আগামী দুই বছরের জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। ২০২৬ সালের মধ্যেই বর্তমান সরকারের নেওয়া পরিকল্পিত সব প্রকল্পের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে চায় ভূমি মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার ভূমি ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন দেখতে চায়। যে ব্যবস্থাপনায় জমির মালিকভিত্তিক খতিয়ান হবে, হবে না খতিয়ানের দাগ শেয়ার। সরকারের এই লক্ষ্য অর্জন করলে ভূমি নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা ও সীমানা বিরোধ কমে যাবে।
ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৬ সালের মধ্যে সরকার ভূমি ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে যেসব পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে- টেকসই ও স্মার্ট ভূমি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। এখানে খতিয়ানের দাগ শেয়ার হবে না এবং মালিকভিত্তিক খতিয়ান হবে। এটা হলে ভূমি নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা ও সীমানা বিরোধ কমে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এনআইডি দিয়েই যেন পাওয়া যায় জমির সকল তথ্য। এই ব্যবস্থা স্থাপনেও সরকারের উদ্যোগ রয়েছে। সারা দেশে বাংলাদেশ ডিজিটাল জরিপ (বিডিএস) বাস্তবায়ন করা। যেসব জায়গায় একবার এই ডিজিটাল জরিপ সম্পন্ন হবে, সেখানে ভবিষ্যতে আর কোনও জরিপ করার প্রয়োজন পড়বে না।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হলো ‘সিভিল স্যুট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দেওয়ানি মামলা ও ভূমি রাজস্ব মামলাগুলো দ্রুত, স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সেবা নিশ্চিত করাই এর মূল লক্ষ্য। বেশ কিছু পুরোনো আইনের সংস্কারপূর্বক যুগোপযোগীকরণসহ কয়েকটি নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যে হলো- ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩ এবং ভূমির মালিকানা ও ব্যবহার আইন, ২০২৩।
গত মাসে জাতীয় ভূমি সম্মেলনের আয়োজন করে ভূমি মন্ত্রণালয়। তিন দিনের জাতীয় সম্মেলন ২৯ মার্চ শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ৩১ মার্চ। সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা তুলে ধরা এবং ভূমিসেবা ডিজিটালাইজেশনের ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জগুলো খুঁজে বের করে তা মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণ করা। এছাড়াও সম্মেলনের অন্যান্য লক্ষ্যের মধ্যে ছিল— ভূমি মন্ত্রণালয়ের নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে নাগরিক, সরকারি সংস্থা, অংশীজনদের অবহিত করানো, তাদের মধ্যে ভূমি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং ভূমি সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন ও বিধিবিধান সম্পর্কে ধারণা দেওয়া।
এখন পৃথিবীর যে কোনও প্রান্ত থেকে যে কোনও নাগরিক ভূমি অফিসে না এসেই নামজারি, ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) এবং খতিয়ান সেবা গ্রহণ করতে পারছেন। এজন্য একটি কল সেন্টার চালু করা হয়েছে। ‘১৬১২২’ নম্বরটিতে সপ্তাহে সাতদিন ২৪ ঘণ্টাই খোলা রয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই কল সেন্টার থেকে প্রায় ১০ লাখ ২০ হাজার কল নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এছাড়াও বিদেশ থেকে নিষ্পত্তিকৃত কলের সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার। এই সময়ে প্রায় ১১ হাজার ৪০০ ফলো-আপ কল (কল ব্যাক) করা হয়েছে। নাগরিকদের ২০ হাজার ৮০০টি ভূমি সংক্রান্ত আইনি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
সমগ্র বাংলাদেশের ১ লাখ ৩৮ হাজারটি ম্যাপকে ডিজিটাইজ করাসহ স্যাটেলাইট ইমেজ ক্রয় করা হচ্ছে। এই ম্যাপের উপরে স্যাটেলাইট ইমেজ বসিয়ে প্লটভিত্তিক জমির শ্রেণির একটি তথ্যভাণ্ডার তৈরি হচ্ছে। ২০২৩ সালের মার্চ নাগাদ ২০ হাজার ডিজিটাল মৌজা ম্যাপ ই-নামজারি সিস্টেমের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে। নামজারির সঙ্গে সঙ্গে এই ডিজিটাল ম্যাপ ও খতিয়ান স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশোধিত হতে থাকবে। একই খতিয়ানের মধ্যে মাল্টিপল দাগ শেয়ার করা তথা হাতের লেখা খতিয়ান প্রথার অ্যানালগ পদ্ধতির উত্তরণ ঘটিয়ে ড্রোন দিয়ে ডিজিটাল জরিপের কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। এসব পরিকল্পনার পুরোপুরি বাস্তবায়ন হবে ২০২৬ সাল নাগাদ।
স্মার্ট ভূমিসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার কাজ আরও বেগবান করতে নেওয়া হচ্ছে আরও কিছু পরিকল্পনা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, সায়রাত মহালের মাধ্যমে আয় বাড়ানো। এই সময়ে সায়রাত মহালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয় হয়েছে হাট-বাজার থেকে ৭৪৪ কোটি টাকা, বালুমহাল থেকে ২৭৩ কোটি টাকা এবং জলমহাল থেকে ১৭৩ কোটি টাকা। অনলাইন ব্যবস্থার কারণে ১ হাজার ৬৯৯ টি জলমহাল কম ইজারা দিয়েও সরকারের রাজস্ব আয় বেড়েছে ৯১ কোটি টাকা। ২০২২ এর জুন মাস পর্যন্ত হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট কৃষি খাস জমি ১৭ লাখ ৩৫ হাজার ৯১৫ একর, এর মধ্যে বন্দোবস্তযোগ্য ৪ লাখ ৬০ হাজার ১৬৪ একর। মোট অকৃষি খাস জমি ২২ লাখ ৫০ হাজার ১৭০ একর, যার মধ্যে বন্দোবস্তযোগ্য জমির পরিমাণ ১ লাখ ১৫ হাজার ৭৬৩ একর।
ভূমি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সরকার প্রধানের গৃহহীনদের গৃহপ্রদান কর্মসূচির আওতায় ১৯৯৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫ লাখ ৭ হাজার ২৪৪টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে খাস জমিতে পুনর্বাসন করা হয়েছে। মুজিববর্ষে সারা দেশে উদ্ধারকৃত ৫ হাজার ৫১২ একর খাস জমিতে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য একক গৃহ নির্মাণ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত খাস জমির আনুমানিক মূল্য ২ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। গত এক দশকে ৩ লাখ ৪৬ হাজার ২৮ টি পরিবারের মাঝে ৯০ হাজার ৯৯২ একর খাসজমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে।
ভূমি ব্যবস্থাপনার পারিভাষা আধুনিকীকরণ করে বাংলায় করা যায় কিনা তাও পর্যালোচনা করার সময় এসেছে বলে মনে করছেন ভূমি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা। মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এটিও করা হবে। এছাড়াও ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতায় তিনটি জরিপ বিষয়ক প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর মধ্যে মৌজা ও প্লটভিত্তিক ডিজিটাল ভূমি জোনিং প্রকল্প সরাসরি ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে- কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমির দক্ষ ব্যবহার।
ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের আওতায় এস্টাবলিশমেন্ট অব ডিজিটাল ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন, ধামরাই ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলা এবং মানিকগঞ্জ পৌরসভায় ডিজিটাল ল্যান্ড সার্ভে করা হবে। এ প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে ম্যাপ ও রেকর্ড এর ইন্টিগ্রেশন হবে। এ প্রকল্পে ডিজিটাল ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সফটওয়ার প্রস্তুত করা হবে। সকল ডাটা ক্লাউড বেইজ সার্ভারে সংরক্ষণ করা হবে। ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের ডিজিটাল জরিপ পরিচালনার সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের আওতায় পটুয়াখালী, বরগুনা, সিরাজগঞ্জ, পাবনা জেলা এবং গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া ও কোটালিপাড়াসহ ৩২টি উপজেলায় ডিজিটাল জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্লট টু প্লট জরিপ সম্পন্ন হলে সরকারি ও বেসরকারি মালিকানার তথ্যাটি সহজেই জানা যাবে। এর মাধ্যমে ভূমি ব্যবস্থাপনার আমূল পরিবর্তন হবে। আদালতের মামলা কমবে। সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি হবে। জমির মালিকানার তথ্য পৃথিবীর যেকোনও প্রান্ত থেকে জানা যাবে এবং জনগণ প্রয়োজনীয় সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বৃহৎ ভূ-স্থানিক উপাত্ত প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ভূমি শ্রেণি বিভাগ, দুর্যোগ সাড়া, নগরায়ণ ও যোগাযোগ এর সকল উপাত্ত একই প্লাটফরমে সংরক্ষিত থাকবে। বাংলাদেশ ডিজিটাল জরিপ শেষ হলে আর মাঠে গিয়ে নিয়মিত ক্যাডাস্ট্রাল জরিপ করার কোনও প্রয়োজন হবে না। আর এসবই হবে আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে। এমন সব পরিকল্পনাগুলেঅ বাস্তবায়নের দিকে এগুচ্ছে সরকার।
এ প্রসঙ্গে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জানিয়েছেন, আমাদের উদ্দেশ্য টেকসই ও স্মার্ট ভূমি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। আমরা চাচ্ছি ২০২৬ সালের মধ্যে বর্তমানে গৃহীত ও পরিকল্পিত সব প্রকল্পের পূর্ণ বাস্তবায়ন। ২০২৬ সালে আমরা এমন একটি ব্যবস্থা দেখতে চাই যেখানে খতিয়ানের দাগ শেয়ার হবেনা এবং মালিকভিত্তিক খতিয়ান হবে। এটা হলে ভূমি নিয়ে মামলা-মোকাদ্দমা ও সীমানা বিরোধ কমে যাবে। এনআইডি দিয়েই যেন পাওয়া যায় জমির সকল তথ্য- এই ব্যবস্থা স্থাপনেও আমাদের পরিকল্পনায় আছে। সর্বোপরি দ্রুত সারাদেশে বাংলাদেশ ডিজিটাল জরিপ (বিডিএস) বাস্তবায়ন করা। যেসব জায়গায় একবার এই ডিজিটাল জরিপ সম্পন্ন হবে, সেখানে ভবিষ্যতে আর জরিপ করার প্রয়োজন পড়বে না।
খুলনা গেজেট/কেডি