একটি ওয়ার্কশপের আলোচনা সভায় যোগদানের আমন্ত্রণ পেলাম। টেলিফোনে আয়োজক প্রতিষ্ঠানের প্রধান বললেন, ভাই আপনাকে আসতে হবে। অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা ৪২ জন। আপনি প্রধান বক্তা। বিষয় হচ্ছে ‘ভ্যাট ভীতি’। প্রতিষ্ঠানের সংগঠক অনড়। যেতেই হবে। ২ ঘণ্টার সেশন। আরো একবার টেলিফোন। প্রশিক্ষণার্থীদের সংক্ষিপ্ত প্রোফাইল সম্পর্কে ধারণা নিলাম। সে অনুযায়ী প্রেজেন্টেশন তৈরি করলাম।
অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখলাম, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ ভ্যাট পরামর্শক; আছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টস বিভাগের কর্তাব্যক্তিরাও। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষের ব্যবসায়ীরাও অংশ নিচ্ছেন। কথা বলার জন্য উত্তম একটা ফোরাম মনে হলো। গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে আলোচনা প্রাণবন্ত করার জন্য দর্শকের সারিতে এসে অবস্থান নিলাম। কিছু আলোচনায় বুঝলাম, ভ্যাট ব্যবস্থা সম্পর্কে অনেকের কম-বেশি জ্ঞান আছে। এবার সরাসরি প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম। ভ্যাট সম্পর্কে মানুষের ভীতি কেন? আপনারা অনেক ব্যবসায়ী গ্রুপকে প্রতিনিধিত্ব করছেন। আপনাদের মতামতই একটা বাস্তব চিত্র হতে পারে। তাদের আশ্বস্ত করলাম, এ মতামত গবেষণার বিষয় হতে পারে এবং তা নীতিনির্ধারণেও অবদান রাখতে পারে। ফোরামকে বললাম, ভ্যাট ব্যবস্থায় তিনটা পক্ষ, যেমন ক্রেতা, বিক্রেতা ও মনিটরিং কর্তৃপক্ষ (ভ্যাট কর্মকর্তা) রয়েছে; আপনারা বিভিন্ন ভূমিকায় মন খুলে কথা বলতে পারেন। এর থেকে একটা বস্তুনিষ্ঠ চিত্র উঠে আসবে।
এ মুক্ত আলোচনায় বিভিন্ন জন বিভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। এ সভা থেকে যে মতামত পাওয়া গেল এখানে তা তুলে ধরলাম। ক্রেতা, বিক্রেতা ও তত্ত্বাবধায়কের ভিন্ন তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি এ আলোচনার মূল উপজীব্য।
ক্রেতাপক্ষ: আলোচকরা মূলত ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তা সত্ত্বেও তারা কোনো না কোনো পর্যায়ের ক্রেতা। এমনকি কোনো উৎপাদিত পণ্যের উপকরণ সংগ্রহের সময়ও তাদের ক্রেতা হিসেবে মনস্তাত্ত্বিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। সে হিসেবে তাদের মতামত গুরুত্বপূর্ণ। এসব বক্তব্য অনুযায়ী ক্রেতাদের ভীতি মূলত পাঁচ ধরনের হতে পারে। প্রথমত, একজন ক্রেতার মনস্তত্ত্ব থাকে সবচেয়ে কম দামে ভালো পণ্য ক্রয় করা। আর এজন্য তিনি নানাভাবে পণ্য বা সেবা সম্পর্কে খোঁজখবর নেন; নানা তথ্য সংগ্রহ করেন। এটি সীমিত আয়ের ক্রেতাদের জন্য বেশি প্রযোজ্য। এই ক্রেতাদের মতে, যত কম দাম দেয়া যায়, তত তাদের সাশ্রয় হয়। তাদের ধারণা, ভ্যাট পণ্যমূল্যের ওপর বাড়তি বোঝা; এটি পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়। তাই তাদের আগ্রহ থাকে ভ্যাট না দিয়ে পণ্য বা সেবা ক্রয় করা। মূলত ক্রেতারা নিজেদের পকেট বাঁচানোর চিন্তা থেকে ভ্যাটের প্রতি অনীহা প্রকাশ করেন। এর থেকে ভীতিও যুক্ত হয়ে পড়ে। যখনই ভ্যাট প্রসঙ্গ চলে আসে তখন ওই শ্রেণীর ক্রেতারা তা সচেতনভাবে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয়ত, ভ্যাট সম্পর্কে অনেক ক্রেতা তেমন জ্ঞান রাখেন না। এটি তারা ‘চাপানো কর’ বলে মনে করেন। কেউ কেউ এটিকে ‘চাঁদা’র সঙ্গে তুলনা করতে চান। জনগণের ‘পকেট কাটার কৌশল’ হিসেবে কেউ বর্ণনা করেন। কেন এ কর ধার্য করা হয়েছে, বা এ কর দিয়ে কী করা হয়, কীভাবে তা ব্যয় হয়—এ সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই কোনো কোনো ক্রেতার। এ কর ব্যবস্থার নৈতিক ভিত্তি এবং রাষ্ট্রে এর নেট প্রভাব নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন। প্রকৃত অর্থে, ভ্যাট ব্যবস্থা সম্পর্কে সাধারণের যথাযথ জ্ঞানের ঘাটতির একটি সংযোগ রয়েছে এ ধারণায়। তৃতীয়ত, একইভাবে, এসব ক্রেতাসাধারণ ভ্যাট কেন দেবেন তার একটি সঠিক যুক্তি বা ব্যাখ্যা চান। যেমন— আমি রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম, ১০ শতাংশ হারে ভ্যাট দিলাম। কিন্তু এর বিনিময়ে আমি কী পাচ্ছি? আমি যা আয় করছি, তা নিঃসন্দেহে কষ্টার্জিত টাকা। এ টাকা থেকে পণ্যমূল্যের ওপর অতিরিক্ত টাকা দিয়ে রাষ্ট্র থেকে আমি যে সুবিধা পাচ্ছি তা কি যথেষ্ট? এসব ক্রেতার কেউ কেউ সন্দিহান, আবার কেউ কেউ হয়তো প্রাপ্তির সঙ্গে তা মেলাতে পারছেন না। কেউ কেউ রাজস্ব আহরণের আয় থেকে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের স্বচ্ছতার প্রশ্ন তুলছেন। একাংশের ধারণা, ভ্যাটের নামে সংগৃহীত কর সঠিক ও সুষমভাবে ব্যয় হয় না। এখানে কর প্রদানের বিনিময়ে প্রাপ্তিতে ঘাটতির ধারণা কাউকে কাউকে অনাগ্রহী করে তুলেছে। চতুর্থত, কোনো কোনো ক্রেতা আবার মনে করেন, যে ভ্যাট প্রদান করা হয় তা সরকারি কোষাগারে সঠিকভাবে জমা হয় না। তাদের মতে, প্রদানকৃত ভ্যাট ব্যবসায়ীরা জমা দেন না; এ ভ্যাট ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে যায়। মাঝেমধ্যে মিডিয়ায় ভ্যাট ফাঁকির চিত্র প্রকাশে এসব ক্রেতা বিচলিত হন; তাদের ধারণা আরো বদ্ধমূল হয়। কেউ কেউ মনে করেন, ‘ভ্যাট দিয়ে লাভ কী? আমার দেয়া ভ্যাট অন্য কারোর পকেটে যাক, আমি চাই না।’ অনেকে ভ্যাট দিতে চান, কিন্তু তারা একই সঙ্গে নিশ্চিত হতে চান, প্রদানকৃত ভ্যাট সরকারি কোষাগারে যথাযথভাবে জমা হোক এবং সরকারি উন্নয়নে যথাযথভাবে ও স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যয় হোক। এ ধারণার সঙ্গে ভ্যাট সংগ্রহে মনিটরিং ও আয়কৃত রাজস্বের স্বচ্ছ ব্যয় ব্যবস্থার দুর্বলতার একটি ইঙ্গিত রয়েছে। পঞ্চমত, ভ্যাটের হার অনেক বেশি। সাধারণ পণ্য বা সেবার ওপর আরো নির্দিষ্ট হারে ভ্যাট যুক্ত করলে ক্রেতার ‘ত্রাহি ত্রাহি’ অবস্থা সৃষ্টি হয়। অনেক ক্ষেত্রে এ হার ১৫ শতাংশ। সাধারণ ক্রেতার অনেকে মনে করেন, তাদের ক্রয়ক্ষমতা সর্বদা চাপে থাকে; ভ্যাটের এ বাড়তি চাপ তাদের জন্য সুখকর বিষয় হিসেবে বিবেচিত নয়। তাই ভ্যাট এড়িয়ে চলতে চান তারা।
বিক্রেতাপক্ষ: আমরা সবাই জানি, ভ্যাট ব্যবস্থার মূল ভূমিকা পালনকারী হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তারাই প্রকৃত অর্থে ভ্যাট আদায় করেন। ভ্যাট আইন অনুসারে ব্যবসায়ীরা ক্রেতার কাছ থেকে নির্ধারিত পদ্ধতিতে ভ্যাট সংগ্রহ করে তা রিটার্নের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে থাকেন। ভ্যাটের দায় তাদের নয়, ভ্যাট দেন ক্রেতাসাধারণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভ্যাটের ভীতি রয়েছে ব্যবসায়ীদের। কিন্তু কেন? প্রথমত, ব্যবসায়ীদের একটি অংশ মনে করেন, ‘আইন অনুযায়ী ভ্যাট ক্রেতারা দেবেন। এটি কেতাবি বাক্য। কিন্তু বাস্তবে অনেক ক্রেতা ভ্যাট দিতে চান না।’ এর কারণ হিসেবে তারা মনে করেন, ভ্যাট সম্পর্কে ক্রেতারা তেমনভাবে জানেন না। ক্রেতাদের জানানো সম্পর্কে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে মর্মে তারা দৃঢ়ভাবে মনে করেন। ক্রেতারা যদি ভ্যাট না দেন, একজন ব্যবসায়ী তা আদায় করতে গেলে ‘অনাহূত অবস্থা’ তৈরি হয়। ফলে অনেক সময় তাদের ক্রেতা হারাতে হয়। তারা মনে করেন, ভ্যাট সম্পর্কে ক্রেতাদের জানতে হবে, তাদের জানাতে হবে। ভ্যাটের বিষয়ে ক্রেতাদের ‘মোটিভেশন’ দিতে হবে; প্রয়োজনে তাদের প্রণোদনার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ জায়গায় একটা শূন্যতা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, ব্যবসায়ীরা কেন সরকারের পক্ষে ভ্যাট আদায় করে দেবেন? একটি অংশ মনে করেন, তাদের উৎসাহিত হওয়ার কোনো কারণ নেই এ ব্যবস্থায় জড়িত হওয়ার। এমন যদি হতো, সংগৃহীত ভ্যাটের একটি অংশ তারা রেখে দিতে পারবেন, তাহলে এ ব্যবস্থায় তারা আগ্রহসহকারে সম্পৃক্ত হতেন। কোনো ধরনের প্রণোদনা ব্যতিরেকে একটি জটিল হিসাবনির্ভর কর ব্যবস্থাকে কেউ কেউ ‘বাড়তি ঝামেলা’ মনে করেন। এ কর ব্যবস্থা তারা অত্যন্ত নেতিবাচক হিসেবে দেখতে চান। সামগ্রিকভাবে তারা ভ্যাট ‘ব্যবসাবান্ধব নয়’ মনে করে এটিকে নিজের দায়িত্ব হিসেবে নিতে আগ্রহী নন। তাই সময়ে সময়ে এদের একটি অংশকে বিভিন্ন ফোরামে ভ্যাট ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে দেখা যায়। তৃতীয়ত, ভ্যাটের হিসাব অত্যন্ত জটিল মনে করেন কোনো কোনো ব্যবসায়ী গ্রুপ। ভ্যাটদাতারা তাদের নিজস্ব হিসাবরক্ষণ পদ্ধতির বাইরে আইনে বর্ণিত অতিরিক্ত হিসাব, খাতাপত্র ও রিটার্ন দাখিল প্রক্রিয়াকে সহজভাবে মেনে নেন না। এ হিসাব সংরক্ষণ পদ্ধতির জন্য ব্যবসায়ীকে ভ্যাট পরামর্শক বা বাড়তি স্টাফ নিয়োগ করতে হচ্ছে; সঙ্গে কাগজপত্রসহ কম্পিউটার, ইন্টারনেট, সিস্টেম ক্রয় ও মেরামতের জন্য খরচাদিও যুক্ত হচ্ছে। কোথাও কোনো ভুল হলে গুনতে হচ্ছে জরিমানা, সুদ ও আর্থিক দণ্ড। এসব খরচাদি পণ্যমূল্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে, যা ক্রয়ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ফলে ক্রেতা হারাচ্ছে অপেক্ষাকৃত সৎ ব্যবসায়ীরা। এসব ব্যবসায়ী তাই ভ্যাট ব্যবস্থাকে মনে-প্রাণে মেনে নিতে পারছেন না। চতুর্থত, কোনো কোনো ব্যবসায়ীর অভিযোগ, তারা ভ্যাট আদায় করতে চান। আবার সেই ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমাও করতে চান। তবে তারা ভ্যাট কর্মকর্তাদের সম্পর্কে নানা ধরনের হয়রানির অভিযোগের ইঙ্গিত তোলেন। যথাযথ প্রক্রিয়ায় সঠিক ভ্যাট প্রদান করলেও তারা নানা আইনি জটিলতায় কোনো কোনো সময় ‘হোঁচট’ খেয়েছেন। মনিটরিং কর্তৃপক্ষের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির প্রশ্নটি তারা সামনে নিয়ে এসেছেন কেউ কেউ। পঞ্চমত, ক্রেতাদের ন্যায় অনেক বিক্রেতাও ভ্যাটের ‘উচ্চহার’ নিয়ে শঙ্কিত। তারা মনে করেন, পণ্যমূল্যের সঙ্গে এ কর যোগ করলে ক্রেতারা তা সহজভাবে নিতে চান না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্রেতারা প্রতিক্রিয়া দেখান। অন্যদিকে ভ্যাট হার বেশি হওয়ায় বিক্রেতাদের ফাঁকি দেয়ার প্রবণতাও বেশি। ক্রেতার কাছ থেকে সংগ্রহ করে সরকারি কোষাগারে জমা না দিলে বিক্রেতার মুনাফায় আরো স্ফীতি ঘটে। এতে তাদের ঝুঁকি থাকলেও লাভের পরিমাণই বেশি—এ ভাবনায় ভ্যাট ব্যবস্থার পরিপালনে উৎসাহ কম।
ভ্যাট কর্তৃপক্ষ: আলোচনা সভায় ভ্যাট কর্তৃপক্ষের কেউ উপস্থিত ছিলেন না। তবে অংশগ্রহণকারীদের মধ্য থেকে তিনজন উঠে দাঁড়ালেন। তারা ভ্যাট অফিসার হিসেবে ‘রোল প্লে’ করলেন। এতে সুবিধা হলো যে, ভ্যাট কর্মকর্তাদের সম্পর্কে পক্ষপাতহীন বা নিরপেক্ষ মতামত পাওয়া গেছে, যা শুদ্ধ চিন্তার জন্য খোরাক জোগাবে। এ তিনজনের বক্তব্যের সারাংশ তুলে ধরা হলো। প্রথমত, ভ্যাট কর্মকর্তারা সরকারের অব্যাহত উন্নয়ন চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির জন্য তত্পর থাকেন। সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সচেষ্ট হন। তবে আবার ব্যবসায়ীদের অনেকে ভ্যাট স্বেচ্ছায় দিতে চান না। ভ্যাট ব্যবস্থার আইনি পরিপালন করতে গিয়ে অনেক ব্যবসায়ী হয়রানির অভিযোগ করেন; অনেক ক্ষেত্রে হয়রানির অভিযোগ সত্যি হয় না। আইনি উপায়ে রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটনকে হয়রানির সঙ্গে মেলানো হয়। এ জাতীয় তত্পরতার কারণে ভ্যাটকে কেউ কেউ ভীতির কারণ হিসেবে বিবেচনা করতে চান। তবে এ অভিযোগকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া উচিত হবে না। ভ্যাট আইনে হয়রানির অভিযোগ থাকলে তা প্রতিকারের ব্যবস্থাও রয়েছে। এ প্রতিকারের প্রতি আরো নজর দেয়া প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, ভ্যাটের পরিধি ব্যাপক। বলতে গেলে, কতিপয় ক্ষেত্রে অব্যাহতি ব্যতিরেকে যেকোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করতে গেলে ভ্যাট ব্যবস্থায় নিবন্ধন নিতে হয় এবং নিয়মিত রিটার্ন দিতে হয়। নতুন ভ্যাট আইনে বর্তমানে দুই লক্ষাধিক প্রতিষ্ঠান ভ্যাটের আওতায় নিবন্ধিত হয়েছে। দেশের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যার তুলনায় এ হার আরো বাড়ার কথা। ভ্যাট কর্তৃপক্ষ নিয়মিত জরিপ করে অনিবন্ধিতদের ভ্যাটের আওতায় আনছে। এ তত্পরতায় হয়তো ভীতি সঞ্চার হয়েছে। তবে আইন মেনে চললে ভীতির কারণ নেই। তৃতীয়ত, বিভিন্ন স্টাডির ফলাফল অনুযায়ী, দেশের অর্থনীতির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ অনানুষ্ঠানিক খাত বা ‘কালো টাকা’ সংশ্লিষ্ট। এসব খাত কোনো স্বীকৃত চ্যানেলে লেনদেন না করায় এ-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা ভ্যাট নেটের আওতায় আসতে চান না। ভ্যাটের হিসাবে প্রকৃত বিক্রয় এবং জমা সরকারি হিসাবে একবার রেকর্ড হলে অন্যান্য দপ্তর (আয়কর, দুদক ইত্যাদি) থেকে তাদের আয়ের উৎস সম্পর্কে খোঁজ নেয়া হতে পারে; পড়তে হতে পারে নানা বিড়ম্বনার। ভ্যাটের হিসাবের সঙ্গে আয়করের হিসাবও যুক্ত হতে পারে। তাকে কেবল ভ্যাট-ই নয়, বছর শেষে ওই হিসাবের ওপর আয়করও দিতে হবে। কোনো কোনো ব্যবসায়ী ভ্যাট দপ্তরে প্রকৃত বিক্রয় তথ্য ঘোষণা দিয়ে বাড়তি এ চাপ নিতে চান না। এ গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর ভ্যাটের ভীতি থাকা স্বাভাবিক; তারা ভ্যাট ব্যবস্থার বিরোধী হবেন। চতুর্থত, কোনো কোনো ভ্যাট কর্মকর্তা মনে করেন, ভ্যাট ব্যবস্থায় ভীতির কারণ নেই। এটি ব্যবসায়ীদের ও করদাতাদের আইনে বর্ণিত দায়িত্ব ও কর্তব্য। নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে এবং রিটার্নের মাধ্যমে তা যথাযথ ঘোষণা দিলে তার এ দায় নিষ্পত্তি হয়ে যায়। যেসব প্রতিষ্ঠান ফাঁকির সঙ্গে জড়িত হয়, কেবল তাদের আশঙ্কা থাকে ভ্যাট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আইনে বর্ণিত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আরোপের সম্মুখীন হওয়ার। ভ্যাট আইনে ফাঁকি দেয়া রাজস্বের পাশাপাশি নির্ধারিত হারে সুদ ও ব্যক্তিগত জরিমানার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যা ব্যবসার জন্য ঝুঁকি বয়ে আনতে পারে। আইনের এ প্রয়োগ তাদের (যারা ফাঁকির সঙ্গে জড়িত) জন্য শঙ্কা তৈরি করে। পঞ্চমত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু কর্মকর্তার ‘অনৈতিক চাপ’-এর কারণে ভীতির সঞ্চার হতে পারে। অভিযোগ রয়েছে, ভ্যাট ব্যবস্থায় পরিপালন সত্ত্বেও ‘অযথা কারণ’ দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের খাতাপত্র ও কম্পিউটার জব্দ করা হয়; নানা অজুহাতে জরিমানা আরোপ করা হয়। তবে এ ধরনের অভিযোগ অনেকটা ঢালাও, সুনির্দিষ্টভাবে এটি প্রমাণ করতে পারলে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা রয়েছে।
সার্বিক পর্যালোচনা: সেমিনার কক্ষে উত্থাপিত এ তিন পক্ষের বক্তব্যকে সর্বতোভাবে উড়িয়ে দেয়া যায় কি? ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরে কাজ করতে গিয়ে অভিজ্ঞতা বলছে, ‘না’। উপরে বর্ণিত এ তিন ধরনের বক্তব্যের সমর্থনে মাঠপর্যায়ে অনেক তথ্য ও প্রমাণাদিও পাওয়া গেছে। ভ্যাট সম্পর্কে সাধারণ কিছু ভীতি রয়েছে, এটি অস্বীকারের উপায় নেই। এ ভীতিকে বৃহত্ভাবে পর্যালোচনা করলে চারটি প্রধান বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। প্রথমত, ভ্যাট ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও প্রচারের অভাব লক্ষণীয়। যেমন ক্রেতা হয়তো জানেনই না, তিনি যে পণ্য বা সেবা ক্রয় করছেন, তার মূল্যের ভেতরই ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তিনি ভ্যাট চালান নিন বা না নিন, আইন অনুসারে তিনি নির্দিষ্ট হারে ভ্যাট দিয়েছেন বলে ধরে নেয়া হয়। চালানটি তিনি বুঝে নিলে তা সরকারি কোষাগারে জমা হবে। তাকে বোঝাতে হবে যে, চালান বুঝে না নিলে তার দেয়া ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা হবে না; বরং তা ব্যবসায়ীর পকেটে চলে যাবে। অন্যদিকে ভ্যাট দিচ্ছেন ক্রেতা; ভ্যাট কোনোভাবেই তা বিক্রেতার মুনাফার অংশ নয়। তিনি কেবল জিম্মাদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ। ক্রেতার কাছ থেকে সংগৃহীত ভ্যাট সরকারের কোষাগারে জমা দেয়াই বিক্রেতার দায়িত্ব। এতে তার ব্যবসার কোনো ক্ষতি নেই। অন্যদিকে কোথাও কোনো হয়রানির অভিযোগ উত্থাপিত হলে আইনে বর্ণিত পন্থায় প্রতিকারের দ্বারস্থ হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ‘ভয় নয়, ভয়কে জয় করতে হবে’—এ বোধটা জাগ্রত করাটাই মূল চ্যালেঞ্জ। আর এজন্য প্রয়োজন সঠিক পদ্ধতিতে ব্যাপক প্রচার ও প্রচারণা চালানো। দ্বিতীয়ত, ভ্যাট ব্যবস্থা এখনো অনেকটা ম্যানুয়াল পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। এতে করে যে যার সুবিধামতো ঘোষণা দেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন; কেউ কেউ ভ্যাট ফাঁকির সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছেন। এনবিআর যথাযথ রাজস্ব হারাচ্ছে। তবে বর্তমানে এনবিআরের ভ্যাট অনলাইন অনেক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান। যেমন নিবন্ধন, অটো-চালান, রিটার্ন ও রিপোর্ট তৈরির ব্যবস্থা রয়েছে এতে। তবে অটোমেশনের আংশিক চিত্র এটি। পূর্ণাঙ্গভাবে এর বাস্তব রূপ দেয়ার বিকল্প নেই। প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে এখনো অটোমেশন পদ্ধতি প্রয়োগের ঘাটতি রয়েছে। ফলে ব্যবসায়ীর হিসাব ও ভ্যাট আহরণ পদ্ধতিতে পুরোপুরি স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। ফলে তিন পক্ষের কাছেই ভ্যাট ব্যবস্থা এখনো নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। যত অটোমেশনের ব্যাপ্তি ছড়িয়ে দেয়া যাবে, তত ভ্যাট সম্পর্কে অস্বচ্ছতা দূর হবে; সঙ্গে ভীতিও। তৃতীয়ত, এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, দেশে অনানুষ্ঠানিক ব্যবসার ব্যাপ্তি রয়েছে। কেউ কেউ চাইবে ভ্যাটের আওতায় ব্যবসার সঠিক হিসাব গোপন করতে; সঠিক হিসাবের ঘোষণা থেকে বিরত থাকতে। কারণ এতে কেবল ভ্যাটই দিতে হবে না, আয়কর প্রদানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টিসহ অন্যান্য জটিলতায় যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। তবে বৃহৎ স্বার্থে এনবিআর এ বিষয়ে কোনো বিকল্প চিন্তা করতে পারে। এতে অর্থনীতিতে আরো অক্সিজেন সঞ্চালিত হতে পারে। ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা আমলে নিয়ে কীভাবে তা দূর করা যায় তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। ভীতি যেখানে বিদ্যমান থাকবে, সেখানে মুক্তভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালিত করার পথে বাধা হয়ে থাকবে। তাই ভীতি দূর করতে কার্যকর বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজে বের করা অধিকতর যুক্তিযুক্ত। শাস্তিমূলক ব্যবস্থায় নয়, স্বেচ্ছায় আইন মানার সংস্কৃতি গড়ে তোলার ওপর জোর দিতে হবে। চতুর্থত, অনেক সময় ক্রেতা ও বিক্রেতাকে নিজেদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভ্যাট প্রদানে আগ্রহের অভাব দেখা যায়। উপরের আলোচনায় দেখা গেছে, তারা ভ্যাট দিয়ে বিনিময়ে রাষ্ট্র থেকে কী পাচ্ছেন—সেটি বলার ঘাটতি রয়েছে। কেন আমি ভ্যাট দেব? এমন প্রশ্নের জবাব পাওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকারের নানামুখী উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও এর সুফল, নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি, কর্মসংস্থান ইত্যাদির মতো বাস্তব উদাহরণ আরো বেশি করে উপস্থিত করা দরকার। সরকারে রাজস্ব ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিষয়গুলো আরো সামনে আনা প্রয়োজন। তাছাড়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে বা খাতওয়ারি বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা হতে পারে তাদের এ প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে। মোদ্দাকথা, ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়কে উদ্বুদ্ধ করতে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া আবশ্যক।
উপসংহার: উপরের আলোচনায় একটা গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হচ্ছে, যেকোনো ভীতি মূলত অজানা বা অজ্ঞতা থেকে সৃষ্ট; ভ্যাটের ভীতিও অনেকটা তাই। ভ্যাট সম্পর্কে যত আমরা জানব, ততই এর অন্ধকার দিক দূর হবে। এ সম্পর্কে জানাই হতে পারে এ-সংক্রান্ত ভীতি লাঘবের উত্তম উপায়। একজন সচেতন ক্রেতা বা ব্যবসায়ী ভ্যাট আইনে বর্ণিত তার দায়িত্ব পালন করে দেশের উন্নয়নে সরাসরি অংশ নিতে পারেন; পেতে পারেন রাষ্ট্রের সেবা (যেমন— বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানিসহ নানা ভৌত অবকাঠামো, নিরাপত্তা, পদ্মা সেতুসহ নানামুখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদির সুফল)। তবে এ সুবিধাদির ব্যাপক প্রচার ও প্রচারণার কোনো বিকল্প নেই। এনবিআর কর্তৃক এ বিষয়ে সুষ্ঠু ও বহুপক্ষীয় পরিকল্পনা করে নানামুখী উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি প্রণয়ন করলে আরো সুফল আসবে। অন্যদিকে, স্বচ্ছতাকে সামনে আনতে অটোমেশনের কার্যক্রম বেগবান করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) চালুর যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তা আরো ছড়িয়ে দিতে পারলে খুচরা পর্যায়ে ভ্যাট আহরণ ও পরিপালন বেড়ে যাবে। ফলে তিনপক্ষের মধ্যে কোন অযথা মোকদ্দমা ছাড়াই অধিকতর পরিপালন নিশ্চিত হতে পারে। এজন্য এনবিআর থেকে ক্রেতা ও বিক্রেতার সঙ্গে অনবরত ডায়ালগ ও আলোচনার দ্বার আরো উন্মুক্ত করার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। এটি আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক হতে পারে। যত বেশি এ ধরনের মিথস্ক্রিয়া হবে, তত বেশি ভ্যাট সম্পর্কে অস্পষ্টতা দূর হবে; ভ্যাট নিয়ে জনসচেতনতা বাড়বে। সার্বিকভাবে এনবিআরের পক্ষ থেকে প্রতি বছর ভ্যাট দিবস পালন এসব বিষয় সামনে রেখে আয়োজন করা হয়। আশা করি, এবারের নানা আয়োজনে ভ্যাট সম্পর্কে অযথা ভীতি দূর করতে সহায়ক হবে; এ-সংক্রান্ত যেকোনো যৌক্তিক বিষয়ে গ্রহণযোগ্য কলাকৌশল প্রণয়নের তাগিদ সৃষ্টি হবে এবং আগামীতে ভ্যাট আহরণে ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যাবে।
পরিশেষে, ‘ভ্যাট ভীতি’ নিয়ে ওয়ার্কশপের আয়োজককে বিশেষ ধন্যবাদ জানাতে চাই; অনুষ্ঠানে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ পাওয়ার কারণেই এ ধরনের একটি সংবেদনশীল বিষয়ে লেখা সম্ভব হয়েছে। [লেখাটি ভ্যাট দিবস ২০২১ উপলক্ষে এনবিআরের বিশেষ স্মরণিকায় প্রকাশিত হয়েছে]
লেখক : মহাপরিচালক, ভ্যাট গোয়েন্দা, তদন্ত ও অডিট অধিদপ্তর, এনবিআর; শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক।
খুলনা গেজেট/এনএম