‘অবৈধ অস্ত্র ও ছাত্র-জনতার হত্যাকারীরা’ লুকিয়ে আছে—এমন কথা রটিয়ে ‘মব’ সৃষ্টি করে ঢাকার গুলশানে একটি বাড়ি লুট করতে যায় একদল লোক। ৪ মার্চ মধ্যরাতে এ ঘটনার নেতৃত্বে ছিলেন জুয়েল খন্দকার নামের এক ব্যক্তি। যিনি নিজেকে ‘জাতীয়তাবাদী চালক দল’-এর সাধারণ সম্পাদক বলে পরিচয় দেন।
এ ঘটনার পর আলোচনায় আসে জাতীয়তাবাদী চালক দল। এটা কী ধরনের সংগঠন, কারা বানিয়েছে এটা? এর সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপির কোনো যোগসূত্র আছে কি না। বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের কেউ এই সংগঠনকে স্বীকৃতি দিতে রাজি নন। কেউ বলেন, এগুলো সব ‘দোকান’; কেউবা বলেন, ‘ভুঁইফোড়’ সংগঠন। বিএনপির নাম ভাঙিয়ে ‘ধান্দা’ করার জন্য সামনে এমন সংগঠন সামনে আরও বাড়তে পারে বলেও নেতাদের অনেকে আশঙ্কা।
কিন্তু জাতীয়তাবাদী চালক দলের সভাপতি জসিম উদ্দিন কবিরের দাবি ভিন্ন। তিনি বলেন, তাঁদের এই সংগঠনের আবির্ভাব ২০১৪ সালে। এরপর বিভিন্ন সময়ে প্রেস ক্লাবের ভেতরে ও সামনের সড়কে তাঁরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন। সেসব কর্মসূচিতে বিএনপির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাও অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন।
জসিম উদ্দিন জানান, তাঁর গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জে। তিনি আগে মোটরচালক দলের সঙ্গে ছিলেন। সেখানে জুয়েল খন্দকারও ছিলেন। পরে ২০১৪ সালে এসে জসিম নিজে ‘জাতীয়তাবাদী চালক দল’ নামে নতুন সংগঠন তৈরি করেন। তিনি ২০২২ সালে জুয়েল খন্দকারকে এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক করেন। তাঁদের ৭১ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি আছে বলেও দাবি করেন।
জুয়েল বলেন, পেশাদার গাড়িচালকদের মধ্যে যাঁরা বিএনপির সমর্থক, তাঁদের এক প্ল্যাটফর্মে আনার জন্য তিনি এই সংগঠন করেছেন। তবে তিনি নিজে পেশাদার গাড়িচালক নন। তিনি অন্য একটা কাজে যুক্ত, সেটা কী, তা বলতে রাজি হননি।
জসিম বলেন, তাঁর সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জুয়েল খন্দকারের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায়, ঢাকায় বাড্ডা এলাকায় থাকেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মধ্য বাড্ডা এলাকায় প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। জুয়েল একসময় ভাড়ায় (রেন্ট-এ-কার) গাড়ি চালাতেন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের তিনি আর গাড়ি চালান না। এরপর থেকে জুয়েল মধ্য বাড্ডা এলাকায় ‘সালিস-বিচার’ করা শুরু করেন।
গুলশানে বাড়ি লুটের ঘটনায় জুয়েল খন্দকার ও তাঁর ছেলে শাকিল আহমেদসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এরপর জুয়েলকে জাতীয়তাবাদী চালক দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছেন বলেও জানান সংগঠনের সভাপতি জসিম উদ্দিন।
জসিমের ভাষ্য, জুয়েল খন্দকার আগে এত খারাপ লোক ছিলেন না। বিএনপির রাজনীতি করতে গিয়ে আগে একাধিকবার জেলও খেটেছেন; কিন্তু ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর হঠাৎ বদলে যান তিনি। আধিপত্য বিস্তারে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর এমন পরিবর্তনকে ‘অবিশ্বাস্য’ বলে মন্তব্য করেন জসিম।
‘অবৈধ অস্ত্র ও ছাত্র-জনতার হত্যাকারীরা’ লুকিয়ে আছে—জুয়েল খন্দকার এমন কথা রটিয়ে বাড্ডা এলাকা থেকে কয়েক শ লোক নিয়ে ৪ মার্চ মধ্যরাতে রাজধানীর গুলশানের একটি বাসায় হামলা ও লুটপাট করেন। ওই রাতে পুলিশ জুয়েল ও তাঁর ছেলেসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। পরে জানা গেল, জুয়েলের ছেলে শাকিল একসময় ওই বাসার ‘কেয়ারটেকার’ (তত্ত্বাবধায়ক) ছিলেন। ওই বাড়িটি প্রয়াত এইচ টি ইমামের ছেলে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য তানভীর ইমামের বলে রটিয়েছিলেন বাবা-ছেলে। পরে জানা যায়, বাড়িটি তানভীর ইমামের সাবেক স্ত্রীর, যার সঙ্গে তানভীরের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে ২০-২৫ বছর আগে।
‘জাতীয়তাবাদী চালক দল’-এর সভাপতি হিসেবে নিজের পরিচয় দেন জসিম উদ্দিন। কৃষক দলের এক অনুষ্ঠানে গিয়ে সেলফি তুলেছেন তিনি।
বাড্ডা এলাকার বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মধ্য বাড্ডা এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন জুয়েল। চালক দলের ব্যানারে তিনি এলাকায় এক-দেড় শ জনের একটি গ্রুপ পরিচালনা করতেন। এলাকার বিচার-সালিস সবকিছুই তাঁর হস্তক্ষেপের কারণে স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিলেন। এর জেরে গত জানুয়ারিতে গুলিবিদ্ধ হন জুয়েল।
যদিও জাতীয়তাবাদী চালক দল নামে বিএনপির স্বীকৃত কোনো সংগঠন নেই। বিএনপির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য বলছে, দলটির সাতটি অঙ্গসংগঠন রয়েছে। এগুলো হচ্ছে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল, যুবদল, মহিলা দল, জাসাস, কৃষক দল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও তাঁতি দল। এ ছাড়া আরও দুটি সহযোগী সংগঠন রয়েছে বিএনপির। এগুলো হলো ছাত্রদল ও শ্রমিক দল।
তাহলে জাতীয়বাদী চালক দল নামের এরা কারা—এই বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এরা ভণ্ড, প্রতারক। এরা বিএনপির কেউ না।’
কিন্তু বিএনপির লোক পরিচয় দিয়েই তো গুলশানের ঘটনা ঘটিয়েছে; এ কথা জানানোর পর রিজভী বলেন, ‘পুলিশকে বলব তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।’
তবে চালক দলের ব্যানারে আয়োজিত কর্মসূচিতে বিভিন্ন সময়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতাকে অংশ নিতে দেখা গেছে।
বিএনপির মধ্য সারির একজন নেতা বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ‘লীগ’ ও শেখ পরিবারের সদস্যদের নাম শব্দ যুক্ত করে বেশ কিছু ভুঁইফোড় সংগঠন গড়ে উঠেছিল। তাদের মূল কাজ ছিল ধান্দা, তদবির করে টাকা কামানো। সামনে বিএনপির সুসময় আসছে—এমনটা ধরে নিয়ে নামের সঙ্গে ‘জাতীয়তাবাদী’ ও ‘দল’ যুক্ত করে বা জিয়া পরিবারের নাম ব্যবহার অনেক ভুঁইফোড় সংগঠনের আবির্ভাব হতে পারে মনে করছেন।
যদিও বিএনপির নাম ভাঙিয়ে যারা বা বিভিন্ন নাম যোগ করে সংগঠন করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন দলটির নেতারা। গত ২৪ অক্টোবর দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছিলেন, ‘শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও জাতীয়তাবাদী নামে কোনো সংগঠন করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিএনপির কেউ যদি ভুঁইফোড় সংগঠনের ব্যানারে যায়, তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
খুলনা গেজেট/এনএম