ডেভিস ইউজিন বোস্টার, মার্কিন রাষ্ট্রদূত। ১৯৭৪ সালের ১৩ এপ্রিল থেকে ১৯৭৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে কর্মরত ছিলেন। ইতিহাসবিদ চার্লস স্টুয়ার্ট কেনেডি ১৯৮৯ সালের ২০ অক্টোবর রাষ্ট্রদূত বোস্টারের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনকালে তিনটি সরকারের পালাবদল প্রত্যক্ষ করেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করেন। ইতিহাসবিদের কাছে সাক্ষাৎকার দেয়ার ১৬ বছর পর তিনি মারা যান।
আগস্ট ও নভেম্বরের ঘটনাবলী তারবার্তার মাধ্যমে তার দেশে পাঠান। ২০০৩ সালের ৩ নভেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর গোপন দলিল অবমুক্ত করে।
রাষ্ট্রদূত বোস্টার ঐ বছরের ১০ নভেম্বর ঢাকা-০৫৪৭০ ক্রমিকে তার বার্তা পাঠান। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা ৭৫’র গোপন তার বার্তায় লোমহর্ষক তথ্য পাওয়া যায়। বোস্টার সেদিনের তার বার্তায় উল্লেখ করেন, সেনা সমর্থক রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদকে হত্যা করা হতে পারে। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার সাথে জড়িত খুনী চক্র এ আশঙ্কা করে। কোন কোন ব্যক্তি মোশতাককে হত্যা করতে পারে এ ব্যাপারে তার বার্তায় স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের মধ্যে এক বা একাধিক মেজরের হুকুমে জেল হত্যা হয়।
বোস্টার তার দীর্ঘ বিশ্লেষণে উল্লেখ করেন, সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, সাবেক অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ (মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী) ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী এইচ এম কামরুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগারে হত্যা করা হয় ৩ নভেম্বর খুব সকালে।
একাধিক পর্যবেক্ষক উল্লেখ করেন, জেল হত্যার কারণ হল সরকারের ভেতরে ভারতপন্থী নেতৃত্বকে অপসরণ করা ( মিজানুর রহমান খান রচিত মার্কিন দলিলে বঙ্গবন্ধু ও চার নেতা হত্যাকান্ড)। যদিও তিনি তার বার্তায় উল্লেখ করেন, জেনারেল খালেদ মোশাররফ ভারতপন্থী ছিল তার কোন প্রমাণ তাদের হাতে নেই।
মার্কিন এ দলিলে উল্লেখ আছে, মঙ্গলবার রাতে চীফ অব স্টাফ হিসেবে জে: খালেদ মোশাররফ এর অভিষেক ঘটে, খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজির সমর্থকরা রাজধানী ঢাকাতে মিছিল এবং জেল হত্যার প্রতিবাদে পরদিন হরতাল ডাকা হয়।
অবমুক্ত করা গোপন দলিল সাক্ষ্য দেয় যে, মার্কিন কূটনীতিকরা সেই উত্তেজনা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেননি। ভারতীয়দের কাছ থেকে তারা জানার চেষ্টা করেছেন, ভারতীয় হস্তক্ষেপ হবে, কী হবে না।
এ দলিল সাক্ষ্য দিচ্ছে মোশতাক আহমেদ ও জে: জিয়াউর রহমানের সরকার যাতে টিকে থাকে সেজন্য রাষ্ট্রদূত বোস্টার তৎপরতা চালিয়েছেন। অনেকেই বলেছেন, তিনি সিস্টেম বা পেশাদারীর তরিকা অনুসরণ করেছেন মাত্র।
ইতিহাসবিদ চার্লস স্টুয়ার্ড কেনেডীকে দেয়া সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রদূত বোস্টার বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার পরের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দিতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতি দেখান। ফারুক রহমানরা সে কারণে ব্যাংককে গিয়েও মার্কিন কূটনীতিবীদদের সাথে বৈঠক করেন. ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট।
জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে পাওয়া টেলি কথোপকথনে দেখা যায়, হেনরী কিসিঞ্জার এটাও বলেছেন, আমি জানি, মার্কিনপন্থী হিসেবে পরিচয় জাহির করতে মোশতাক সরকারের অক্ষমতা রয়েছে। রাষ্ট্রদূত বোস্টার তার বাংলাদেশে মিশনে কিসিঞ্জারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে গেছেন বলে প্রতীয়মান হয়।
রাষ্ট্রদ্রুত বোস্টার তার বর্তায় উল্লেখ করেন, দূতাবাসের একজন স্টাফ তাকে জানিয়েছেন ৫ নভেম্বর ঢাকা শহরে একটি ছোট মিছিল থেকে মোশতাকের ফাঁসি চাই শ্লোগান ওঠে। মিছিলকারীরা ‘বোস্টার বাংলা ছাড়, বোস্টারের রক্ত চাই’ ইত্যাদি শ্লোগান উচ্চারিত হয়। (মিজানুর রহমান খান রচিত মার্কিন দলিলে বঙ্গবন্ধু ও চার নেতা হত্যাকান্ড)।
রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার প্রতিবাদে ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকায় মিছিল বের হয়। জেল হত্যার প্রতিবাদের পরের দিন হরতাল ডাকা হয়। শুক্রবার সকালে সেনা সদস্যরা বিদ্রোহ শুরু করেন। তারা জে. খালেদ মোশাররফের সমর্থকদের উৎখাত করে। হত্যা করা হয় জে. খালেদ মোশাররফকে ।
সাবেক সচিব সিরাজউদ্দীন আহমেদ রচিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও বঙ্গবন্ধুর খুনিরা জেলখানা হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করে। রিসালদার, মোসলেহ উদ্দীনের নেতৃত্বে পাঁচ জন ঘাতক জেল হত্যাকান্ড ঘটায়। সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করা হয়। তার শরীরে বুলেটের চিহ্ন ছিল। সাবেক অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী এইচ এম কামরুজ্জামানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে রাজশাহী শহরে বাকী তিন জনকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
জেল হত্যা মামলার আসামিরা হচ্ছে খন্দকার মোশতাক আহম্মেদ, লে: কর্ণেল ফারুক রহমান, লে: কর্ণেল সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, লে: কর্ণেল মহিউদ্দীন আহমেদ, লে: কর্ণেল খন্দকার আব্দুর রশীদ, মেজর বজলুল হুদা, লে: কর্ণেল শরিফুল হক ডালিম, লে: কর্ণেল এম এইচ এসবি নূর চৌধুরী, লে: কর্ণেল এ এম রাশেদ চৌধুরী, মেজর শরিফুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন কিসমত হাশেম, প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দীন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, একেএম ওবায়দুর রহমান, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ও মেজর সামসজ্জোহা।
২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর জেল হত্যা মামলার রায়ে তিন জনের মৃত্যুদন্ড, ১১ জনের যাবজ্জীবন ও পাঁচ জনকে খালাস দেয়া হয়।