জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাস তিনেক আগে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) জন্য ২৬১টি নতুন গাড়ি কেনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রতিটি গাড়ির দাম পড়বে প্রায় দেড় কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ব্যয় হবে ৩৮১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
নির্বাচনের সময় সাধারণত ডিসিরা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ইউএনওরা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সংশ্লিষ্ট আসনে নির্বাচনের সব দায়িত্ব ও ক্ষমতা মূলত তাঁদের হাতে থাকে। এই কর্মকর্তাদের জন্য কেনা হচ্ছে স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকেল (এসইউভি), যা জিপ নামে পরিচিত।
ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে বুধবার গাড়িগুলো সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) কেনার নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। অর্থাৎ দরপত্র ছাড়া গাড়িগুলো কেনা হবে। বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সভাপতিত্ব করেন। এমন সময়ে গাড়িগুলো কেনার সিদ্ধান্ত হলো যখন সরকার টাকার সংকটে রয়েছে। মার্কিন ডলারের সংকট চলছে। সরকার বিদ্যুৎ ও সারে ভর্তুকির টাকা যথাসময়ে ছাড় করতে পারছে না। ডলার–সংকটে বিদেশ থেকে আসা বিদ্যুতের দাম বকেয়া থাকছে। বিদেশি কোম্পানির গ্যাসের দামও যথাসময়ে দিতে পারছে না সরকার।
অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাধারণত সাংবাদিকদের অবহিত (ব্রিফ) করা হয়। গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা গাজী তৌহিদুল ইসলাম ‘অনিবার্য কারণবশত’ অবহিত করা হবে না বলে আগেই জানিয়ে দেন। তিনি বলেন, যে কর্মকর্তা অবহিত করেন, তাঁর অন্য কাজ থাকায় সেটা করা হয়নি। তবে সূত্র বলছে, গাড়ি কেনা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে বলে অবহিত করার অনুষ্ঠান বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়।
সাধারণত সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সাঈদ মাহবুব খান। তিনি বৈঠকটিতে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গাড়ি কেনার প্রস্তাব নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে।’ এর বাইরে কিছু বলতে চাননি তিনি।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, গাড়িগুলো আগেই কেনার দরকার ছিল। আর নির্বাচনের সময় আসলেই গাড়ির দরকার এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যই তা দরকার। সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে এগুলো কেনা হবে।
কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য নতুন গাড়ি না কেনার নির্দেশনা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের যে অর্থ বিভাগ, তারাই এখন নতুন গাড়ি কেনার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এর ব্যাখ্যা জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘গাড়ি কেনার দরকার না থাকলে অর্থ বিভাগ মত দিত না। সংকট আছে এটা যেমন সত্য, গাড়ি কেনার দরকার, এটাও সত্য।’
আগামী নির্বাচনের আগে গত মাসে সরকার উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব পদে ২২১ জনকে পদোন্নতি দিয়েছে। সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়া চলছে, যা নির্বাচনের আগেই হবে বলে জানা গেছে। প্রশাসনে পদ না থাকলেও এসব পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে, যা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অন্যদিকে সরকার বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় পছন্দের কর্মকর্তাদের ডিসি ও ইউএনও হিসেবে নিয়োগ দিয়ে প্রশাসন সাজিয়েছে বলে অভিযোগ করছে মাঠের বিরোধী দলগুলো।
যোগাযোগ করা হলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচনের আগে বলা কথা নয়, গাড়ি কেনার দরকার হলে সরকার কিনবে। কিন্তু এখন যেহেতু সংকটের সময় চলছে, যেকোনো কিছু কেনাকাটার ক্ষেত্রেই সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন নীতি অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়।’
নির্বাচনের আগে গাড়ি আসবে কি
মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, এসব গাড়ি কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয় গত ১২ জুন। সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর প্রথমে চাহিদার কথা জানায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে। পরের মাস জুলাইয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চিঠি পাঠায় অর্থ বিভাগে।
তৎকালীন অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিন ইতিবাচক মত দেওয়ার পর বিষয়টি এগোয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এরপর তা অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির নীতিগত অনুমোদনের জন্য পাঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। পরের ধাপে গাড়ি কেনার প্রস্তাব যাবে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির কাছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে আর তিন মাসের মতো বাকি। এ সময়ে বাকি প্রক্রিয়া শেষ করে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজকে ক্রয়াদেশ দিতে হবে। এরপর প্রগতি গাড়ি দেবে।
এ সময়ের মধ্যে গাড়ি সরবরাহ করা সম্ভব কি না জানতে চাইলে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ইনচার্জ) আবদুল হালিম বলেন, তা সম্ভব। তবে সময় যেহেতু কম, সরকারের উচিত হবে দ্রুততম সময়ে ক্রয় আদেশ দেওয়া।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘২৬১টি গাড়ি কিনতে সামষ্টিক অর্থনীতিতে চাপ ফেলার মতো অত বেশি টাকা লাগবে না। তারপরও বলব, এই ৩৮২ কোটি টাকাও তো টাকা। বিন্দু বিন্দু করেই তো সিন্ধু হয়।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের আগে দেখার দরকার নতুন গাড়ি কেনার যৌক্তিকতাটা কী এবং এর মাধ্যমে কী বার্তা যাচ্ছে? এ প্রশ্ন তোলা অসংগত হবে না যে ডলার–সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, কম রাজস্ব সংগ্রহের এ পরিস্থিতিতে নতুন গাড়ি কেনা অপরিহার্য ছিল কি না। গাড়ি বেশি দরকার হলে আপাতত ভাড়া নেওয়া যেত। আর্থিক অবস্থার উন্নতি হলে পরে কেনার চিন্তা করা যেত।’
খুলনা গেজেট/এইচ