খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

ভাষা আন্দোলনের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর দু’দফা দৌলতপুর বিএল কলেজ সফর

কাজী মোতাহার রহমান

ভাষা আন্দোলনের প্রথম অধ্যায় আটচল্লিশ সালে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সাড়ে চার কোটি বাঙালির প্রথম প্রতিবাদী শোগান “উর্দু নয়, রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই”। কুমিলার গণ পরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার দাবি তোলেন। আটচল্লিশ সালের পঁচিশ ফেব্রæয়ারি করাচীতে অনুষ্ঠিত আইন সভায় এ দাবি প্রথম উচ্চারিত হয়। তিনি কংগ্রেস এর আদর্শ ও দর্শনে বিশ্বাসী। আইন সভায় এ দাবির প্রতি সমর্থন জানান, কংগ্রেস দলীয় সদস্য গিরিশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ভূপোদ কুমার দত্ত ও প্রেম হরি বর্মা।

পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন প্রস্তাবের বিরোধিতা করে জোরালো কন্ঠে বলেন, “উর্দু হবে রাষ্ট্র ভাষা”। মূখ্যমন্ত্রীর এ বক্তেব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বুদ্ধিজীবি ও ছাত্র সমাজ ২৬ ফেব্রæয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট ও ঢাবিতে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। এ সময় মুসলিম লীগ সরকারের বিরোধিতা করার মত কোনো রাজনৈতিক শক্তি ছিল না।

মূখ্যমন্ত্রীর বক্তেব্যের একমাস ২২দিন আগে আটচলিশের চার জানুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ আব্দুল আজিজ এ নয়া ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় সদস্য। শেখ মুজিবুর রহমানের দায়িত্ব বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা আর শেখ আব্দুল আজিজের দায়িত্ব বৃহত্তর খুলনা জেলায় ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করা। তাদের দায়িত্ব এসব অ লে ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা, ছাত্রলীগের পক্ষে ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করার।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সংগ্রাম পরিষদ আটচল্লিশ সালের ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের ১৭ জেলায় হরতাল আহŸান করে। পূর্ব পাকিস্তান নামক ভূ-খন্ডে এই প্রথম হরতাল। কর্মসূচি সফল করতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান খুলনায় আসেন। তার আগমন উপলক্ষে দৌলতপুর বিএল কলেজে ছাত্র সভার আয়োজন করা হয়। এ কলেজের ছাত্র সংগঠনের মধ্যে মুসলিম ছাত্রলীগ ও ছাত্র ফেডারেশনের তৎপরতা ছিল। তখনকার দিনে খুব সীমিত সংখ্যক ছাত্ররা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল। ভাষা আন্দোলনের দাবিতে বিএল কলেজে অনুষ্ঠিত ছাত্র সভায় মুসলিম লীগের সমর্থকরা মারপিট করে। কয়েকজন জখম হয়। শেষাবধি ছাত্র সমাজ আয়োজিত ছাত্রসভায় ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা করেন। তিনি তার বক্তৃতায় ভাষা আন্দোলনের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করার জন্য ছাত্র নেতৃবৃন্দের প্রতি আহবান জানান। মুসলিম লীগ নেতা (১৯৫৮ সালের আইয়ুব খান সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী) আব্দুস সবুর খান ভাষা আন্দোলনের পক্ষে বিএল কলেজে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভার প্রতি সমর্থন জানান।

১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ সদস্য (রামপাল-দাকোপ) শেখ লুৎফর রহমান মনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ সালে বিএল কলেজ আসেন। কলেজ স্টেশনে তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানায় ছাত্রসমাজ। তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ছাত্র সমাজকে এগিয়ে আসার আহবান জানান। গোবরচাকার অধিকারী নগর আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক শেখ ফজলুল হক বলেছেন, বঙ্গবন্ধু’র আহবানে সাড়া দিয়ে বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি।

আটচলিশ সালের ১১ মার্চ ভাষা দিবস সফলের আন্দোলনের সময় সচিবলায়ের সামনে পুলিশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে, ১৫ মার্চ মুক্তি পান। ঊনপঞ্চাশ সালের ২৯ এপ্রিল দ্বিতীয় দফা এবং ৩১ ডিসেম্বর ৩য় দফায় তাকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় কারাগারে তাকে পাঠানো হয়। বন্দী অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে তার আটক আদেশ বৃদ্ধি করা হয়। পঞ্চাশ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান দন্ডবিধির ১৪৪ ধারার বিচারে তাঁর তিন মাস জেল হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পঞ্চাশ সালের ২৯ ডিসেম্বর ফরিদপুর জেল থেকে তাঁকে খুলনা জেলে পাঠানো হয়। এ সময় খুলনায় তাঁর বিরুদ্ধে ১৪৭ ধারায় একটি মামলা চলছিল।

১৯৫১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি খুলনা জেলে গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন (সিরাজ উদদীন আহমেদ রচিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান)। এক মাস পর ২২ মার্চ গোয়েন্দা পুলিশ তার প্রতিবেদনে উলেখ করেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের সমালোচনা করেছেন। প্রতিবেদনে এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা উল্লোখ করেন জিজ্ঞাসাবাদে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষ্য অনুযায়ী সাধারণ নির্বাচন এখনই অনুষ্ঠিত হলে আওয়ামী মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করবে। কারাগারে তাঁর মৃত্যু হলেও বন্ড দিয়ে তিনি মুক্তি লাভ করবেন না। এ প্রতিবেদন পাওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ শাখা তাঁকে মুক্তি ও পুনরায় গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়। ১৯৫১ সালের ৭ মার্চ খুলনা জেল থেকে তাঁকে মুক্তি এবং একই আদেশে গ্রেফতার করে ফরিদপুর জেলে পাঠানো হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি ঢাকায় কয়েকজন ছাত্র শহীদ হওয়ার পর ফরিদপুরে শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে গণ আন্দোলন শুরু হয়। গণ দাবির মুখে সরকার ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রæয়ারি নিঃশর্তে তাঁর মুক্তি দেয়। দৈনিক ইত্তেহাদের ১৯৪৮ সালের ১১ ডিসেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয় এক ডিসেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান বিএল কলেজে ভাষা আন্দোলনের দাবিতে আরও একটি ছাত্র সভায় বক্তৃতা করেন।




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!