খুলনা, বাংলাদেশ | ৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৪ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ১০ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮৮৬

ভালো থেকো ইচ্ছে পাখি

রুমা ব্যানার্জি

দেখা হলে, সে ফোনে হোক বা সামনা সামনি, প্রশ্ন একটাই কেমন আছো?

ভিতরে চুরমার হওয়া মনের ঘরের কপাট টেনে, মুখে এক ফুরফুরে হাসি টেনে বলি “ভালো আছি। খুব ভালো আছি।” ওরা জানতেও পারে না যে উত্তরের মধ্যে লুকিয়ে থাকে কত মনের ঝড়, কত বৃষ্টির কান্না, কত ভাঙাচোরা পৃথিবীর টুকরো।

গোয়েবলস নীতি মেনে নিজেকেও রোজ বলি আমি খুব ভালো আছি! কি করে ভালো আছি সেটা না, ভালো থাকার চেষ্টাটাই আসল কথা। সারাদিন ছন্দবদ্ধ কাজের মাঝেই অকাজ খুঁজি। কবি নই তাই কবির ছায়ায় কবিতা আর গল্প-উপন্যাসে ডুবে কেটে যায় দিন, মাস, সময়। চক্রাকারে চলতে থাকে সকাল, সাঁঝ থেকে রাত।

যেদিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙে, চলে যাই ছাদে। আমি বসে দেখি চুপচাপ কেমন রাতের কালো; গাছের পাতা চুঁইয়ে ঝরে পড়ছে, টুপ টাপ। এক এক ফোঁটা চোখের জলের মত। যেন আনন্দাশ্রু। গ্লানিহীন মুক্তির স্বাদ পেতে বুদ বুদ ফেটে কলকলিয়ে লাফিয়ে উঠে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। মেঘ মুক্ত করে আকাশ কে ভরে তুলছে আদরের মত নরম আলোয়। এখন ভোরবেলাগুলো অনেক আলাদা, চেহারায় না, মনে।

পায়রারা আসে পালকে ঘুমের গন্ধ নিয়ে। আসে টুনটুনি, দোয়েল। ওরা খুঁটে খুঁটে খায়, ওদের জন্য ছড়িয়ে দেওয়া খাবার। কেউ শুধুই ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকিয়ে দেখে আমাকে। হয়তো আমার মাঝে দেখতে পায় ডানা ভাঙা ইচ্ছে পাখিকে। ওদের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাই। আমিও খুঁটে খুঁটে ছোট্ট ছোট্ট সুখে জীবনের আঁজলা ভরাই। উড়ন্ত মেঘে স্বপ্নের পালক ভাসাই। তারপর জাবর কাটি, পাখিটারই মত, চিবিয়ে চিবিয়ে।

পাখিরা যেমন ডানা গোটায়, এখন আমিও এখন অনেক বেশী গুটিয়ে রাখি নিজেকে। লুকিয়ে রাখি সবার আড়ালে, মনের হদিশ যেন আর কেউ কখনো না পায়। ভালো থাকার জন্য পাঁচিল গড়ে যাই। যে ভাবেই হোক মনকে রক্ষা করা চাই। জীবনের রঙ্গ মঞ্চে অভিনয় টা জবরদস্ত চাই।

আমি নামক মানুষটা ভালো আছি খারাপ থাকতে চাই না তাই। সারাদিন মেকি হাসি হাসতে থাকি শুধু ভালো থাকার চাহিদায়। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজি, রামধনুর রং মাখি চোখে। তাতে ঢেকে যায় বিনিদ্র চোখে পড়া কালি। হাতের নীল খাতায় গল্প লিখতে গিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ি চোখ রাঙানির মাঝে। ঘোলা জলে ডুবে যাওয়া কান্নারা গুমরে ওঠে মনের আড়ালে।

এই বেশ ভালো আছি। সারাদিন কিছুটা হাসি খুশি, গান শোনা। কিছুটা গুমরে ওঠা মনের দীর্ঘশ্বাস গোনা। কিছুটা কান্না মেশানো বিনিদ্র রাত্রির তারা গোনা। সব মিলিয়ে জমজমাট দিন কাটিয়ে রাতের অপেক্ষা করা।

রাতের পর রাত কেটে যায় তারা গুনে। এক আকাশ তারা ছিলো আমার সেই ছোট থেকেই। আজও একটা একটা করে প্রিয় তারা গুনে তুলে রাখি মনের কুলুঙ্গিতে। সাজিয়ে গুছিয়ে না, বরং ছড়িয়ে ছিটিয়ে। যাতে কোন মেঘলা দিনে হঠাৎ যদি চোখে পড়ে, ধুলো ঝেড়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে পারি। ক্ষতের দাগ গুলো, ভুলে থাকা ব্যথাগুলো তারিয়ে তারিয়ে অনুভব করতে পারি।

তারপর কোথা দিয়ে বেলা গড়িয়ে আসে। ব্যস্ত হয়ে যাই নানান কাজে। ঘোর বর্ষার শেষে যেদিন খুব রোদ হয়, সেদিন পা ছড়িয়ে মনের ভেতরের বড় বড় বাক্স প্যাঁটরা খুলি। কত কি তুলে রেখেছি, হাতড়ে বের করি এক এক করে। একে একে বেরিয়ে আসে, কত কত অপরিচিত হয়ে যাওয়া আপন জন, কত কত মেঘলা দিন, কত কত উষ্ণ সম্পর্ক। গুটিকটক পরিত্যক্ত মায়া। লুকিয়ে রাখা হাসি কান্না, মান অভিমান, অভিযোগ, অনুযোগ। মেলে রাখি তাদের রোদেলা বারান্দায়। আহা, একটু আলো-বাতাস পাক এই অন্ধকারের স্বপ্নগুলো! নীল ব্যাথাগুলো একটু জুড়াক। ইচ্ছে পাখিটা মুখ তুলে একবার দেখুক দূরের দিগন্ত। ধূসর হয়েছে তো কি? ধুলো ঝেড়ে, রোদে শুকিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াতে থাকুক ইচ্ছেরা। জীবন তো একটাই, ভালো থাকুক। তারপর আবার হারিয়ে যাক মনের গভীরে ভালো থাকার অপেক্ষায়।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!