বৃটিশ আমল থেকে সমুদ্রগামী শুটকী পল্লী জেলেরা জীবনের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে মৎস্য আহরণ করলেও নানা প্রতিকূলতায় ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে পারেনি তারা। বরং দিন দিন তাদের অবস্থার অবনতি ঘটেছে। ক্রমবর্ধমান ক্ষতির মুখে ইতিমধ্যে পুজি ও জাল নৌকা হারিয়ে অনেকেই পেশা বদলেছেন। আবার অনেকে চড়া হারে মহাজনদের সুদের মাশুল গুনে এ পেশায় টিকে থাকার জন্য কঠোর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
জানা গেছে, বৃটিশ আমল থেকে চলে আশা শুটকী পল্লীর কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে মগ বা সন্দীপ ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় জেলেরা সুন্দরবনের চরে অস্থায়ী বাসা তৈরী করে মৎস্য আহরণ করত। আশির দশক থেকে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা ও পটুয়াখালীর জেলেরা সুন্দরবন এলাকায় শুটকীর জন্য বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকায় মৎস্য আহরণ শুরু করেন। সেই থেকে নানান প্রতিকূলতার মধ্য থেকে জেলেরা মৎস্য আহরণ করে আসছে। জেলেরা ডাঙ্গায় বাঘ, জলে কুমির-হাঙ্গর, বনদস্যু-জলদস্যুর উৎপাত ও বনরক্ষীদের হয়রানীর মধ্যেও তাদের পেশা টিকিয়ে রেখেছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ হাজার ৩২৫ জন শুটকী পল্লীর জেলের কাছ থেকে ২ কোটি ৪৬ লাখ ৬৭ হাজার ৮১৯ টাকা ও ২০১৯-২০ সালে অর্থবছরে ৭ হাজার ৭৮৭ জন শুটকী পল্লীর জেলের কাছ থেকে ২ কোটি ৭৩ লাখ ৯৮ হাজার ৪৮ টাকা সরকারীভাবে রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। যা বিগত বছরের তুলনায় বেড়ে ২৭ লাখ টাকারও বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। সরকার ও বন বিভাগের বাস্তবমূখী পদক্ষেপ গ্রহন করা, সুন্দরবনের দস্যু মুক্ত করায় ও বনবিভাগের অসাধু সদস্যদের হয়রানী বন্ধ হওয়ায় এবং নজরদারী বৃদ্ধি পাওয়ায় সুন্দরবন ও উপকূলীয় শুটকী পল্লী থেকে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বাগেরহাট জেলার রামপাল, মোংলা, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ এলাকার প্রায় ৫ শতাধিক জেলে বহরদার সহ সাতক্ষীরা, খুলনা ও পিরোজপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে ও কয়েকশত জেলে সাধারণত সুন্দরবন থেকে মৎস্য আহরণ করে থাকেন। প্রতি জেলে বহরদার সুদে মহাজনদের কাছ থেকে সর্বনিম্ন ৫ লাখ টাকা থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋন নিয়ে থাকেন। এতে ৫০০ শত জেলে বহরদারের বিপরীতে সুদে মহাজনদের কাছ থেকে অবৈধ পন্থায় ৫০ কোটি টাকার ও বেশি ঋন নিতে হয়। ওই ঋনের বিপরীতে জেলেদের লাখে সুদ গুনতে হয় ২৫-৩৫ হাজার টাকা। অথচ তফশীল ব্যাংকগুলো থেকে জেলেদের সহজ শর্তে ঋন প্রদান করা হলে তাদের অনেক সাশ্রয় হয় বলে তারা জানান।
জেলেরা জানায়, দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় মৎস্য আহরণ করে সরকারকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব দিলেও জেলেদের ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে পারেনি। তারা জানান, মৎস্য সমিতির মাধ্যমে সহজ শর্তে ঋণ না পাওয়ায়, চিকিৎসার জন্য অস্থায়ী বা ভাসমান হাসপাতাল না থাকায়, ঝড় ও জলোচ্ছাস থেকে রক্ষার জন্য সাইক্লোন শেল্টার ও সুপেয় পানি এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকায় সীমাহিন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে জেলেদের। গত ৪০ বছর ধরে সরকার যায়, সরকার আসে কিন্তু কোন সরকারই তাদের কথা রাখেনি। বিগত ও বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এমপিরা এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা আশ্বাসের পর আশ্বাস দিলেও বাস্তবে কেউ তা কখনও পূরণ করেননি।
উপজেলার গিলাতলা গ্রামের সমুদ্রগামী মৎস্যজীবী সমিতির সদস্য সৈয়দ শুকুর আলী জানান, দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে তিনি এ পেশার সাথে যুক্ত রয়েছেন। তার ৬ টি জাল, ৩ টি ট্রলার ও ২৮ জন কর্মচারী নিয়ে চলতি শুটকী মৌসুমে সুন্দরবনে যেতে হচ্ছে। তিনি আরও জানান, এ মৌসুমে সাবাড় (বহার) নিয়ে সমুদ্রে যেতে হলে ২০ লক্ষ টাকার প্রয়োজন। এ টাকার চাহিদা পূরণ করতে আমাকে ব্রাক এনজিও থেকে ১০ লক্ষ টাকা, আশা এনজিও থেকে ৪ লক্ষ টাকা ও বাকী টাকা ৬ লক্ষ টাকা এলাকার সুদে মহাজনদের কাছ থেকে মাত্র সাড়ে ৫ মাস মেয়াদে চড়াসুদে ঋন নিতে হয়েছে। একই কথা বলেন রামপাল সদরের ফরহাদ শেখ। তিনিও জানান, প্রায় ২৮ লক্ষ টাকা ব্যয়ে তাকে সাগরে যেতে হচ্ছে। এর মধ্যে নিজস্ব তহবিল থেকে সাড়ে ৯ লক্ষ টাকা ও বাকী টাকা চড়াসূদে এলাকার মহাজনদের কাছ থেকে ১ লক্ষ টাকায় ২৫ হাজার টাকা করে সূদে ঋন নিতে হয়েছে। যা মাছ ধরার পর পরই পরিশোধ করা শুরু করতে হবে। একই কথা জানান, শ্রীফলতার শাহাজান শিকদার, সিকিরডাঙ্গার জুলফিক্কার গাজী, শ্রীফলতলার মোঃ জয়নাল শেখ, আনছার শিকদার, আক্কাছ আলী শেখ, ইউছুব আলী শেখ, রামপাল সদরের জব্বার শেখ প্রমূখ। তারাও একইভাবে ঋন করে সমুদ্রে যান।
সমুদ্রগামী জেলে পল্লীর সভাপতি ও রামপাল সদরের বাসিন্দা শহিদ মল্লিক জানান, প্রতি বছর আমরা বিভিন্নভাবে ঋন করে সমুদ্রে যাই। সরকারী ভাবে আমরা কোন সাহায্য সহযোগীতা পাই না। প্রতি বছর মন্ত্রী-মিনিস্টার ও বনবিভাগের কর্মকর্তারা গিয়ে আমাদের সমস্যার কথা শোনেন এবং সমাধানের জন্য আশ্বাস প্রদান করেন। আজও পর্যন্ত আশ্বাসের কোন সুফল আমরা পাইনি। সুন্দরবনের বনদস্যু-জলদস্যুর উৎপাত ও মুক্তিপন আদায় এবং অসাধু বনরক্ষীদের দৌরাত্ব কিছুটা বন্ধ হলেও এখনও সীমাহীন সমস্যায় জর্জরিত আমরা। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা প্রতি বছর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র থেকে মাছ ধরে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব সরকারকে দেই। কিন্তু আমারা সহজ শর্তে কোন ঋন পাই না, চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, স্যানিটেশন এর ব্যবস্থা নেই, সুপেয় পানির অভাব এমনকি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আশ্রয় নেওয়ার মত কোন ব্যবস্থাও নেই। জেলেদের সকল সমস্যা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণসহ ব্যবস্থা গ্রহনের জোর দাবী জানান।
এ বিষয়ে সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ লায়ন ডক্টর শেখ ফরিদুল ইসলাম জানান, সুন্দরবন আমাদের প্রাকৃতিক রক্ষা কবজ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের মায়ের মত আগলে রেখেছে। কিন্তু আমাদের লোভের বলি হয়ে মারত্মক বিপর্যায়ের মুখে পড়েছে ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ এ বন। এ বনকে রক্ষা না করলে আগামীতে এ এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারাত্মকভাবে বিপন্ন হতে পারে। এ জন্য বনের বাস্তুতন্ত্র বা ইকো সিস্টেম রক্ষায় সরকারী-বেসরকারীভাবে সকলকে সমান উদ্যোগ গ্রহণ করে এগিয়ে আসতে হবে। জেলেরা যাতে বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করে শুটকীর জন্য মৎস্য আহরণ করতে পারে সেজন্য বন বিভাগের ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য তিনি সরকারীভাবে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের দাবী জানান।
সমুদ্রগামী মৎস্যজীবী সমিতির উপদেষ্টা ও রামপাল উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আঃ জলিল জানান, জেলেরা প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব প্রদান করে থাকে। এরা খুবই গরীব ও প্রান্তিক জেলে। অর্থের অভাবে তারা জীবনের মায়া ত্যাগ করে গভীর বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যায়। চড়াসুদে এলাকার মহাজনদের কাছ থেকে ঋন নিয়ে থাকে। এতে সুদের কিস্তি দিতে গিয়ে সর্বশান্ত হয়ে পড়ে। উপকূলীয় জেলেদের সহজ স্বার্থে ঋন প্রদান করা হলে তারা তাদের পেশা টিকিয়ে রাখতে পারবে। পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা তীব্র লবনাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে এক সময় মৎস্য আহরণ ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে, এ জন্য তাদের বিকল্প পেশার ব্যবস্থা করতে হবে। জেলেরা যাতে প্রশিক্ষণ নিয়ে শুটকী প্রক্রিয়াজাতকরণ করতে পারে এজন্য তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। শিশু শ্রম বন্ধের বিষয়টিও নজরদারী করতে হবে। চিকিৎসার জন্য ভাসমান হাসপাতাল, সুপেয় পানির জন্য পুকুর খনন ও জেলেদের নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। তাদের জীবন মান উন্নয়নের জন্য সরকারীভাবে বরাদ্দ প্রদান করতে হবে।
এ বিষয়ে সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের ডিএফও মুহম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, সুন্দরবন একটি ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। এ বনকে আমাদের বনবিভাগের চৌকস বাহিনী দিয়ে নজরদারীর আওতায় আনা হয়েছে। এরই অংশ হিসাবে গোটা সুন্দরবনে আধুনিক স্মার্ট প্যাট্রোলিং এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। জেলে, বাওয়ালী, মৌয়ালসহ অন্যান্য পেশাজীবীরা যাতে নির্বিঘ্নে বনজ সম্পদ আহরণ করতে পারে সেজন্য বনবিভাগের পক্ষ থেকে সকল প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বনের সুরক্ষা নিশ্চিতে তিনি সকলের সহযোগীতা কামনা করেন।
খুলনা গেজেট / এমএম