ভাষা বিশ্বের প্রতিটি জাতির নিজস্ব সংস্কৃতির এক অনন্য অংশ। আবহমানকাল থেকেই বিশ্ববাসী নিজের দেশের বা অঞ্চলের ভাষায় কথা বলে সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এসেছে স্বভাবতই। এ ভাষাই তাদের মাতৃভাষা। এ যাবৎ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘটনা ঘটেছে অসংখ্য। তবে পৃথিবীতে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে নিজের মাতৃভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে এক বিরল আন্দোলন করতে দেখা গেছে শুধু একটিমাত্র দেশেই। অথচ বর্তমানে সে দেশেই করা হচ্ছে সেই মাতৃভাষা ও তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা! এতে করে সে দেশের যে সকল সোনালি মানুষ নিজ ভাষার প্রতি ভালোবাসায় জীবন উৎসর্গ করে নিজেদের নাম ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করেছিলেন, তাঁদের সেই ত্যাগের শুভ্র চেহারার ওপর দেখা দিয়েছে কালিমার মতো বিরাট এক প্রশ্নচিহ্ন!
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্ম হয়। অধুনা বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দেখা দেয় প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের তফাৎ। আর সংস্কৃতি, ভাষা ও জীবনধারার দিক থেকে এ তফাতের পরিমাণ পরিলক্ষিত হয় আরও প্রকটভাবে। কিন্তু সামষ্টিকভাবে গোটা পাকিস্তানের জনসংখ্যার অধিকাংশ মানুষই ছিলেন বাঙালি বা বাংলাভাষী। ফলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পরিগনিত হওয়ার কথা ছিল একমাত্র বাংলার। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ১৭ মে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। এতে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, এনামুল হক প্রমুখ বাঙালি বুদ্ধিজীবী প্রবন্ধ লিখে প্রতিবাদ করেন ওই অন্যায্য প্রস্তাবের বিরুদ্ধে। পরে ১৯৪৭ এর শেষ দিকে করাচিতে অনুষ্ঠিত এক শিক্ষা সম্মেলনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের এমন অন্যায্য কর্মকাণ্ডের ফলে পূর্ব বাংলার মানুষের জনমনে পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর নেতিবাচক চিন্তাধারার উদ্রেক ঘটে।
এমতাবস্থায় ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দুকে বাদ না দিয়ে তার পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করার যথার্থ প্রস্তাব রাখলে, তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ২ মার্চ সর্বস্তরের ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এ সংগঠনটি ১১ মার্চ ঢাকা শহরজুড়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সাধারণ ধর্মঘট পালন করে। দিনটিকে তাঁরা ঘোষণা করে ভাষা দাবি দিবস হিসেবে। পরে ১২ থেকে ১৫ মার্চ অব্যাহত তীব্র আন্দোলনের মুখে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন। চুক্তিটিতে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি, পুলিশি অত্যাচারের নিরপেক্ষ তদন্ত, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম ও রাষ্টভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, সংবাদপত্রের ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারসহ আরও কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল শর্ত আকারে। কিন্তু নাজিমুদ্দিন সরকার চুক্তির কিছু কিছু শর্ত মানলেও মূল শর্ত তথা বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম এবং রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বরং এরই মধ্যে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ঢাকায় এসে এক ছাত্র সম্মেলনে “একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা” বলে ঘোষণা করেন ২১ মার্চ। পরে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক প্রতিনিধি দল তাঁর সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপি প্রদান করলেও তিনি সবকিছু প্রত্যাখ্যান করেন নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে করা চুক্তিকে ‘একপেশে এবং চাপের মুখে সম্পাদিত’ উল্লেখ করে।
পরে ১৯৫০ সালের ডিসেম্বরে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে আরেক দফা ষড়যন্ত্রের পসরা সাজায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। এ সময় তারা ভাষা সমস্যার প্রস্তাবিত সমাধান প্রণয়নের নামে মাওলানা আকরাম খানের নেতৃত্বে একটি ভাষা কমিটি গঠন করে বাংলা অক্ষরগুলোকে আরবি হরফ দ্বারা প্রতিস্থাপনের ঘৃণ্য অপচেষ্টা চালায়। কিন্তু তখনকার সচেতন ও প্রগতিশীল বাঙালি জনগোষ্ঠীকে এ ধরনের নীচ উদ্যোগ দ্বারা দমন করা যায়নি।
তবে সর্বতোভাবে ভাষা আন্দোলন জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হয় ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পুনঃঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে। এ সময় বাঙালি জনসমাজ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে লাগাতার আন্দোলন শুরু করে এবং ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয়৷ ফলে পাকিস্তান সরকার আন্দোলন দমাতে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ভাষাপ্রেমিক অকুতোভয় নিরস্ত্র বাঙালি সেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকায় শান্তিপূর্ণ মিছিল বের করলে পাকিস্তানি পুলিশের অতর্কিত আক্রমণে লিখিত হয় ভাষা আন্দোলনের এক রক্তিম ইতিহাস। আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা থেকে সারা দেশে। যার পরিক্রমায় ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানিরা বাধ্য হয় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে।
এই হলো সংক্ষেপে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। তবে এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্যটি আসলে কী ছিল, সেটিও ইতিহাসের সঙ্গে সমানভাবে জানা জরুরি। কিন্তু ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর বর্তমানে সেই গৌরবমণ্ডিত আন্দোলনের ৭২ বছর পেরিয়ে গেলেও তার উদ্দেশ্যগুলো কি যথাযথভাবে সফলতার মুখ দেখেছে? উত্তর হলো— না। কেন এমনটি হলো এখন তা খতিয়ে দেখা যাক।
আগেও উল্লেখ করা হয়েছে যে ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়া ও শিক্ষার মাধ্যম বাংলা করার জন্য। কিন্তু বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও সর্বস্তরের জনগণ বাংলা ভাষার যথাযথ ব্যবহারে আগ্রহী নন। বিশেষ করে সমাজের কিছু উচ্চ ও শিক্ষিত শ্রেণির মানুষেরা বাংলায় কথা বলার সময়ও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। এমনকি তারা ভাবেন সন্তানদেরকে পড়ানোর জন্য আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল-কলেজগুলো। ফলে দেখা যাচ্ছে, অনেক পিতা-মাতা তাদের একেবারে শিশুসন্তান যারা সবেমাত্র কথা বলা ও ভাষার অক্ষর চেনা শিখছে, তাদেরকে বাংলা অক্ষর বা সংখ্যা আগে না চিনিয়ে বা শিখিয়ে ইংরেজি অক্ষর বা সংখ্যা আগে চেনাচ্ছেন ও শেখাচ্ছেন। এর সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইংরেজি অক্ষর দিয়ে বাংলা লেখার প্রবণতাও এ দেশের এক বৃহৎ অংশের মধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে বর্তমানে। এই যদি হয় বর্তমানে বাংলা ভাষা ব্যবহারে বাঙালির অবস্থা, তবে এ ভাষার গন্তব্য আসলে কোথায় তা অনুধাবন করা খুবই কঠিন হয়ে যায় যখন মনে পড়ে, ১৯৫০ সালে মাওলানা আকরাম খানের ভাষা কমিটির বাংলা অক্ষরকে আরবি হরফ দ্বারা প্রতিস্থাপনের অপপ্রয়াসকে এই বাঙালি জাতিই প্রতিহত করেছিল।
ইংরেজি ভাষার ওপর আমার কোনো বিদ্বেষ নেই। এটি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে বিশ্ব পরিমণ্ডলে স্বীকৃত। কিন্তু তাই বলে আন্তর্জাতিক ভাষাকে যে নিজের মাতৃভাষার মতো করে ব্যবহার করতে হবে দৈনন্দিন জীবনে— তারও কোনো কারণ আমি দেখি না। অনেক উন্নত দেশে যেখানে নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে আরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে, আমাদের মাঝে তা নেই। এ ক্ষেত্রে অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন এই বলে যে, উন্নত দেশগুলো উন্নত হওয়ার পরই নিজেদের ভাষাকে সর্বস্তরে ব্যবহার করছে। তাদের এ প্রশ্নের জবাব জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. একেএম শাহনাওয়াজের একটি নিবন্ধে আছে। তিনি লিখেছেন, ফ্রান্সের লুভ্যর মিউজিয়ামে গিয়ে প্রত্নতত্ত্ব বস্তুগুলোর পাশে তিনি ফরাসি ভাষায় বস্তুগুলোর নাম ও বিবরণ দেখতে পান আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজির বদলে। পরে হোটেলে ফিরে তিনি হোটেলের ব্যবস্থাপককে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে ব্যবস্থাপক বলেন, পশ্চিম ইউরোপের সকল দেশই মনে করে তাদের আজকের এ অবস্থায় পৌঁছানোর মূল চাবিকাঠি তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। কিন্তু তারা যদি শুধু আন্তর্জাতিক ভাষা হওয়ার কারণে ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষাকে তাদের সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশের অবাধ সুযোগ করে দেন, তবে তা তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে তাদেরকে দুর্বল করে ফেলবে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে। তবে এর মানে এই নয় যে, তাদের দেশের শিক্ষার্থীরা অন্যান্য ভাষার বই পড়তে পারবেন না। বরং তাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনুবাদ সেল তৈরি করে বিশ্বের অন্যান্য দেশের বইগুলো অনুবাদের সুব্যবস্থা করা হয়েছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বাংলাদেশের গণমানুষ যদি পশ্চিমা বিশ্বের সংস্কৃতির অন্ধ অনুসরণ না করে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি অটল থাকার যে মানসিকতা আছে— সেটির অনুসরণ করেন সর্বতোভাবে, তা হলেই আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চাকে আমাদের দেশের সার্বিক উন্নয়নের দৃঢ় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি সম্ভব হবে আমাদের গৌরবান্বিত ভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্যগুলোকে বাস্তবায়িত করার।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
খুলনা গেজেট/কেডি