সাড়ে তিন বছরের শিশু আদিব হাসান আপন। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে গিয়ে খুঁজছে বাবাকে। বাবা বাবা বলে ডাকছে। জিজ্ঞাসা করলে তিন বছরের আদিব বলে বাবা ওখানে গেছে। সে জানে তার বাবা ওই ঘর থেকে বের হয়ে আসবে। ছোট শিশু জানেনা যে তার বাবা আল আমিন ইমনকে সকালে সন্ত্রাসীরা ছুরি দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেছে। তার এ রকমের কান্ড দেখে উপস্থিত সকলে কাঁদতে থাকে।
বৃহস্পতিবার বেলা দুটোর দিকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মার্গের সামনে গিয়ে দেখা যায় এমন চিত্র। ছোট আদিব কখনও মায়ের কোলে আবার কখনও চাচার কোলে গিয়ে বাবাকে খুঁজতে থাকে। এক সময়ে বাবাকে না পেয়ে অঝরে কাঁদতে থাকে সে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রান্না ঘরের এক কোনায় দাড়িয়ে কাঁদতে দেখা যায শাশুড়ি হেলেনা বেগমকে। মেয়ে জামাইকে হারিয়ে তিনি বাবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। কিছুতেই তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না যে তার মেয়ে জামাই সন্ত্রাসীর হাতে খুন হয়েছেন। কিছুক্ষণ পর তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, মেয়ে জামাই আল আমিন ওরফে ইমন বেসরকারি একটি মোবাইল কোম্পানীতে কর্মরত ছিলেন। গত এক-দেড় মাস আগে খালিশপুর এলাকা থেকে টাকা সংগ্রহ করে খুলনায় আসার পথে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে। ছুরি দেখিয়ে সে সময়ে তার কাছ থেকে নগদ ৩০ হাজার টাকা ও ১০ হাজার টাকা মূল্যের মোবাইল কার্ড ছিনিয়ে ছিনতাইকারীরা নিয়ে যায়। পরবর্তীতে এ ঘটনায় আল আমিন ওরফে ইমন খালিশপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করে। জিডিতে তিনি ছিনতাইকারীদের মোটরসাইকেল নম্বর উল্লেখ করে। পুলিশ যদি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করত তাহলে আজ এ ঘটনা দেখতে হত না তার বলে তিনি আরও জানান।
অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখা যায় নিহত আল আমিনের স্ত্রী লামিয়া ইসলাম সুমিকে। এমন তিনি বিলাপ করতে থাকেন ‘আমায় ছাড়া তুমি থাকতে পারনা’। ‘তোমাকে ছাড়া আমি একা থাকতে পারব না। ‘আমি তোমাকে কখনও রাগ করবনা’। ‘আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি;। ‘তোমাকে ছাড়া আমি মরে যাব’। ‘কখনও আর রাগ করবনা’। ‘তুমি ফিরে আস’।
পাশ থেকে একজন শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে সেও কাঁদতে থাকে। কিছুক্ষণ পর লামিয়া শান্তু হয়ে উপস্থিত সাংবাদিদের বলেন, সকাল ৮ টার দিকে আল আমিন ও তার পরিবার সোনাডাঙ্গা মডেল থানাধীন নবপল্লি এলাকা থেকে বের হন। ছেলে আদিবকে নিয়ে তিনি ট্রাক স্ট্যান্ড সংলগ্ন সানা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে চলে যান। সকাল সোয়া ১০ টার দিকে বেসরকারি মোবাইল ফোন কোম্পানী থেকে তাকে ফোন দিয়ে বলা হয়- তার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। পরবর্তীতে তিনি হাসপাতালে গেলে সেখান থেকে তাকে মর্গের সামনে আনা হয়। তিনি বলেন, আমার স্বামীর সাথে কারও কোন দ্বন্ধ নেই। তবে তাকে কেন এভাবে মরতে হল।
নিহতের বড়ভাই রাজিবুল ইসলাম বলেন, আল আমিন কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জাড়িত নয়। কোন অপকর্মের সাথেও নেই সে। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। এটি ছিনতাইয়ের ঘটনা নয়। ছিনতাইয়ের ঘটনা হলে তার কাছ থেকে মোবইল বা মোটরসাইকেল কেড়ে নেবে। সামান্য আঘাত করে ছেড়ে দিবে। কিন্তু তা না করে তাকে মেরে ফেলবে কেন। এ হত্যাকান্ডের পেছনে অন্য কোন কারণ রয়েছে। পুলিশ তদন্ত করলে সব বের হয়ে আসবে। তিনি এ হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু বিচার চান।
এদিকে দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে সোনাডাঙ্গা মডেল থানার দু’জন কর্মকর্তা মরদেহ নেওয়ার আগ মুহুর্তে মর্গের সামনে গিয়ে নিহতের স্ত্রীর কাছ থেকে ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নিয়ে নেয়। তখন তিনি পুলিশদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন আপনারা আমাকে সন্দেহ করেন। আপনারা আমার ফোন নিচ্ছেন কেন। এ সময়ে ওই পুলিশ কর্মকর্তা উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, এ হত্যাকান্ডের ব্যাপারে রহস্য আছে। সবকিছু পরিস্কার হয়ে যাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সোনাডাঙ্গা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ শফিকুল ইসলাম বলেন, দুর্বৃত্তরা হত্যাকন্ডে তাদের কৌশল পরিবর্তন করেছে। এ হত্যাকান্ডটি এমনভাবে ঘটছে যে কেউ বুঝবে না যে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে ৯ টার দিকে স্ত্রী ও ছেলেকে স্কুলের উদ্দেশ্যে নামিয়ে দিয়ে আল আমিন অফিসের দিকে যাচ্ছিল। ২২ তলা ডেল্টা ভবনের সামনে আসামাত্র একটি মোটরসাইকেল তার গতিরোধ করে আর পেছন থেকে আসা অপর মোটরসাইকেলে থাকা সন্ত্রাসী তার পেটের বাম পাশে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে মোটরসাইকেল থেকে পড়ে গেলে উপস্থিন জনতা তাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিলে সেখানে তার মৃত্যু হয়।
তিনি আরও বলেন, ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকার সিসি টিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। আসামিদের শনাক্ত করনের চেষ্টা চলছে। কেউ সন্দেহের বাইরে নয়। তবে রাতে এ ঘটনার সাথে জাড়িত সকল আসামিরা গ্রেপ্তার হতে পারে বলে তিনি এ প্রতিবেদককে আরও জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার সকালে বেসরকারি মোবাইল অপারেটরে কর্মরত আল আমিন অফিসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সোনাডাঙ্গা মডেল থানাধীন নবপল্লী এলাকার বাড়ি থেকে বের হন। এর কিছুক্ষণ পর ওই এলাকার ২২ তলা ডেল্টা ভবনের সামনে পৌছালে সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান তিনি। দুপুর সাড়ে ৩ টার দিকে তার ময়না তদন্ত শেষে বড়ভাই রাজিবুল ইসলামের কাছে মরদেহ বুঝিয়ে দেওয়া হলে গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট জেলার চিতলমারী উপজেলার হিজরা গ্রামের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।
খুলনা গেজেট/ টিএ