শিষ্টাচার এর পরিচয়, গুরুত্ব ও তাৎপর্য
১. আদব–শিষ্টাচার এর পরিচয়ঃ
আদব শব্দটি আরবি أدب শব্দ থেকে বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত ও প্রচলিত শব্দ; যার অর্থ হলো: বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, সভ্যতা, কৃষ্টি, সুশিক্ষা, নৈতিকতা, মানবিকতা, শোভনতা, শিষ্টাচার। আবার أدب শব্দের অর্থ: নিয়মনীতি, পদ্ধতি ইত্যাদি। আর আদব/শিষ্টাচার মানে— ভদ্র সমাজের রীতি-পদ্ধতি; ভদ্র ব্যবহার। অন্যভাবে বলা যায়: আদব/শিষ্টাচার মানে কাঙ্খিত শিক্ষা, সভ্যতা ও মার্জিত সংস্কৃতির দ্বারা আত্মগঠনের অনুশীলন করা।
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন: কথায় ও কাজে প্রশংসনীয় ব্যবহারকে আদব বলে। আবার কেউ বলেন: উত্তম চরিত্র লালন করাকে আদব বলে। আবার কেউ কেউ বলেন: আদব হলো ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিকে সম্মান করা এবং অধস্তনকে স্নেহ করা। কেউ কেউ বলেন: আদব মানে উত্তম চরিত্র এবং ভালো কাজ। আর আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন: বান্দার মধ্যে উত্তম বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ ঘটানোকে আদব বলে। আবার কেউ কেউ বলেন: প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্যসমূহকেই আদব বলে।
আর আমাদের দেশীয় ভাষায় বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, সভ্যতা, কৃষ্টি, সুশিক্ষা, নৈতিকতা, মানবিকতা, শোভনতা ইত্যাদি গুণাবলী যে ব্যক্তির মধ্যে বিদ্যমান থাকে, তাকে ‘মুআদ্দাব’ (শালীন, ভদ্র ও সুশিক্ষিত) বলে। আর এসব গুণাবলী যার মধ্যে বিদ্যমান নেই, তাকে ‘বেয়াদব’ (অশালীন, অভদ্র, অসভ্য) বলে।
২. আদব এর গুরুত্ব ও তাৎপর্যঃ
মানবজীবন তথা মুসলিম ব্যক্তির জীবনে আদব-শিষ্টাচার এর বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহুল।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
إِنَّ الْهَدْيَ الصَّالِحَ، وَالسَّمْتَ الصَّالِحَ، وَالِاقْتِصَادَ جُزْءٌ مِنْ خَمْسَةٍ وَعِشْرِينَ جُزْءًا مِنَ النُّبُوَّةِ
অর্থঃ নিশ্চয়ই উত্তম চরিত্র, ভালো ব্যবহার ও পরিমিত ব্যয় বা মধ্যপন্থা অবলম্বন করা নবুয়্যাতের পঁচিশ ভাগের এক ভাগ সমতুল্য। -সুনানে আবু দাউদ (৪৭৭৬)
আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন: তুমি আদব অন্বেষণ কর; কারণ, আদব হলো বুদ্ধির পরিপূরক, ব্যক্তিত্বের দলীল, নিঃসঙ্গতায় ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রবাসজীবনের সাথী এবং অভাবের সময়ে সম্পদ।
আর আদব বা শিষ্টাচার এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার দ্বারা ব্যক্তির জীবন পরিশুদ্ধ ও পরিপাটি হয়; আর এ আদব হলো দীন ইসলামের সারবস্তু; সুতরাং মুসলিম ব্যক্তির জন্য জরুরি হলো আল্লাহ তা‘আলার সাথে, তাঁর রাসূল ﷺ এর সাথে এবং সাধরণ মানুষসহ সকল সৃষ্টির সাথে আদব রক্ষা করে চলা; আর এ আদবের মাধ্যমেই একজন মুসলিম জানতে পারবে তার খাবার ও পানীয় গ্রহণের সময় তার অবস্থা কেমন হওয়া উচিৎ; কিভাবে তার সালাম প্রদান, অনুমতি গ্রহণ, বসা, কথা বলা, আনন্দ ও শোক প্রকাশ করা, হাঁচি দেওয়া ও হাই তোলার মত বিবিধ কাজ সম্পন্ন হবে; আর কেমন ব্যবহার হবে তার পিতামাতা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে। এক কথায় এ আদব রক্ষা করে চলার মাধ্যমেই একজন মুসলিম কাঙ্ক্ষিত উচ্চ মানের ভদ্র ও সভ্য মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে এবং নিজেকে অন্যান্য জাতির চেয়ে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে; ফলে দ্বীন ইসলামের সৌন্দর্য ছড়িয়ে যাবে সমাজ, রাষ্ট্র ও দুনিয়ার দিক দিগন্তে। তাইতো কেউ কেউ শিক্ষার চেয়ে আদব বা শিষ্টাচারের বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: তোমরা আগে সুসভ্য হও, তারপর জ্ঞান অর্জন কর। -গিযাউল আলবাব ১/৪৫।
আল-কারাফী রহ. তাঁর ‘আল-ফারুক’ গ্রন্থে বলেন: আর জেনে রাখবে, অনেক বেশি কাজের চেয়ে অল্প আদব অনেক বেশি উত্তম। আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন: ব্যক্তি কোনো প্রকার জ্ঞান দ্বারা মহৎ হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার জ্ঞানকে আদব দ্বারা সৌন্দর্যমণ্ডিত করবে। তিনি আরও বলেন: আমরা অনেক বেশি জ্ঞানের চেয়ে কম আদবকে অনেক বেশি জরুরি বা প্রয়োজন মনে করতাম।
কোনো কোনো দার্শনিক বলেন: আকল (বুদ্ধি) ছাড়া আদব হয় না; আবার আদব ছাড়া আকলও হয় না। অর্থাৎ একটি আরেকটির পরিপূরক। আর জনৈক সৎব্যক্তি তার ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন: তুমি তোমার আমলকে মনে করবে লবণ, আর তোমার আদবকে মনে করবে ময়দা।
অর্থাৎ তুমি আমলের চেয়ে আদবকে এত বেশি গুরুত্ব দিবে, লবণ ও ময়দার স্বাভাবিক মিশ্রণে উভয়ের অনুপাত যেভাবে কম বেশি হয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে কবুল করেন। ( চলবে ইনশাআল্লাহ )
(লেখক : ইমাম ও খতিব, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়)
খুলনা গেজেট/এমএইচবি