পদ্মা সেতু চালুর পর সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি বাড়লেও বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে কাঙ্খিত রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। গত অর্থবছরে ভোমরা বন্দরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি পড়েছে। তবে ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয় বেড়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।
আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী নেতাদের অভিযোগ, ভোমরা বন্দরে সবধরনের পণ্য আমদানিতে নানা ধরনের বিধিনিষেধ, ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোর ঋণপত্র না খোলাসহ নানা কারণে আমদানি কমেছে। এতে সরকারের কাঙ্খিত রাজস্ব অর্জিত হচ্ছে না।
বন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাপরবর্তী সময়ে দেশি পণ্যের চাহিদা বাড়ায় ভোমরা বন্দর দিয়ে ভারতে রপ্তানি বেড়েছে। এ বন্দর দিয়ে পাটের সুতা, তাঁতের শাড়ি, মশার নেট, গার্মেন্টস বর্জ্য, মধু, রাইস ব্রান অয়েল, মাছ ও প্রাণের ফুডস সামগ্রী রপ্তানি হয়। সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় পাথর ও পেঁয়াজ। আগে কিছু ফল এলেও বর্তমানে সেটা একেবারে বন্ধ। তবে কাঁচা ও শুকনা মরিচ, আদা, চালসহ মসলা জাতীয় পণ্য এই বন্দর দিয়ে নিয়মিত আমদানি হচ্ছে।
ভোমরা শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব শাখার তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভোমরা স্থলবন্দরে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ১ হাজার ২৬ কোটি ২২ লাখ টাকা। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৬৩১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব ঘাটতি রয়েছে ৩৯৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের ঘাটতির তুলনায় ১৮২ কোটি টাকা বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি ছিল ২১২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে মার্চ মাসে। ওই মাসে ৭৪ কোটি ১৬ লাখ টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। এছাড়া জুলাইয়ে ৪৪ কোটি ৭৪ লাখ, আগস্টে ৫৫ কোটি ৩ লাখ, সেপ্টেম্বরে ৫৪ কোটি ৬০ লাখ, অক্টোবরে ৪০ কোটি ৯৫ লাখ, নভেম্বরে ৪২ কোটি ৭ লাখ, ডিসেম্বরে ৩৯ কোটি ৯১ লাখ, জানুয়ারিতে ৪৫ কোটি ৭৭ লাখ, ফেব্রুয়ারিতে ৫৭ কোটি ৪৭ লাখ, এপ্রিল মাসে ৫৬ কোটি ৬ লাখ, মে মাসে ৬৫ কোটি ৪৯ লাখ ও জুন মাসে ৫৫ কোটি ৪৩ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়।
অন্যদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছর ভোমরা বন্দর দিয়ে ২ লাখ ৬৭ হাজার ১৮৩ টন বিভিন্ন ধরনের দেশি পণ্য রপ্তানি হয়। যার মূল্য ৩ হাজার ২১ কোটি ৪ লাখ ১৫ হাজার ১৫২ টাকা। যা তার আগের অর্থবছরের তুলনায় ২৮২ কোটি ৫৩ লাখ ৮৮ হাজার ৪৫১ টাকা বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ বন্দরে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি হয় ২ লাখ ৬২ হাজার ৩১৯ টন। যার মূল্য ছিল ২ হাজার ৭৩৮ কোটি ৫০ লাখ ২৬ হাজার ৭০১ টাকা।
ভোমরা স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম খান বলেন, পণ্য আমদানিতে ছাড় না দেওয়াসহ নানা বৈষম্যের কারণে অন্য বন্দরের তুলনায় ভোমরা বন্দরে প্রতিবছরই সরকারের রাজস্ব ঘাটতি যাচ্ছে। তবে ভোমরাকে পূর্ণাঙ্গ বন্দরের সুবিধা দেওয়া হলে সরকারের রাজস্ব অনেকাংশে বাড়বে।
তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে বেশি সম্ভাবনাময় ভোমরা বন্দর। কারণ ভারতের কলকাতা থেকে ভোমরার দূরত্ব দেশের অন্য সব বন্দরের তুলনায় অনেক কম। বর্তমানে পদ্মা সেতু ও এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে মাত্র ৫-৬ ঘণ্টার মধ্যে এবন্দরের পণ্য ঢাকায় পৌঁছে যাচ্ছে। তারপরও ছাড় না থাকায় ব্যবসায়ীরা এ বন্দর থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছে। বেনাপোল, সোনামসজিদ, হিলিসহ দেশের অন্যান্য বন্দরে পণ্য আমদানিতে যেসব সুযোগ-সুবিধা ব্যবসায়ীদের দেওয়া হয় তার কিছুই পান না ভোমরা বন্দরের ব্যবসায়ীরা।
ভোমরা বন্দর আমদানি রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি আবু হাসান বলেন, পূর্ণাঙ্গ বন্দরে রূপান্তর করার পরও ভোমরা বন্দর দিয়ে সব ধরনের পণ্য ভারত থেকে আমদানি করতে দেওয়া হয় না। অথচ দেশের অন্য বন্দরগুলোতে কিছুটা ছাড়ের ব্যবস্থা আছে। এজন্য সেসব বন্দরকে বেছে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে ভোমরা বন্দরে সরকারের রাজস্ব আয়ও ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। ভোমরা বন্দর দিয়ে ব্যবসায়ীরা সবধরনের পণ্য আমদানি করতে পারলে রাজস্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি বন্দেরর ব্যবসা-বাণিজ্যে আরও প্রসার ঘটবে বলে তিনি মনে করেন।
ভোমরা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজি নওশাদ দিলওয়ার রাজু বলেন, রপ্তানির পাশাপাশি আমদানিতেও ব্যাপক সম্ভাবনাময় ভোমরা স্থলবন্দর। বর্তমানে এ বন্দরে ৭৪টি পণ্য আমদানির অনুমোদন রয়েছে। অন্য বন্দরের মতো ভোমরা বন্দরের কাস্টমস কর্তৃপক্ষ পণ্য আমদানিতে ব্যবসায়ীদের কিছুটা ছাড় দিলে আমদানি-রপ্তানি আরও বাড়বে।
ভোমরা শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা ইফতেখার হোসেন বলেন, করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলার সংকট ও ব্যাংকে এলসি জটিলতার কারণে গতবছর আমদানি-রপ্তানি কম হয়েছে। তবে চলতি অর্থবছরে আমদানি-রপ্তানি বাড়বে বলে আশা করেন তিনি।
ভোমরা শুল্ক স্টেশনের ডেপুটি সহকারী কমিশনার নেয়ামুল হাসান বলেন, পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে কাস্টমসের পক্ষ থেকে স্বচ্ছতা বজায় রেখে ব্যবসায়ীদের সর্বাত্মক সেবা দেওয়া হয়। তবে এখানে কাউকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কোন সুযোগ নেই।
রাজস্ব ঘাটতির বিষয়ে তিনি বলেন, বৈশ্বিক মন্দার কারণে সব বন্দরে রাজস্ব আয় কমেছে। এছাড়া অনেক ব্যবসায়ী ডলার সংকটের কারণে সময়মতো এলসি খুলতে পারেননি। এজন্য ভোমরা বন্দরে বিদায়ী অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে। আশা করছি চলতি অর্থবছরে এ বন্দরে আমদানি-রপ্তানি বাড়বে।
খুলনা গেজেট/এনএম