খুলনা, বাংলাদেশ | ২৬ আশ্বিন, ১৪৩১ | ১১ অক্টোবর, ২০২৪

Breaking News

  টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ২
  হিযবুত তাহরীরকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করল ভারত

ভেনামির পাইলট প্রকল্প স্বপ্ন দেখাচ্ছে চিংড়ি চাষিদের

শেখ নাদীর শাহ্, পাইকগাছা

নানা সংকটের মুখে থাকা সম্ভাবনাময় চিংড়ি শিল্পকে আন্তর্জাতিক বাজারে টিকিয়ে রাখতে বাগদার বিকল্প হিসেবে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক শুরু হয়েছে ভেনামি চিংড়ির পাইলট প্রকল্প। প্রকল্পে ২য় বারের মত পাইকগাছার লোনা পানি গবেষণা কেন্দ্রের চারটি পুকুরে পোনা অবমুক্তির মাধ্যমে শুরু হয় ভেনামির পাইলট প্রকল্পের কার্যক্রম। ইতোমধ্যে প্রকল্পের দুটি পুকুরের নমুনয়ন ও পরিদর্শনে ফুটে উঠেছে এর ধারাবাহিক সফলতার চিত্র। এমনটাই জানিয়েছেন, জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

বহুবিধ সংকট ও প্রতিবন্ধকতায় আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। কারণ অনুসন্ধানে দেখাগেছে বিশ্ব বাজারে বর্তমানে প্রায় ৭২ শতাংশ ভেনামী চিংড়ির দখলে। বাকী ২৮ শতাংশ নিয়ে আমাদের প্রতিযোগিতা করতে হয়। সেজন্য বিশ্ব বাজারের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ভেনামী চিংড়ি চাষের বিকল্প নেই। এমন পরিস্থিতিতে রপ্তানিকারকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের মৎস্য অধিদপ্তর সম্প্রতি থাইল্যান্ড থেকে ভেনামি প্রজাতির চিংড়ির পোনা আমদানি করে খুলনাঞ্চলের আটটি প্রতিষ্ঠানকে পরীক্ষামূলক চাষের অনুমতি দেয়।

অনুমতি পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে, এমইউসি ফুডস, ফাহিম সি ফুডস, গ্রোটেক অ্যাকোয়াকালচার লিমিটেড, রেডিয়েন্ট শ্রিম্প কালচার, আইয়ান শ্রিম্প কালচার, ইএফজি অ্যাকোয়া ফার্মিং, জেবিএস ফুড প্রডাক্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও প্রান্তি অ্যাকোয়া কালচার লিমিটেড।

এছাড়া অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছে সাতক্ষীরার দেবহাটার আলহেরা মৎস্য প্রকল্প, খুলনার রূপসার ফ্রেস ফুডস লিমিটেড, জেমিনি সি ফুডস লিমিটেড এবং সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের নলতা আহসানিয়া ফিস লিমিটেড। তাদের অবকাঠামো সংস্কার হলে দ্রুত এই চারটি কোম্পানিকেও ভেনামি চিংড়ি চাষের অনুমতি দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে। এছাড়াও কক্সবাজারের আরো চারটি প্রতিষ্ঠানকে ভেনামি চিংড়ি চাষের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তারাও খুব শীঘ্রই ভেনামির আবাদ শুরু করবে বলে বিএফএফইএ সূত্র জানিয়েছে।

এর আগে ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন গত ১২ বছর ধরে সরকারের সাথে আলোচনার পর গত ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উচ্চ ফলনশীল ভেনামি জাতের চিংড়ির পরীক্ষামূলক চাষের অনুমতি দেয়া হয় কক্সবাজারের অ্যাগ্রি বিজনেস এবং সাতক্ষীরার এনজিও সুশীলনকে। ইতোমধ্যে কক্সবাজারের অ্যাগ্রি বিজনেস ব্যর্থ হলেও সুশীলন প্রকল্প বাস্তবায়নে সাথে নেয় যশোর বিসিক শিল্পনগরীর এম ইউ সি ফুডসকে। ওই বছরের ৩১ মার্চ থাইল্যান্ড থেকে তারা বিমানযোগে ভেনামি চিংড়ির আট লাখ রেনু আমদানি করে খুলনার পাইকগাছা উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য অধিদফতর ও মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীনস্থ লোনা পানি কেন্দ্রের চারটি পুকুরে অবমুক্ত করে এর পাইলট প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করে। শুরুটা আলোর মুখ দেখায় ২০-২১ অর্থ বছরের ১০ মে রাতে একই পদ্ধতিতে তারা আরো ১২ লাখ পোনা আমদানি করে পরীক্ষামূলক প্রকল্প অব্যাহত রাখে।

পরে পুকুরে পোনা অবমুক্তির পর থেকে নিয়মিত পরিচর্যা ও পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন চিংড়ি বিশেষজ্ঞ ফিস ইন্সপেকশন ও কোয়ালিটি কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত উপপরিচালক প্রফুল্ল সরকার।

চিংড়ির নিয়মিত গ্রোথ এবং রোগবালাই অনুসন্ধানে নমুনা পরীক্ষায় মনে করা হচ্ছে, ভেনামির রোগ প্রতিরোধ এবং জীবন ধারণ ক্ষমতা বাগদার তুলনায় বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, পোনা ছাড়ার পর থেকে সাত সপ্তাহ পর্যন্ত চিংড়িতে রোগবালাই সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এ বিপজ্জনক সময় অতিক্রমের পুকুরের পরিবেশ, ভাইরাসসহ অন্যান্য রোগবালাই প্রতিরোধব্যবস্থা পরিদর্শন এবং চিংড়ির ফিজিক্যাল গ্রোথ পরিমাপে নমুনা পরীক্ষা করেন একটি বিষেশজ্ঞ টিম।

তাদের মতে, ভেনামির পোনা ছাড়ার পরের ৬৮ দিনে গ্রোথ ও ফার্টিলিটি রেট খুবই আশাব্যঞ্জক। প্রতিটির ওজন ৮ গ্রাম থেকে সর্বোচ্চ ২৫ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। গড় ওজন পাওয়া গেছে ৮.৭৫ গ্রাম। ভেনামি চিংড়ির উৎপাদনকাল ১২০ দিন। প্রথম ৬০ দিনে এদের যে গ্রোথ হয়, পরবর্তী ৬০ দিনে তার তিন গুণেরও বেশি হয়। সে হিসেবে আশা করা যায় চিংড়ি ধরবার সময় প্রতিটির গড় ওজন পাওয়া যাবে ২৫ গ্রাম।

ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, কাঁচামাল হিসেবে চিংড়ির অভাবে মাছ কোম্পানিগুলো বন্ধের উপক্রম হয়েছে। দেশে উৎপাদিত চিংড়িতে যে কয়টি কোম্পানি চালু আছে সেগুলোর সক্ষমতা ও ধারণ ক্ষমতার মাত্র ১৮-২০ শতাংশ চাহিদা মিটছে। ফলে প্রক্রিয়াজাতকরণ খরচও বেশি হচ্ছে। তবে ভেনামী চাষে আশার কথা হলো, প্রতি হেক্টরে যেখানে বাগদার উৎপাদন পাওয়া যায়, ৩৫০ থেকে ৪০০ কেজি। সেখানে ভেনামির উৎপাদন সাত থেকে আট হাজার কেজি পর্যন্ত সম্ভব। বাগদা কয়েকবার চাষ হলেও গলদার চাষ হয় বছরে একবার। কিন্তু ভেনামি চাষ করা যায় বছরে তিনবার। ভেনামি চিংড়ি চাষ ব্যাপকভাবে করতে হলে দেশেই ভেনামির এসপিএফ পোনা উৎপাদনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলেও জানায় সূত্রগুলি।

চিংড়ি শিল্প সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, নানা সংকটে ক্রমশ উৎপাদন হ্রাস পাওয়া দেশীয় বাগদা ও গলদা চিংড়ি আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রতিযোগীতার মুখে সুবিধা করতে পারছে। পক্ষান্তরে আন্তর্জাতিক বাজার চলে যাচ্ছে ভেনামি চাষকারী চীন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের দখলে। অবস্থার উত্তরণে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশকে বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে নামি চাষের বিকল্প নেই বলেও হুশিয়ার করেন তারা।

সর্বশেষ রবিবার (২২ মে) দুপুরে পাইকগাছার লোনা পানি গবেষণা কেন্দ্রে পরীক্ষামূলক পাইলট প্রকল্পের ২টি পুকুরে নমুনয়ন ও পরিদর্শন করেন খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল, বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে মৎস্য চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্প (২য় পর্যায়) ডিপিডি এটিএম তৌফিক মাহমুদ, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা পবিত্র কুমার দাস, মৎস্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, কর্মচারীগণ এবং এম ইউ সি ফুড লিমিটেডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ। এসময় তারা পোনা অবমুক্তির ১২তম দিনে প্রগেসের হার সন্তোষজনক বলেও জানান।

এমন পরিস্থিতিতে প্রান্তিক পর্যায়ে ভেনামীর বানিজ্যিক উৎপাদন চিংড়ি শিল্পে ফিরে আসবে তার হারানো যৌবন। এমনটাই প্রত্যাশা চিংড়ি শিল্প সংশ্লিষ্টদের।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!