খুলনা, বাংলাদেশ | ১১ পৌষ, ১৪৩১ | ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  চট্টগ্রামে শাহ আমানত বিমানবন্দরে চোরাচালানের স্বর্ণ বহনের অভিযোগে যাত্রী আটক, বিমান জব্দ
শ্রদ্ধা ও স্মরণ করে অনেকেই, অনুসরণ করে ক’জনে?

মহৎপ্রাণ এক কিংবদন্তী ডিস্ট্রিক্ট-রেজিস্ট্রার এম এম আব্দুল্লাহ

এস এম আতিয়ার রহমান

খুলনার লোক গবেষক, সাংবাদিক অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনী ভাইয়ের আমন্ত্রণে আমি তাঁর গ্রামের বাড়ি মাগুরার মোহাম্মদপুরের সিন্দাইন গ্রামে যাই, সেটা ২০০৮ সালের মার্চ মাসের কথা। তিনি গ্রামে একটি গ্রন্থাগার করার জন্য পৈত্রিকজমির অংশবিশেষ রেজিস্ট্রি করে দিতে চান। মূলত তাঁর সাথে আমার সংবাদপত্র জগতের কর্মসূত্রের সম্পর্ক ও সিন্দাইন গ্রামের বিষয়ে আমার আগ্রহের কারণে তাঁর সাথে আমিও যাই মোহাম্মদপুর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে। যারা সেখানকার দলিল লেখক তার মধ্যে পরিচিত একজনের সাথে রেজিস্ট্রি প্রক্রিয়া ও খরচাদি নিয়ে কথা বলছিলেন সিন্দাইনী ভাই। বলে রাখা ভালো অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা তাঁর নামের সাথে তাঁর নিজগ্রাম সিন্দাইন যুক্ত করায় তিনি সিন্দাইনী নামেই সমধিক পরিচিত।

যা হোক, দলিল লেখকের সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে রেজিস্ট্রির খরচের সরকারি ফি সহ আরও কয়েক পারসেন্ট (%) অতিরিক্ত প্রদানের বিষয়টি দাবি করলেন দলিল লেখক। সেটি নাকি প্রথা। আরও বললেন, এটি শুধু এখানে নয় সবখানেই দিতে হয় (অনেক ক্ষেত্রে দলিল লেখক সাব-রেজিস্ট্রারের নাম ভাঙ্গিয়ে টাকা নিতে এমন বলেন)। তখন সিন্দাইনী ভাই বললেন আমি তো একটি মহতি কাজে জমি দান করবো সেখানেও কি অতিরিক্ত টাকা দিতে হবে? দলিল লেখক (নাম মনে নেই) তখন বললেন এখন তো আব্দুল্লাহ সাব-রেজিস্ট্রার স্যার নেই? তিনি থাকলে আপনার অতিরিক্ত খরচের প্রশ্নই উঠতো না, কেউ বলতে সাহসও পেতো না। এখন অনেক স্থানেই অতিরিক্ত কিছু খরচ হয়। এখানেই আমি প্রথম আব্দুল্লাহ সাব-রেজিস্ট্রারের নামে একজন কর্মকর্তা ছিলেন এটা প্রথম জানতে পারি। তবে তখন নাম শুনলেও আমার তেমন কৌতুহল হয়নি। নামটাই কেবল শুনেছি এবং একজন ভালো মানুষ, সৎ কর্মকর্তা ছিলেন এটা বোধ করেছি এ পর্যন্তই।

এরপর ২০১২ সালের অক্টোবর মাসের কথা। যশোর শহরে আমার শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি আমার স্ত্রী ও তাঁর বোনদের নামে রেজিস্ট্রি হবে তাই সে উপলক্ষ্যে আমাকে যশোর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে যেতে হয়। সেখানে দলিল লেখকদের শেডে (চালায়) বসে ছিলাম। আমাদের দলিল লেখার কাজ হচ্ছে একপাশে আর অন্যপাশেই আরেকজন দলিল লেখকের চালায় চার-পাঁচজন লোককে দেখতে পাই জমি কেনা-বেচার কাজে দলিল লেখকের সাথে খরচাদি নিয়ে কথা বলতে। একপর্যায়ে খরচের টাকা নিয়ে কথা উঠতে দর কষাকষি লক্ষ্য করি। তাঁরা অতিরিক্ত বেশ কিছু টাকা দেওয়ার ব্যাপারটা নিয়েই মৃদু শোরগোল করছিলেন। তখন ওই কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট বয়স্ক দলিল লেখক বলে বসলেন এটা কি আব্দুল্লাহ সাব-রেজিস্ট্রার সাহেবের যুগ যে কোনো খরচ লাগবে না? হঠাৎ এ নামটা আবার শুনে আমার মধ্যে বেশ কৌতুহল জাগে। মাগুরার মোহাম্মদপুর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কথা মনে পড়লো। সেখানেও তো কয়েকবছর আগে একজন দলিল লেখকের মুখে এ নামটি শুনেছিলাম!

শোরগোল থামতেই আমি এগিয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ দলিল লেখককে সালাম দিয়ে জানতে চাইলাম আপনি যে আব্দুল্লাহ সাব-রেজিস্ট্রারের কথা বললেন উনার কথা তো আমি মাগুরার মোহাম্মদপুরেও শুনেছি। তখন তিনি বললেন হ্যাঁ! উনি ওখানে চাকরি করতেন। খুব ভালো মানুষ, সৎ মানুষ ছিলেন। তাঁর মতো মানুষ হয় না। এমন লোক এখন পাওয়া কঠিন। বয়স্ক দলিল লেখক থেকে শুরু করে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে যারা পুরানো লোক কাজ করেন তারা প্রায় সবাই তাঁর নাম জানেন। তাঁর বাড়ি শুনেছি খুলনায়। আমার কৌতুহল আরও বেড়ে গেলো। মনে মনে বললাম আমিও তো খুলনায় থাকি। যদি খোঁজ পাই তবে সাক্ষাত করে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসবো। তবে ঐ দলিল লেখক খুলনায় তাঁর বাড়ির ঠিকানা বা আর কিছু বলতে পারলেন না। আমার কৌতুহল থেকেই গেলো। এরপর অনেক দিন পার হয়েছে। সত্যি বলতে কি ইচ্ছা থাকলেও নানা ব্যস্ততার জন্য আমি আর সেভাবে খোঁজ নিতে পারিনি। এরপর বেশ কয়েকবছর গত হয়েছে।

২০১৬ সালের অক্টোবরে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব একটি ব্যাংকে চাকরিরত আমার শ্যালিকার ব্যাংক ঋণের টাকায় জমি কেনার ব্যাপারে দলিল করতে খুলনা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে তার সাথে আমাকেও যেতে হয়। প্রথমত এখানে দলিল লেখকদের চালায় অনেকক্ষণ বসে ছিলাম। আমাকে এক জায়গায় স্বাক্ষর করতে হবে। তাই অপেক্ষা। দেখলাম, দলিল লেখক ব্যস্ত, ছুটাছুটি করছেন। তাঁর বয়স হয়েছে, সিনিয়র মানুষ। অন্যান্য দলিল লেখক বা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের অনেকেই তাঁকে ভালোভাবে চেনেন। তাঁকে সমীহ করছেন। এখানে বসে এক ফাঁকে প্রসঙ্গক্রমে আমি তার কাছে জানতে চাই আব্দুল্লাহ নামের কোনো সাব-রেজিস্ট্রারের বা রেজিস্ট্রারের নাম তিনি শুনেছেন কি না বা তার ঠিকানা জানেন কি না ? ভদ্রলোক একবাক্যে বললেন, আব্দুল্লাহ রেজিস্ট্রার স্যার! হ্যাঁ তার নাম জানি, তাঁকে দেখেছি। খুব কম কথা বলতেন। আমি কেনো? সাব-রেজিস্ট্রি অফিস জগতে অনেকেই তো তাঁকে চেনেন। তিনি তো এ জগতে কিংবদন্তীতুল্য মানুষ। খুবই সৎ ছিলেন। ভালো মানুষ ছিলেন। ওনার ছেলে মেয়েরা উচ্চশিক্ষিত হয়েছেন, বড় বড় পদে চাকরি করেন। আমি বললাম ওনার বাড়ির ঠিকানা কি আপনি জানেন? দলিল লেখক সাহেব বললেন, স্যারের বাড়ি তো টুটপাড়ায় ছিলো। অনেকদিন আমি খোঁজ-খবর জানি না। আমি বললাম তার কোনো ছেলে-মেয়ের নাম বা অফিসের ঠিকানা জানেন কি? তিনি বললেন একজনের সন্ধান দিতে পারবো। শুনেছি তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন। নাম সম্ভবত প্রফেসর নাজিমুুদ্দিন। এটুকুই জানতে পেরে আমি আনন্দিত হলাম। এবার তাহলে আমার কৌতুহল পূরণ হবে!

আমি নাম শোনার পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে প্রফেসর শাহনেওয়াজ নাজিমুদ্দিন স্যারের সাথে দেখা করতে যাই। তিনি অর্থনীতির অধ্যাপক। আমি তাঁকে অনেক আগে থেকে জানতাম। আমার স্ত্রী তাঁর ছাত্রী ছিলেন। আমিও মনে মনে ভাবলাম তাইতো! পিতার সাথে তো তারও অনেক মিল আছে। তাঁকেও বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই ভালো মানুষ, সৎ মানুষ, আদর্শ শিক্ষক হিসেবে জানেন। এরপরে কয়েকদিনের মধ্যেই আমি তাঁর কক্ষে প্রবেশ করে সালাম দিয়েই বিনীতভাবে জানতে চাই-স্যার! ব্যক্তিগত একটা বিষয়ে জানতে আগ্রহী হয়ে এসেছি। অনুমতি দিলে…, কথা শেষ না হতেই তিনি আগে আমাকে বসতে বললেন। তারপর বললেন কি এমন বিষয় যে এ পর্যন্ত আসলেন। আমি তখন বললাম, স্যার; আপনার পিতা কি সাব-রেজিস্ট্রার ছিলেন, তাঁর নাম কি এম এম আব্দুল্লাহ? তিনি আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন হ্যাঁ, তবে কেনো বলেন তো? আমি বললাম তাঁর নাম আমি শুনেছি যশোরের মোহাম্মদপুরের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে একটা কাজে গিয়ে। যশোর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ব্যক্তিগত আরকেটি কাজে গিয়েও তাঁর কথা শুনেছি। তিনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন, আমি তাঁর সাথে দেখা করতে চাই, সালাম জানিয়ে আসতে চাই। আমার কথা শেষ না হতেই দেখলাম স্যারের চোখে অশ্রু। নিজেকে সংবরণ করে তিনি বললেন হ্যা, আব্বা ওসব জায়গায় চাকরি করতেন। তবে তিনি তো ইহলোকে নেই। বেশ কয়েক বছর হলো ইন্তেকাল করেছেন। আব্বার জন্য দোয়া করবেন। আমি অনেকটা কষ্ট পেলাম। তা হলে তাঁর সাথে আর দেখা করা হলো না!

যাহোক আমি তাঁর সর্ম্পকে জানতে আগ্রহী হলে স্যার বললেন, আব্বা বৃটিশ আমলে ডিগ্রি করেছেন। তিনি যে সময় লেখাপড়া করেছেন, ডিগ্রি অর্জন করেছেন সে সময় চাইলে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিয়ে জীবনে সচিব হয়ে অবসরে যেতে পারতেন। তাঁর সমসাময়িক অনেকেই সে পদে গেছেন। আব্বা তখন কোলকাতায় চাকরি করতেন। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হলে তাঁকে অপশন দেয়া হয় কোন অবস্থানে তিনি থাকবেন। তিনি তদানিন্তন পূর্বপাকিস্তানে চাকরি করার পক্ষেই সম্মতি দেন। আর পেশার ব্যাপারে তিনি স্কুল জীবন থেকেই চেয়েছিলেন সাব-রেজিস্ট্রার হতে। এরও কারণ আছে। তিনি বলেন আমাদের তেরখাদার বাড়ির সামনে ছিলো নদী। তখন নদীতেই গোসল করতে হতো। ১৯৩৫ সালের দিকের কথা। তিনি যখন নবম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন, একদিন বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে গোসল করছিলেন। তখন ঐ নদীর ঘাটে একটি গয়না নৌকা ভেড়ে। একজন সাব-রেজিস্ট্রার ঐ এলাকায় কোনো এক ধনাঢ্য পরিবারের জমি রেজিস্ট্রি করার জন্য কমিশনে যাচ্ছিলেন। তখন আশে পাশে অনেক লোক ‘হাকিম সাহেবকে’ দেখার জন্য ভিড় করলেন। তিনি গয়না নৌকা থেকে তীরে নামলেন। শ্বেত-শুভ্র পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত ছিলেন হাকিম সাহেব। সৌম্যদর্শন ঐ ব্যক্তিকে দেখে পানিতে দাঁড়িয়ে আকাশপানে চেয়ে আমার আব্বা মহান আল্লাহ পাকের কাছে সাব-রেজিস্ট্রার হওয়ার দোয়া করেছিলেন। জীবনে সে সুযোগ তাঁর আসে এবং তিনি সেই পেশাটাই গ্রহণ করেন।

সাব-রেজিস্ট্রার পদের চাকুরি তখন থেকে আজঅবধি লোভনীয়। কিন্ত আব্দুল্লাহ সাব-রেজিস্ট্রার ন্যায়-নীতিপরায়ণ ও সৎ, কর্তব্যনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন। জানা যায় তাঁকে বলা হতো চলন্ত ঘড়ি। জীবনে তিনি এক মিনিট বিলম্বে কখনও অফিসে ঢোকেননি, আবার অফিসের নির্দিষ্ট সময় পার হলে এক মিনিটিও আর অফিসে থাকেননি। চাকরি জীবনে তিনি মাগুরার মোহাম্মদপুর, মোড়েলগঞ্জ, ফরিদপুর, নোয়াখালীসহ অনেক জায়গায় সুনামের সাথে চাকরি করেছেন। জীবনে ঘুষ কি জিনিস তা তিনি ছুঁয়ে দেখেননি। কেউ তাঁর দ্বারা অন্যায়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হোক, কষ্টপাক তা তিনি চাননি। তাঁর সন্তানেরা লেখাপড়া শিখে মানুষ হোক, সৎভাবে, সম্মানের সাথে জীবনযাপন করুক সেটাই ছিলো তাঁর একান্ত আরাধ্য। এটা প্রতিপালনে জীবনে তাঁর আর্থিকভাবে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। অনেকগুলো সন্তান-সন্ততি নিয়ে তিনি একেবারে সাদাসিদে জীবনযাপন করেছেন। ভোগ-বিলাসিতা তাঁকে কখনও আকৃষ্ট করতে পারেনি। সন্তানদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটেতে পারে, ব্যয় বেড়ে যেতে পরে তাই তিনি তাদেরকে খুলনায় স্ত্রীর কাছে রেখে নিজে একা বিভিন্নস্থানে চাকরি করেছেন। সেখানে নিজের হাতে রান্না করে খেয়েছেন, কাপড় ধুঁয়েছেন। কমিশনে গেলে কোনোদিন সরকারি ফি ছাড়া একটি টাকাও বেশি গ্রহণ করেননি। কোনো পার্টির বাড়ি ভুরিভোজও করেননি। সৌজন্য বা একান্ত অনুরোধে বেশি হলে ডাবের পানি, ফল-ফলাদি খেয়েছেন।

এসব শোনার পর আমি তাঁর সম্পর্কে আরও জানতে আগ্রহী হই। বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারি তিনি অন্তত সদালাপী, সৎ ও নিষ্ঠাবান সাব-রেজিষ্ট্রার ছিলেন। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের এ জগতে সত্যিই তিনি কিংবদন্তীতুল্য মানুষ ছিলেন। যেখানে কাজ করেছেন সেখানে পেশার বাইরেও সমাজ সেবক হিসেবে রাস্তাঘাট নির্মাণে, সংস্কারে, শিক্ষার প্রসারে, মসজিদের উন্নয়নে সহায়তা করেছেন, ভূমিকা নিয়েছেন। সাব-রেজিস্ট্রার পদের মতো লোভনীয় পদে চাকরি করেও তিনি নিজেকে সৎ ও কর্তব্যনিষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে নিষ্কলুষ রাখতে পেরেছিলেন। তাঁকে নিয়ে অনেক সত্য ঘটনাও আছে। জানাযায়, তদানীন্তন যশোর জেলার (বর্তমানে মাগুরা জেলার) মোহাম্মদপুর উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত থাকাকালে তিনি যে পাকাভবনে রাতে থাকতেন সেটি ছিল জরাজীর্ণ। একদিন শেষরাতে তাহাজ্জুদ নামাজের সময় হলে উঠে দেখতে পান ছাদ ভেঙ্গে পড়েছে, উপরের আকাশ দেখা যাচ্ছে। মশারি ছিড়ে পায়ের মাঝে, শরীরের চারদিকে ছাদের খোয়া, বালি-সুরকি বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কিন্তু তাঁর গায়ে একটুকরোও পড়েনি। ১৯৭১ সালের কথা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি ফরিদপুরের যুগ্ম রেজিস্ট্রার ছিলেন। নভেম্বরের শেষ দিকের কথা। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এসে তাঁকে বললেন, স্যার; মাঠে ঘাটে থাকি, রাতে শীতে বড় অসুবিধা হয়। তখন তিনি নিজের চাঁদর লেপ-কাঁথা-বালিশ সবদিয়ে বললেন, বাবারা দেশের জন্য লড়ছো, আল্লাহ তোমাদের সহায় হোন, এগুলো নিয়ে শীত নিবারণ করো।

আরেকটি ঘটনা-ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রার হিসেবে তিনি প্রথম পোস্টিং পান নোয়াখালীতে। ১৯৭৭ সালে তিনি যখন ঐ অফিসে যান তখন পানি-বিদ্যুৎ লাইন সচল ছিলো না। অনেকদিন তা কেউ ব্যবহার করেনি, প্রায় পরিত্যক্ত। তিনি প্রথম ঘরে ঢুকে ওযুর নিয়তে আল্লাহর নাম নিয়ে সুইচ টিপলে বিদ্যুৎ আসে, পানির ট্যাপ ঘুরালেই পানি চলে আসে। এমন অনেক ঘটনাই বা কিংবদন্তী তাঁর সম্পর্কে জানাযায়। তাঁর সততার কথা জানতো সবাই। তাই তাঁর সামনে অনিয়ম বা দুর্নীতির কোনো ফাইল বা কাজ নিয়ে কেউ যেতে সাহস পেতো না।

মহৎপ্রাণ এই ব্যক্তি ইংরেজি ১৯২৩ সালে খুলনার তেরখাদা থানার জুনারি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৯ সালে মেট্রিক্যুলেশন এবং ১৯৪১ সালে আইএ উভয় পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি খুবই নিরহঙ্কার ও সাদাসিদে মানুষ ছিলেন। ৬৩ বছর বয়সে তিনি ১৯৮৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন। রেখে যান রত্নাগর্ভা স্ত্রী এবং আদর্শবান ৫ জন সন্তান। তাঁর জীবনের যে আরধ্য ছিলো তা তিনি জীবদ্দশায় দেখে যেতে পেরেছেন। তাঁর সন্তানেরা সবাই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন। তারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তারাও পিতার-মাতার মতো গুণাবলীধারণ করে চলেছেন। এটা খুব কম লোকের সৌভাগ্যে হয়। তাঁর সন্তানদের মধ্যে তিন কন্যা ও দুই পুত্র। তাঁরা সবাই কমপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তাঁর এক কন্যা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের প্রথম মহিলা ম্যাজিস্ট্রেট যিনি অতিরিক্ত সচিব পদে কর্মরত থেকে অবসরে গেছেন। একপুত্র ও পুত্রবধূ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। অন্য কন্যা ও পুত্র দেশি-বিদেশি সংস্থার উচ্চ পর্যায়ে নির্বাহী পদে কর্মরত।

তাঁদের পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক পেনশনের অনুমোদনের ব্যাপারে তদানীন্তন ইন্সপেক্টর জেনারেল অব রেজিস্ট্রেশন এ.এফ.এম রেজায়ে করিমের সাথে তাঁর ছেলে প্রফেসর ড. শাহনেওয়াজ নাজিমুদ্দিন আহমেদ দেখা করতে গেলে তিনি চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে বলেন, আপনি আব্দুল্লাহ সাহেবের ছেলে! তিনি চেয়ার ছেড়ে এসে দাঁড়িয়ে করমর্দন করেন। তিনি বলেন ‘আমি আপনার পিতাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি, সালাম জানাই। আমাদের রেজিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্টে সাব-রেজিস্ট্রার, জয়েন্ট রেজিস্ট্রার, ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রার মিলিয়ে ৩০০ রেজিস্ট্রার আছেন। তাঁর মধ্যে সততা, বিশ্বস্ততা, নিষ্ঠা, নিয়মানুবর্তিতায় যে দু’চারজনকে আমারা স্মরণ করি আপনার পিতার নাম তাঁর মধ্যে অন্যতম। এ থেকে বোঝা যায় সত্যিকার অর্থে রেজিস্ট্রেশন বিভাগে তিনি সৎ, নিষ্ঠাবান মানুষ ছিলেন। রেজিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্টই কেবল নয়, এমন অনেক বিভাগে এমন সৎ চাকুরিজীবী, এমন ব্যক্তিত্বের আজ বড়ই অভাব। তাঁর সেই রেজিস্ট্রেশন বিভাগের অনেকেই আজও এম এম আব্দুল্লাহর কথা, তাঁর কিংবদন্তীর কথা হয়তো স্মরণ করে, তাঁকে শ্রদ্ধা করে, কিন্তু তাঁকে অনুসরণ করে কয়জনে?

লেখক : পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত), জনসংযোগ ও প্রকাশনা বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

 




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!