতে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। অবিভাবকরা পড়ালেখায় বিঘ্ন হতে পারে ভেবে সন্তানকে রোজা রাখতে নিষেধ করেন।
অথচ একবার তো ভেবে দেখা উচিত ছিলো যে, এই না খেয়ে থাকার নির্দেশ কে দিচ্ছেন! রোজার নির্দেশ তো সেই সত্তার পক্ষ থেকে, যিনি এই দেহ সৃষ্টি করেছেন। আমার সন্তানও তো তারই দান। তবে কি তিনি এতোই নির্দয় যে, আমার ও আমার সন্তানের জন্য অমঙ্গলজনক কোন কাজের নির্দেশ তিনি দিবেন।
আরো ভেবে দেখুন, মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের যে আয়াতে রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন সেই একই আয়াতে কি বলছেন? বলছেন, “মহান আল্লাহ তোমার ব্যাপারে সহজতা চান, তোমাদের ব্যাপারে কঠিন কিছু আশা করেন না” (সুরা বাকারা-১৮৫)
সুবহানাল্লাহ। উক্ত আয়াতে রমজানের রোজার বর্ননার সাথে সহজতার কথা উল্লেখ হয়েছে। যা স্পষ্টই একজন মুমিনের জন্য বড় সুসংবাদ।
সুতরাং মহান আল্লাহর এই সান্তনাবাণী হৃদয়ে ধারণ করুন এবং সব ধরনের কুমন্ত্রনা ঝেড়ে ফেলে রমজানের জন্য পূর্ণ মানসিকভাবে প্রস্তুত হোন।
৫ ওয়াক্ত নামাজে অভ্যস্ত : সহীহ হাদীসের আলোকে প্রমানিত যে, পবিত্র রমজানে বিতাড়িত শয়তানকে শৃংক্ষলাবদ্ধ করে রাখা হয়। সুতরাং এসময় মানুষের মাঝে নেক কাজের স্পিৃহা অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশী থাকে। তাই নিজেকে নামাজে অভ্যস্ত করার জন্য পবিত্র রমজান সবচেয়ে উত্তম মূহুর্ত। অনেকে ৫ ওয়াক্তের মধ্যে টেনে টুনে ৪ ওয়াক্ত পড়তে পারলেও ফজরের নামাজে অভ্যস্ত হতে পারেন না। সাহরী খাওয়ার জন্য সুবহে সাদিকের আগে উঠতে হয়। একটি মাস এভাবে প্রাক্টিস করতে থাকলে ফজরের নামাজে উঠায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া কোন কঠিন ব্যাপার নয়।
তারাবীহ ও নফল সলাত : এ মাসের একটি অন্যতম সুন্নাত হলো ২০ রাকাত তারাবীহ। মূলত: দিনের রোজা আর রাতের তারাবীহ মিলিয়েই রমজানের পূর্ণতা। অনেকেই রোজা রাখলেও তারাবীতে অবহেলা করেন। অনেকে ২০ রাকাত পূর্ণ করেন না। এটা আদৌ উচিত নয়। একটি মাস ২০ রাকাত তারবীহ পড়া মানে প্রায় ৬০০ রাকাত নফল নামাজ। আর রমজানের ভিতরে হওয়ায় এর মর্যাদা ফরজের সমান। যা একজন মুমিনের বড় প্রাপ্তি। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হাসরের ময়দানে বান্দার ফরজের ঘাটতি নফল দ্বারা পূর্ন করা হবে। আর কে বলতে পারবে যে আমার আমলে কোন ঘাটতি নেই। সুতরাং এ সুযোগ হেলায় হারনো চরম বোকামি।
কোরআন তেলাওয়াত : পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে যে, “রমজান মাস যা পবিত্র কুরআন অবতির্ণ হওয়ার মাস” সুতরাং এই মাসের সাথে কুরআনের একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। তাই কুরআন পড়া বা শেখার জন্য এই মাসের তুলনা নেই। দেখা যায় রমজান উপলক্ষে বিভিন্নভাবে কুরআন শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। যা অন্যান্য মাসে সম্ভব হয়ে উঠে না। আর খাওয়া দাওয়ার ব্যস্ততা না থাকায় যথেষ্ট অবসরও পাওয়া যায়। সুতরাং কুরআন পড়ার ব্যাপারে রমজানের শুরুতেই একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে নেওয়া চাই।
জিকির ও দোয়া : পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারার ১৮৩ নং আয়াত হতে ১৮৭ নং আয়াত পর্যন্ত এই ৫ আয়াতে রমজান মাস সংক্রান্ত বিধিবিধান আলোচনা করা হয়েছে। অর্থাৎ এই ৫ আয়াতের বিষয়বস্তুগুলি রমজানের সাথে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে ১৮৬ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, (হে নবী সা.) যখন আমার বান্দা আমার সম্পর্কে আপনার নিকট জানতে চায় (বলুন) তারা যখন আমাকে ডাকে আমি তাদের ডাক শুনি।
আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা আমাদিগকে আল্লাহকে ডাকার প্রতি উৎসাহী করেছেন এবং ডাক শুনারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
যেহেতু রমজান সংশ্লিষ্ট আলোচনার ধারাবাহিকতায় এই আয়াত সুতরাং এই মাসে বেশি বেশি আল্লাহকে ডাকার এবং তার কাছে প্রার্থনা করার প্রতি বিশেষ ইঙ্গিত রয়েছে।
এছাড়া সাহরীর সময় অর্থাৎ রাতের শেষ প্রহরে দোয়া কবুল হওয়ার কথা হাদিসে উল্লেখ আছে এবং ইফতারীর পূর্বমূহুর্তে দোয়া কবুল হওয়ার বিষয়টিও একাধিক সহীহ হাদিসে উদৃত হয়েছে। তাই উল্লিখিত সময়ে প্রতিদিন আল্লাহর জিকির ও দোয়ার বিশেষ ইহতিমাম করা।
ধর্মীয় বই পুস্তক অধ্যায়ন : রমজানে সাধারণত অনেক অবসর সময় পাওয়া যায়। বিশেষ করে যোহরের পর বিশ্রামের খাতিরে দীর্ঘ সময় বিছানায় গড়াগড়ি করে কাটে। এসময় হাতে একটি ধর্মীয় বই থাকলে ক্ষতি কি? রমজানের আগেই অবসর কাটানোর জন্য কিছু মুল্যবান বই পুস্তক সংগ্রহ করে রাখা যেতে পারে। যেমন শাইখুল হাদীস জাকারিয়া রাহ. রচিত ফাজায়েলে আমাল কিতাবটি। উক্ত কিতাবে রমজান সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু পাঠ রয়েছে।
দান খয়রাত : পূণ্যময় রমজানের অসংখ্য বৈশিষ্টের অন্যতম একটি হলো এই মাসের একটি ফরজ সত্তরটি ফরজের সমান এবং একটি নফল একটি ফরজের সমান মূল্যবান হয়ে থাকে। সুতরাং দান খয়রাতসহ অন্যান্য নেক আমলের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ। কেউ যদি এই মাসে এক টাকা দান করে তা অন্য মাসে সত্তর টাকা দান করা থেকেও বেশী উত্তম।
শেষ দশকের ইতিকাফ : এমাসের অনন্য তাৎপর্যের একটি হলো লাইলাতুল কদর। এ রাতের কথা পবিত্র কুরআনে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা বলেন যে, এই রাতটি হাজার মাস হতে উত্তম। অর্থাৎ কেউ যদি এই রাতটি ইবাদতের মধ্যে কাটায় সে যেন হাজার মাস ইবাদতের মধ্যে কাটালো।
তবে এ রাতের কোন সুস্পষ্ট তারিখ কোরআন সুন্নাহে উল্লেখ নেই। আছে এ রাতটি রমজানের শেষ দশকের যেকোন এক রাতে হতে পারে। সুতরাং এই রাতের পূণ্য অর্জনের জন্য শেষ দশকের ইতিকাফ সবচেয়ে নিরাপদ ব্যবস্থা। হাজার মাস ইবাদতের নেকি লাভ করার জন্য ১০টি দিন নিজেকে আল্লাহর ঘর মসজিদের পরিবেশে আটকে রাখা তেমন কি কঠিন কাজ? কেবলমাত্র প্রস্তুতি ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার প্রয়োজন।
আগামী জীবনের প্রতিজ্ঞা : সর্বপরি রমজান জীবনের মোড় পরিবর্তনের একটি বিশাল আয়োজনের নাম। রমজানের উদ্দেশ্য বর্ণনায় সুরা বাকারার ১৮৩ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, আমি তোমাদের উপর রোজা ফরজ করেছি যেমন তোমাদের পূর্ববর্তিদের উপর করা হয়েছিলো যাতে তোমরা খোদাভীরু হতে পার। আর এই খোদাভীরুতার প্রাপ্তি অর্জনেই মূলত: রমজানের সফলতা। নতুবা ক্ষুধা পিপাসার কষ্ট ভোগ করা ছাড়া আর কোন মানে নেই।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে রমজানে যে ছেলেটি দাড়ি, টুপি এবং নামাজে অভ্যস্ত হয়েছিলো রমজানের পরে সে তা আর ধরে রাখতে পারছেনা। এর মূল কারণ উদাসীনতা ছাড়া আর কিছুই নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সারা রমজানের উপার্জিত পূণ্যরাশি ঈদের দিনেই পাপরাশিতে পরিণত হয়।
সুতরাং রমজানের শুরুতেই দৃঢ় সংকল্প করা এবং রমজান জুড়ে আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে প্রার্থনামগ্ন থাকা যেন এই প্রতিজ্ঞা স্থায়ী হয়। রমজানের অনুসরণে সারা বছর আল্লাহর আনুগত্য এবং তার অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকার প্রানপণ চেষ্টা করা। এটাই রমজানের মূল প্রাপ্তি। আল্লাহ আমাদের সকলকে তৌফিক দান করুন।
(লেখক : শিক্ষক, ইমদাদুল উলুম রশিদিয়া মাদরাসা, ফুলবাড়ী গেট, খুলনা। )
খুলনা গেজেট/কেএম