পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সালার থানার(সাবেক ভরতপুর থানা) বাবলা গ্রামের আবুল বরকত ওপারের অর্থ্যাৎ তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের ভাষা-শহীদ। এই ভাষা-শহীদের মর্যাদা আন্তর্জাতিক স্বীকৃত।
বরকত-রফিক-সালাম-জব্বার-শফিক এই নাম আজ গোটা বিশ্বে ধ্বনিত।১৯৯৮ সালে ২১ ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে রাষ্ট্রসংঘের স্বীকৃতি পাওয়ার পর এই ৫টি নাম খুব বেশি প্রচারিত ও প্রচলিত। কিন্তু ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে আরো বেশী মানুষ শহীদ হয়েছিলেন যাদের নাম কালের গর্ভতলে বিলীন হয়ে গেছে। যাইহোক অন্যতম ভাষাশহীদ আবুল বরকতকে মুর্শিদাবাদের সালার থানার বাবলা গ্রামের ভূমিপুত্র বলা হয় যা বহুল প্রচারিত। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে রাখতে হবে তার আদি পিতৃনিবাস ঐ সালার থানারই গুলহাটিয়া গ্রাম। বরকতের দাদু মনসুর আহমেদ গুলহাটিয়ার ভূমিপুত্র। তিনিই প্রথম বাবলা গ্রামে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন। থেকে যান শ্বশুরালয় বাবলা গ্রামে। তার দুই ছেলে । শামসুজ্জোহা ওরফে ভোলাই মিঞা। অন্যজন আল্লা হাফেজ ওরফে হাফু মিঞা। এই হাফু মিঞা আবার গুলহাটিয়াতে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়ে আপন পৈতৃক নিবাস গুলহাটিয়ায় ফিরে বসবাস করেন। তার ছেলে দীর্ঘদেহী ময়না মিঞা ও মানিক মিঞা। তাদের সন্তানরা আজো গুলহাটিয়া গ্রামেই বসবাস করেন।
২০০৩ সালে বাংলাদেশ থেকে একজন তথ্যচিত্র পরিচালক কলকাতা এলে আমি তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম গুলহাটিয়া গ্রাম। পরে বাবলা, পূর্ব গ্রাম, তালিবপুর ও সালার ঘুরিয়েছিলাম। বরকতের পৈতৃক নিবাস গুলহাটিয়া যেন বিস্মৃত।যেহেতু তার পিতা শামসুজ্জোহা ওরফে ভোলাই মিঞাতো বাবলা গ্রামেই থেকে যান। তার পড়াশোনা বাবলা ও তালিবপুর কেন্দ্রিক। তার জীবনেও প্রেম-ভালোবাসা গড়ে উঠেছিল। সেই চ্যাপটার আজ যেন ক্লোজ চ্যাপটার হয়ে গেছে। কিন্তু ইতিহাসকে কি ঢেকে রাখা যায়? বরকতের উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রভূমি হিসাবে সবসময় বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেখানো হয়। কিন্তু তিনি যে ১৯৪৪-৪৫ সালে তালিবপুর হাইস্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করে ভর্তি হন হাওড়ার নরসিংহ দত্ত কলেজে, সে কথা বলা আয় না। কিন্তু সে সময় দাঙ্গা-দাঙ্গা পরিস্হিতি ছিল। বিষয়টির সত্যতা যেমন বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক আব্দুর রাজ্জাক ও কলকাতার নবজাতক প্রকাশনার মালিক বিশিষ্ট লেখক মাজহারুল ইসলামের ভাষা আন্দোলন বিষয়ক গ্রন্হে পাওয়া যায়। তবে সব সত্যকে খুলে দিয়েছে উত্তর ২৪ পরগণার রাজারহাট নিউটাউন থেকে আনোয়ার হোসেন ও আব্দুর রব খান সম্পাদিত “ভাবনা এখন” নামে একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্যে পত্রিকায় প্রকাশিত বরকতের পিসতুতো বা ফুফাইতো ভাই বিশিষ্ট আইনজীবী মহম্মদ এহিয়ার এক বিশাল সাক্ষাতকার। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন বিশিষ্ট লেখক বদরুদ্দোজা হারুন(ভাবনা এখন,২০১৫, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষাদিবস সংখ্যা, পৃষ্ঠা ১৫-২৬)। ঐ সাক্ষাতকার থেকেই জানা যায়, মহম্মদ এহিয়ার বড় দাদা মহম্মদ সালেহ সাহেবের সঙ্গে বরকতের বড় বোন চাঁদবিবির বিয়ে হয়। সালেহ সাহেব বরকতের বড় ভগ্নিপতি। তিনি হাওড়ার ফুড সাপ্লাই ইন্সপেক্টর ছিলেন। থাকতেন হাওড়ার কালিবাজারে। বরকত তাঁর বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করতেন। কিন্তু দাঙ্গা দাঙ্গা পরিস্হিতিতে বরকতের নিরাপত্তা প্রশ্নের মুখে পড়ে। সালেহ সাহেব নিরাপত্তার কথা ফোনে জেলাশাসককে জানান। হাওড়ার জেলাশাসক তখন সৈয়দ মহম্মদ জাকিরিয়া নামে এক পুলিশ অফিসারকে দিয়ে তার বাসায় নিরাপত্তার সঙ্গে থাকার ব্যবস্হা পাকা করে দেন। এই কথা সাক্ষাতকারে আইনজীবী মহম্মদ এহিয়া স্বীকার করেন। এই সৈয়দ মহম্মদ জাকিয়া পুলিশের সি আই ছিলেন। এই জাকিরিয়া সাহেবের দুই ছেলে কামরুজ্জামান ও বদিউজ্জামান।একমাত্র মেয়ে বানু। বরকত পরিবার ও জাকিরিয়া পরিবারের মধ্যে গড়ে ওঠে সম্পর্ক। বরকতের সঙ্গে কি বানুর কোনো প্রণয় গড়ে ওঠেছিল? আইনজীবী এহিয়ার অকপট উক্তি, “ঠিক প্রণয়ন সম্পর্ক বলব না। তবে এক ধরণের ভালো লাগার ব্যাপার ছিল একথা বলতে পারি।” এই যে ভালো লাগার ব্যাপারের কথা উঠে এসেছে তাতো একটা গভীর ভালোবাসাই বলা যেতে পারে। তা অস্বাভাবিক কিছুই নয়। দেশভাগ হল। জাকিরিয়া চলে গেলেন ঢাকায়।দেশভাগের পরেও নাকি সম্পর্ক ছিলো। জাকিরিয়া সাহেবের বাড়ি ছিল বীরভূম জেলার সিউড়ির কাছে কুশমাশুল গ্রামে। অপশন দিয়ে ঢাকায় চলে গিয়ে সেখানকার পুলিশের উচ্চপদে অধিষ্ঠত হন।বরকত মুর্শিদাবাদে ফিরে গিয়ে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে আই এ পাশ করে ঢাকা চলে যান।তাহলে কি বরকত বানুর টান অনুভব করতেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা আন্দোলনের বিষয়টি দেখভাল করার দায়িত্ব ছিল জাকিরিয়া সাহেবের হাতে। দেশভাগের পরও বরকত ও জাকিরিয়া সাহেবের পরিবারের সুগভীর সম্পর্ক ছিল বলে অনেক গবেষকের দাবি। কিন্তু প্রণয় পরিণয়ে গড়ালো না কেন? এটাও লাখ টাকার প্রশ্ন। কেনই বা এই সম্পর্কটা ইতিহাসের কানাগলিতে হারিয়ে গেল? রহস্যটা ঠিক এখানেই। হয়তো ইতিহাস আমাদেরকে পরে অনেক কিছু জানাবে। ততদিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
খুলনা গেজেট/ বি এম এস