খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

ভালবাসার মানুষ : মানুষের ভালবাসা

এ এম কামরুল ইসলাম

রেভারেন্ড ফাদার মারিনো রিগন এসএক্স গতকাল তাঁর জন্মভূমি ইতালিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাঁর জন্ম ইতালিতে হলেও মনেপ্রাণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন খাঁটি বাঙালী। তাইতো তিনি অশীতিপর বৃদ্ধ বয়সেও চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ ছেড়ে ইতালি যেতে রাজি ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত তাঁর আত্মীয় স্বজনরা চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক এক প্রকার জোর করে তাঁকে ইতালি নিয়ে যান। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যাবার আগে তিনি বলেছিলেন – “আমি এক শর্তে যেতে রাজি আছি, আমি যদি ইতালিতে মারা যাই তবে আমার মরদেহ সমাহিত করতে হবে মোংলার শেলাবুনিয়া গীর্জার সামনে।”

তাঁর আত্মীয় স্বজনরা নিরুপায় হয়ে তাঁর দেওয়া শর্ত মেনে নিয়ে তাঁর সুচিকিৎসার জন্য ইতালি নিয়ে গেলেন। দীর্ঘদিন সেখানে চিকিৎসার পর শেষ পর্যন্ত সেখানেই তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন; কিন্তু তাঁর শেষ আশা পূরণ হওয়ার কোন আলামত না পাওয়ায় তাঁর মরদেহ ইতালির নিয়ম অনুযায়ী কফিনে করে হিমঘরে রেখে দিলেন। বাংলাদেশ থেকে ফাদার রিগনের একান্ত ভক্তরা কেউ কেউ যোগাযোগ করতে গিয়েও ব্যর্থ হলো। শুধুমাত্র ফ্রান্সে অবস্থিত ফাদার রিগনের একনিষ্ঠ ভক্ত কাব্য কামরুল ইতালি গিয়ে ফাদারের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলো। তার মাধ্যমে আমরা মোটামুটি সবকিছু অবহিত হয়েছিলাম।

মোংলার শেলাবুনিয়ায় ফাদার রিগনের তীর্থভূমিতে তখন শোকসভা চলছিল। আমি খুলনা থেকে সেই শোকসভায় যোগ দিয়েছিলাম। ওই শোকসভায় মোংলার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। খুলনা থেকে বিশপ মহোদয়ও গিয়েছিলেন। আমার পৌঁছাতে একটু দেরি হওয়ায় শোকসভা আগেই শুরু হয়েছিল। আমি সেখানে হাজির হতেই আমার জন্য নির্দিষ্ট চেয়ার এগিয়ে দেওয়া হলো; আমি চেয়ারে না বসে দাঁড়িয়ে থাকলাম। উপস্থিত সকলে কিছুটা হতবাক হলেন। আমার বক্তব্যের পালা শুরু হতে প্রায় একঘন্টা লাগলো। আমি ততক্ষণে দাঁড়িয়েই কাটালাম। কারণ আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছিলাম ফাদারের বিদেহী আত্মা আমাদের সবাইকে দেখছিলেন এবং আমাদের কথা শুনছিলেন।

আমার বক্তৃতার সময় হলো। উপস্থাপক আমার বক্তব্যের জন্য নাম ঘোষণা করলেন। আমি আগে থেকেই দাঁড়িয়েই ছিলাম। কিন্তু সে দাঁড়ানো বক্তৃতার জন্য দাঁড়ানো নয়; সেই দাঁড়ানো ছিল ফাদারকে সম্মান প্রদর্শন করার জন্য। সকল বক্তা তাদের নাতিদীর্ঘ আলোচনায় ফাদার রিগনের জীবনের অনেক গুণের বিবরণ দিলেন; কিন্তু আমি আমার বক্তব্যে তেমন কিছুই বলতে পারলাম না। শুধু এই মহান মানুষটির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে সোজা স্টেজ থেকে নেমে পাশেই অবস্থিত ফাদারের সেই কাঙ্খিত কবরের জায়গায় গেলাম। সাথে সাথে কিছু কিছু ভক্ত মহিলা ও পুরুষ চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে অনুসরণ করলো। আমার অসৌজন্যমূলক আচরণে শোকসভা শেষ না হতেই একপ্রকার ভেঙ্গে গেল। উপস্থিত গণ্যমাণ্য ব্যক্তিবর্গ সামান্য বিচলিত হলেন। আমার পিছু নেওয়া বিলাপের সুরে ক্রন্দনরত সকলে একসাথে আমাকে জড়িয়ে ধরে দাবির সুরে বললেন,
“আমাদের ফাদারের লাশ ইতালি কেন, আমরা তাঁর সমাধি এখানে দেখতে চাই। মৃত্যুর আগে তিনি এই কথাই বলে গেছেন। আপনি যেভাবে পারেন আমাদের প্রিয় ফাদারের মরদেহ ইতালি থেকে এখানে এনে সমাহিত করার ব্যবস্থা করেন।”

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আমি তাদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে নিজেও কাঁদতে লাগলাম। কিন্তু ফাদারের সেই ভালবাসার মানুষগুলি ছিল নাছোড়বান্দা। তারা ভেবেছিল আমি মহা ক্ষমতাবাণ মানুষ। আমি চাইলেই চোখের পলকে ফাদার রিগনের মরদেহ ইতালি থেকে এনে শেলাবুনিয়ায় সমাধিস্থ করতে পারি। আসলে আমি কোন ক্ষমতা রাখি না তা কোনভাবেই তারা বুঝতে চাইবেনা সেকথা আমি জানতাম। শেষ পর্যন্ত তাদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বললাম,
‘ আচ্ছা আমি চেষ্টা করবো’।

কিন্তু তাতেও তারা ক্ষ্যান্ত হলো না। আমাকে একপর্যায়ে জিম্মি করে প্রতিশ্রুতি আদায় করে ছাড়লো। আমি জেনেশুনে মিথ্যা আশ্বাসের বিনিময়ে সেখান থেকে পরিত্রাণ পেলাম।

ফাদার রিগনের ভক্তের কোন অভাব ছিলনা। বিলাপ করা সাধারণ ভক্তের বাইরেও কিছু শিক্ষিত বিবেকবান ভক্ত আমার সাথে ফাদারের গভীর সম্পর্কের কথা জানতেন। তাঁদের অনেকেই পাশে দাঁড়িয়ে আমার অসহায় অবস্থা দেখেছিলেন। আমি মোংলা থেকে খুলনায় ফিরে আসার পর তাদের অনেকেই আমার কাছে তাগিদ দিতে শুরু করলেন। তাদের অন্যতম ছিলেন মোংলার হলদিবুনিয়া নিবাসী ফাদার রিগনের ভক্ত বাবু সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস ও ফ্রান্সে বসবাসরত কাব্য কামরুল।

সুভাষ বাবু ফাদার রিগনের একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি খ্রিষ্টান ধর্মের মানুষ না হয়েও ফাদারের বিভিন্ন মহৎ কাজের একনিষ্ঠ সমঝদার। তিনি তাঁর নিজের গ্রামে গড়ে তুলেছেন ‘ফাদার রিগন শিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন’। ফাদারের জীবদ্দশায় এই মহান সংস্থা গড়ে তুলে সেখান থেকে ফাদারের নামে শিক্ষার জন্য নানাবিধ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছেন।

‘ফাদার রিগন শিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন’ এর একটা মজার স্মৃতি আমার মনে পড়ে। ফাদার জীবিত অবস্থায় সমগ্র মোংলাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে গেছেন। হলদিবুনিয়ার বিশাল স্কুলটি তার অন্যতম। সকলে মিলে এই স্কুলের কাছাকাছি একটি জায়গা কিনে ফাদারের নিজ নামে শিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের অফিস তৈরী করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু হাজারো চেষ্টা করে দীর্ঘদিনেও তাঁর পছন্দের দশ শতাংশ জায়গা কিনতে পারলেন না। সকলের পছন্দের ঐ জায়গার মালিক ছিলেন হলদিবুনিয়া গ্রামের নিরঞ্জন মন্ডল। তাকে ঐ জমির বাজার মূল্য থেকেও অনেক বেশি দাম দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েও উদ্যোক্তরা জমি কিনতে ব্যার্থ হয়েছিলেন। এমন সময় একদিন ফাদার রিগন হলদিবুনিয়া স্কুলে এক অনুষ্ঠানের শেষে বাসায় ফিরে যাওয়ার সময় হটাৎ একজন ভদ্রমহিলা ফাদারের পায়ে প্রণাম করলেন। ফাদার তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মহিলার মাথায় হাত রেখে বললেন,
“একি করছো মা, তুমিতো আমার মা। আমিই তোমাকে প্রণাম করবো।”
এই বলে ফাদার চলে গেলেন। মহিলা ভীষণ লজ্জিত ও মনে মনে গর্বিত হলেন। কিছুদিন পর ঐ ভদ্রমহিলা তার স্বামীকে নিয়ে ফাদার রিগনের তীর্থ শেলাবুনিয়ায় হাজির হলেন। ঐ হিন্দু ভদ্রমহিলার স্বামী বাবু রঞ্জিত মন্ডলই ছিলেন ফাদার রিগন শিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের জন্য নির্ধারিত সেই দশ শতাংশ জমির মালিক। মহিলার স্বামী তার স্ত্রী গীতা মন্ডলের কাছে ফাদারের কাহিনী শুনে জমি দেওয়ার জন্য সরাসরি ফাদারের কাছে স্ত্রীসহ হাজির হয়ে একটা কঠিন শর্ত জুড়ে দিলেন।

 

তিনি অতিশয় গরীব মানুষ। ঐ জমিটুকু তার সম্বল। তাই দীর্ঘদিন সকলের অনুরোধ উপেক্ষা করে জমি আটকে রেখেছিলেন। কিন্তু তার স্ত্রীর কাছে ফাদারের আচরণের কথা শুনে তার গুণমুগ্ধ হয়ে বিনি পয়সায় জমিটি ফাদার রিগন শিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনে দান করার প্রস্তাব দিলেন। ফাদার শত চেষ্টা করে তাকে একটি টাকাও দিতে পারলেন না। তিনি সমস্ত জমিটুকু ফাউন্ডেশনের নামে রেজিষ্ট্রী করে দিলেন। এলাকার মানুষ অবাক বিস্ময়ে তার ত্যাগের কথা আজও মনে রেখেছেন।

বলছিলাম সুভাষ বাবুর কথা। তিনি ছোটকাল থেকে ফাদারের ভক্ত। ফাদারের অনেক রচনা ও কর্মকাণ্ড এখনও তিনি স্বযত্নে সংরক্ষণ করে আছেন। প্রতিবছর তার উদ্যোগে এখনও ফাদারের জন্মদিনে মহাসমারোহে হলদিবুনিয়া স্কুল মাঠে ‘রিগন মেলা’ অনুষ্ঠিত হয়।

কাব্য কামরুল ফ্রান্সে যাবার আগ পর্যন্ত ফাদারের একান্ত ভক্ত সহযোগী ছিলেন। ফাদারের জীবন ও কর্ম নিয়ে তিনি অনেক গবেষণা করেছেন। ফাদারের ইতালির জীবন নিয়ে লেখার জন্য তিনি কয়েকবার ইতালিতে গিয়েছেন। ফাদারের অন্তেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য তিনি ফ্রান্স থেকে ইতালি পর্যন্ত গিয়েছিলেন।

ফাদারের মরদেহ ইতালি থেকে বাংলাদেশে আনার জন্য সুভাষ বাবু ও কাব্য কামরুল আমাকে কঠিন তাগিদ শুরু করলেন। আমি একপ্রকার তাদের যাঁতাকলে আবদ্ধ হয়ে গেলাম। শেষ পর্যন্ত সুভাষ বাবুকে অনুরোধ করলাম একটা দরখাস্ত ড্রাফট করে দিতে। আমার কথামতো তিনি মাননীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বরাবর দরখাস্ত লিখলেন। কিন্তু আমরা কোন্ অধিকার নিয়ে একজন ইতালির নাগরিকের মরদেহ দেশে এনে সমাধিস্থ করতে চাই তার বৈধতা খুঁজে পেলাম না। শেষ পর্যন্ত খ্রিষ্টান ধর্মযাজক বিশপ মহোদয়ের শরণাপন্ন হলাম। তাঁর স্বাক্ষর নিয়ে মাননীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে আবেদন পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। যথারীতি সুভাষ বাবু বিশপ মহোদয়ের স্বাক্ষর নিয়ে আবেদনপত্রটি আমার কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

আমি সেই আবেদনপত্রটি পেয়ে চারদিকে শুধু অন্ধকার দেখতে লাগলাম। ওদিকে সুভাষ বাবু ও কাব্য কামরুল আমাকে বার বার তাগিদ দিতে থাকলেন। আমি শুধু নিজের সাথে প্রতারণা করে তাদেরকে মিথ্যা আশ্বাস দিতে থাকলাম। আর মনে মনে প্রকৃত পথ খুঁজতে লাগলাম।

বেশ কয়েকমাস চলে গেল। হঠাৎ একদিন আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু জনাব ফারুকী হাসানের কাছে সবকিছু খুলে বললাম। তিনি একজন মহাপ্রাণ মানুষ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় আছে। প্রায় প্রতিদিন তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন বলে আমি জানতাম। এর আগে তাঁর মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে আমি মানিকগঞ্জের একটি প্রতিবন্ধী সংস্থায় পাঁচ লক্ষ নগদ অর্থ অনুদান করিয়ে দিয়েছিলাম। ফারুকী ভাইকে আমি ফাদার রিগনের বিষয় সবিস্তারে বুঝিয়ে বলে তাঁর হাতে সেই আবেদনপত্রটি ধরিয়ে দিলাম। তিনি দুই দিনের মধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে অনুমোদন করিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়ে দিলেন। পরবর্তী দুই তিন দিনের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি চলে গেল খুলনার জেলা প্রশাসনের কাছে। খুলনার জেলা প্রশাসক মহোদয় সেই চিঠি পেয়ে হন্যে হয়ে চিঠির উৎস খুঁজতে লাগলেন।

ঐ সময় জেলা প্রশাসক মহোদয়ের রুমে বসা ছিলেন খুলনা রুপান্তর নামক এনজিও-র কর্তা ও খুলনার অতি পরিচিত বাবু স্বপন কুমার গুহ। তিনি ফাদার রিগনের একজন ভক্ত ও আগে থেকেই জানতেন যে, আমি ফাদারের মরদেহ ইতালি থেকে বাংলাদেশে আনার চেষ্টা করছি। তাই তিনি সাথে সাথে আমাকে ফোন করে চিঠির বিষয় অবহিত করলেন। আমিও অগ্রগতি জেনে মনে মনে আশ্বস্ত হলাম। কিন্তু এটা ছিল সবে শুরু।

ডিসি অফিসের প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করা হলো। এবার যেতে হবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। কিভাবে কী করবো কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না। এমন সময় আমার মনে পড়ে গেল আর একজন মহান মানুষের কথা। তাঁর নাম জনাব মোস্তফা কামাল। যিনি এক সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ছিলেন। তিনি চাকরি জীবনে আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। বর্তমানে তিনি অবসরে আছেন। আমি তাঁকে ফোন করে সবকিছু খুলে বলায় তিনি আমাকে আরো একজন মহান মানুষের ফোন নম্বর দিয়ে বললেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে এই সমস্ত কাজগুলি করে থাকেন লেঃকঃ অবঃ জনাব সাজ্জাদ আলী জহির বিরবিক্রম। তিনি অসাধারণ ভাল মানুষ। আপনি তাঁর সাথে কথা বলুন’।

সেদিন ছিল শুক্রবার। আমি ভয়ে ভয়ে এই মহান মানুষটির কাছে ফোন করলাম। তিনি আমার ফোন পেয়ে মন দিয়ে সব কথা শুনে বললেন,
‘আপনি কোথায় আছেন?’
আমি বললাম- ঢাকার ধানমন্ডি আমার বাসায়।
তিনি কাল বিলম্ব না করে আমার বাসার ঠিকানা নিয়ে বাসায় হাজির হলেন। একসাথে জুম্মার নামাজ আদায় করে আমার কাছ থেকে কাগজপত্র নিয়ে নিলেন। তিনি ফাদার রিগনের অনেক তথ্য জানতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ফাদার রিগনের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছিলেন। ফাদারের বিষয় তাঁর আগ্রহ দেখে আমিও আবেগ আপ্লূত হলাম। তিনি ফাদারের মরদেহ ইতালি থেকে দেশে আনার বিষয়ে আমাকে আশ্বাস দিয়ে কাগজপত্র নিয়ে চলে গেলেন।

জনাব সাজ্জাদ স্যার ফাদারের লাশ ইতালী থেকে দেশে আনার জন্য হন্যে হয়ে পড়লেন। তিনি তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব জনাব শহিদুল হক সাহেবের সাথে দেখা করে সকল বিষয় অবহিত করলেন। পররাষ্ট্র সচিব মহোদয় কাগজপত্র বুঝে নিয়ে ফাদারের মৃত্যুর খবরের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানতে চাইলেন। তখন সাজ্জাদ স্যার আমার উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন।

 

পররাষ্ট্র সচিব মহোদয় সকল ফাইলপত্র নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করলেন। ফাদার রিগনের মৃত্যু সংবাদ শুনে তিনি ভীষণ মর্মাহত হয়ে পড়লেন। ফাদারের মৃত্যু তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। ফাদার রিগনকে তিনি ব্যাক্তিগতভাবে চিনতেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ফাদারের মহান অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদানের কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আর একবার স্মরণ করলেন।৷ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফাদার রিগনের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন তাও তিনি জানতেন। কিন্তু ফাদারের মৃত্যু তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না বা পুরাপুরি বিশ্বাস করতে না পেরে খবরের সূত্র জানতে চাইলেন। পররাষ্ট্র সচিব মহোদয় তখন সাজ্জাদ স্যার ও আমার কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানালে তিনি খবরের নির্ভরযোগ্যতা পেয়ে ফাদারের মরদেহ ইতালি থেকে বাংলাদেশে আনার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলেন।

ইতিপূর্বে কোন বিদেশির লাশ বিদেশ থেকে এনে বাংলাদেশের মাটিতে সমাহিত করার নজির না থাকলেও বিদেশ থেকে অনেক বাংলাদেশির মরদেহ দেশে এনে সমাহিত করার বিষয়ে সাজ্জাদ স্যার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। তাই ফাদার রিগনের মরদেহ ইতালি থেকে বাংলাদেশে এনে সমাহিত করার দায়িত্বটাও সাজ্জাদ স্যারের উপর অর্পিত হলো।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় নির্দেশে পররাষ্ট্র সচিব মহোদয় সাজ্জাদ স্যারকে ইতালি থেকে ফাদারের মরদেহ দেশে এনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব দিয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে সহায়তার নির্দেশ দিলেন। এরপর আর আমার পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এই মহান মানুষটি প্রতিদিন আমাকে কাজের অগ্রগতি নিজ থেকে জানাতেন।

মরদেহ দেশে আনার জন্য কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের যৌথ কমিটির প্রয়োজন হয় যা অত্যন্ত দূরূহ বিষয়। তারপর ইতালির বাংলাদেশ দূতাবাস ও বাংলাদেশে ইতালির দূতাবাস আরো কতকিছু। সবকিছু এই মহান মানুষটি একের পর এক সমাধা করতে লাগলেন। আল্লাহর অশেষ রহমতে সকল বাঁধা পেরিয়ে মরদেহ দেশে আনার প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো। সাজ্জাদ আলী স্যার ও আমি মোংলায় গিয়ে কয়েকবার সমন্বয় সভার আয়োজন করলাম। জাতিধর্ম নির্বিশেষে সমন্বয় কমিটি হলো। সরকারি সকল অফিসার মনপ্রাণ উজাড় করে সহায়তা দিলেন। ঢাকা থেকে মোংলা পর্যন্ত বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার ব্যবস্থা হলো।

অবশেষে ফাদারের মরদেহ ঢাকা বিমান বন্দরে যথাযোগ্য রাষ্ট্রেীয় মর্যাদায় অবতরণ করলো। ইতালি থেকে বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন মাননীয় কনসাল জেনারেল ও ফাদারের ভাগিনা সাথে এলেন। পরদিন সকালে আমিসহ সকাল সাতটায় তেজগাঁও পুরানো বিমানবন্দর থেকে হেলিকপ্টার ফ্লাই করার সিদ্ধান্ত হলো।

আমি ঐ সময় ঢাকায় সিআইডি অফিসে পনের দিনের একটি ট্রেনিং কোর্সে ছিলাম। ঐ দিনই ট্রেনিং সেন্টারে পরীক্ষার সিডিউল পড়ে গেল। অতএব আমার মোংলা যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়লো। আমি মনোক্ষুণ্ণ হয়ে উর্ধতন অফিসারবৃন্দের কাছে সবিস্তারে ঘটনা জানানোর পরও পরীক্ষার কারণে আমার ছুটি মঞ্জুর হলো না। এক পর্যায়ে আমি কঠিন হয়ে যেকোন মূল্যে মোংলা যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যাক্ত করলাম। শেষ পর্যন্ত মোংলা থেকে ফিরে পরের দিন পরীক্ষা দেওয়ার শর্তে আমার ছুটি মঞ্জুর হলো।

পরদিন ভোর ছ’টায় আমি তেজগাঁও পুরানো বিমান বন্দরে সবার আগে হাজির হলাম। বিমান বাহিনীর অত্যন্ত বিনয়ী কিছু অফিসার সেখানে উপস্থিত থেকে আমাকে বসতে দিলেন। একে একে নির্ধারিত সকল মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত অফিসারবৃন্দ আসতে থাকলেন। উপস্থিত হলেন মোংলার কৃতি মানুষ জনাব নমিতা হালদার। যিনি ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এককালে পিএস ও গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সচিব। তিনি ফাদার রিগনের সরাসরি সাহচর্যে বড় হয়েছিলেন। ফাদারের মরদেহ দেশে আনার বিষয়ে তাঁর চরম আগ্রহ ও সহযোগিতা ছিল।

অবশেষে ফাদারের মরদেহবাহী এম্বুলেন্স হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পুরানো বিমানবন্দরে যথাযোগ্য গাড়ি বহর সহকারে হাজির হলো। সাথে ছিলেন ইতালি থেকে সাথে আসা বাংলাদেশ দূতাবাসের কনসাল জেনারেল ও ফাদারের আপন ভাগ্নে। আরেক গাড়িতে ছিলেন এই সকল কর্মকান্ডের মহান নায়ক ভীষণ কর্মক্লান্ত জনাব সাজ্জাদ আলী জহির বীরবিক্রম। এই মানুষটি দীর্ঘ কয়েকমাস অমানুষিক পরিশ্রম করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। তিনি না থাকলে আমার মত ক্ষুদ্র মানুষের কোন প্রচেষ্টা কখনও সফল হতো না। ফাদার রিগনের ভক্ত মোংলার মানুষের কাছে আমার দেওয়া মিথ্যে আশ্বাস মিথ্যেই রয়ে যেতো। হয়তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই খবর কোনদিন পৌঁছাতো না।

মোংলায় যাবার জন্য নির্ধারিত সংশ্লিষ্ট সকলেই সকালে নাস্তা না করেই তেজগাঁও পুরানো বিমানবন্দরে গিয়েছিলাম। জনাব সাজ্জাদ আলী জহির স্যার আগে থেকেই বিমান বাহিনীর কাছে সেটা অবহিত করেছিলেন। তাই তারা আমাদের সকলকে অতি যত্ন সহকারে নাস্তা খাইয়ে তারপর ফাদারের মরদেহসহ বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারে উঠিয়ে দিলেন। আমরা মোংলার উদ্দেশ্যে তেজগাঁও পুরানো বিমানবন্দর ত্যাগ করলাম।

হেলিকপ্টারে আমাদের যাত্রা ছিল এক ঘন্টার মতো। ফাদারের ভাগ্নে আমার পাশে বসা ছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে বললেন, Mr Kamrul, do you think that anough people will appear to receive us?

আমি বললাম
Let us see.

কিছু সময়ের মধ্যে হেলিকপ্টার মোংলার আকাশে পৌঁছে গেল। আমরা জানালা দিয়ে তাকিয়ে বিস্মিত হতে লাগলাম। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই শুধু মানুষের ঢল। নদীর পানি দেখা যায়না, মাঠ দেখা যায়না, রাস্তা দেখা যায়না, বাড়ির ছাদ দেখা যায়না। শুধু মানুষ আর মানুষ। শুধুমাত্র হেলিকপ্টার অবতরণের জায়গাটুকু খালি ছিল। ফাদারের ভাগ্নে অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন,
Is it fact? All those people are waiting for us?
আমি আবার বললাম
Let us see and come up to the end of the drama.

অবশেষে হেলিকপ্টার অবতরণ করলো। মোংলার মানুষের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষার ফাদার রিগনের মরদেহ ইতালি থেকে উড়ে এসে তাঁর স্বপ্নের তীর্থ শেলাবুনিয়ায় সমাধিস্থ হবে। সুসজ্জিত গাড়ি বহর এলো, এলো সুঠাম দেহের অধিকারী কফিন বাহক দল। তারা যথাযথ মর্যাদায় কফিন কাঁধে নিয়ে গাড়ি বহরে তুললো। কিন্তু গাড়ি আর চলে না। কিভাবে চলবে? রাস্তা কোথায়? সবইতো মানুষে মানুষে একাকার। অনেক কষ্ট করে শেষ পর্যন্ত হেলিপ্যাড থেকে মরদেহ সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের স্থানে নেয়া হলো। পাঁচ মিনিটের রাস্তা পার হতে প্রায় এক ঘন্টা লেগে গেল। বিশাল সুসজ্জিত মঞ্চে ফুল সজ্জিত ফাদারের কফিন রাখা হলো। ফুলে ফুলে ভরে গেলে বিশাল মঞ্চ। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পুলিশের একটি চৌকস দল গার্ড অব অনার দিলো। মোংলার জননেতা তালুকদার আবদুল খালেক ফুলেল শুভেচ্ছা নিবেদন করার পর এলাকার সকল স্তরের, সকল দলের নেতা নেত্রী, সাধারণ মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন। প্রশাসনের কর্তাবৃন্দ শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন। তারপর কফিন নেওয়া হলো ফাদার রিগনের পরম যত্নে লালিত সেন্ট পলস স্কুলে। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করার পর নেওয়া হলো সেই সমাধিস্থলে যেখানে ফাদার নিজেই চিরনিদ্রায় শায়িত থাকতে চেয়েছিলেন। কবরে নামানোর আগে ফাদারের নির্মিত গীর্জায় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করেছিলেন শুধুমাত্র খ্রিস্টান ধর্মীয় লোকজন।

ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান শেষে ফাদারের কফিন নামানো হলো শ্বেত পাথরে বাঁধানো কবরে। এই কবরটি আগেই তৈরী ছিল। কবরটি তৈরি করতে খরচ দিয়েছিলেন মোংলা পৌরসভার তৎকালীন মেয়র জনাব জুলফিকার আলী।

ফাদার ঘুমিয়ে গেলেন। মোংলার আপামর জনসাধারণ স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেন। ইতিপূর্বে ফাদারের ভক্তদের কাছে আমার দেওয়া মিথ্যা আশ্বাস আর মিথ্যা রইলো না।

ফাদারের সাথে আমার প্রথম পরিচয়

১৯৯৬ সালে আমি খুলনায় ছিলাম। এর আগে বহুবার ফাদার রিগনের নানাবিধ কর্মকাণ্ডের কথা লোকমুখে শুনেছি। তাঁর কথা শুনে শুনে আমার মনে তাঁকে দেখার প্রবল আগ্রহ ছিল। উপযুক্ত পরিবেশ ও সুযোগ না হওয়ায় আমার ইচ্ছা পূরণ হয়নি। ইতিমধ্যে মোংলার সন্তান জনাব দানিয়েল হালদারের সাথে আমার বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো। তিনি আমার গ্রামের ‘দ্যা স্যালভেশান আর্মি’ হাসপাতালে চাকরি করতেন। ফাদারের সাথে তার দারুণ সখ্যতা ছিল। তিনি আমাকে ফাদারের সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিলেন। আমি অধীর আগ্রহ নিয়ে একদিন মোংলায় গেলাম। সেদিনই ফাদারের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হলো। মোংলার শেলাবুনিয়ায় ফাদারের তীর্থস্থানে নানাবিধ আলোচনা হলো। সমগ্র এলাকা তিনি নিজে আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। আমি মন ভরে সবকিছু দেখে রীতিমতো অভিভূত হলাম। তিনি তাঁর নিজের রোপিত আম গাছ থেকে আম পেড়ে আমাকে খাওয়ালেন। কিছু আম আমাকে বাসায় নেওয়ার জন্য দিলেন। সেদিন থেকে আমি তাঁর প্রেমে পড়ে গেলাম। দুপুরে খাবারের জন্য অনেক পীড়াপীড়ি করলেন; কিন্তু আমার বন্ধু দানিয়েল হালদার আগে থেকেই তার কাকা ও সেন্ট পলস স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবু সুদান হালদারের বাড়িতে ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। সুতরাং ফাদারের সান্নিধ্য ছেড়ে সেখানে দুপুরের খাবারের জন্য যেতে হলো। সুদান বাবুর বাড়িতে সেই দুপুরের খাবারের কথা আমি সারা জীবনে ভুলতে পারবো না।

এরপর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলো। ফাদার খুলনায় এলে আমি তাঁর সাথে দেখা করতাম। প্রায়শই তাঁকে দেখতে মন চাইতো। তাঁর সাথে সরাসরি যোগাযোগ করার তেমন সুযোগ ছিল না। কারণ তিনি প্রায়শই মোংলায় থাকতেন, সেখানে সরাসরি টেলিফোন ছিল না। এখনকার মতো তখন দেশে মোবাইল ফোন আসেনি।

মোংলা থানার ওসি হওয়ার পর ফারদার সাথে গাঢ় সম্পর্ক

১৯৯৯ সালের কথা। হঠাৎ করে আমার ঢাকা থেকে মোংলা থানার ওসি হিসেবে পোস্টিং হলো। আমি মহা খুশি হলাম। মনে মনে ভাবলাম এবার ফাদারের সাথে মন খুলে মিশতে পারবো। বাস্তবেও তাই হলো। আমি মোংলা থানায় যোগদান করার পরই ফাদারের সাথে দেখা করলাম। তাঁর সাথে নিয়মিত আড্ডা শুরু হয়ে গেল। সময় পেলেই আমি ফাদারের কাছে ছুটে যেতাম। আমার মন খারাপ হলে তাঁর কাছে গিয়ে বসে সময় কাটাতাম। তাঁর সাথে বাগানে ঘুরাঘুরি করতাম। তাঁর সেলাই কেন্দ্র, ছাত্রী নিবাস, নকশীকাঁথার ডিজাইন সবকিছু দেখতাম। ফাদারের পড়ার ঘর, ঘর খাবার ঘর, শওন কক্ষ সব জায়গাতেই আমার অবাধ বিচরণ তিনি অকাতরে মেনে নিতেন। মাঝে মাঝে সেন্ট পলস হাসপাতালে গিয়ে রুগীদের সাক্ষাৎ দিতেও ভুল করতাম না। এইভাবে চলতে চলতে ফাদারের মনের মধ্যে আমি, আর আমার মনের মধ্যে ফাদার বাসা বাঁধলেন। দু’জন দুজনের পরম বন্ধু ও হিতাকাঙ্ক্ষী হয়ে গেলাম।

ফাদারের কাছে তাঁর সম্প্রদায়ের কোন মানুষ কোন সমস্যা নিয়ে গেলে তিনি নিজেই সমাধা করতেন। কখনও থানা পুলিশ বা প্রশাসনের দারস্থ হতেন না। কিন্তু আমি ওসি থাকাকালীন তাঁর কাছে সাহায্যের জন্যে যাওয়া সকল মানুষকে তিনি আমার কাছে পাঠাতেন। এর আগে তিনি কখনও কোন কারণে পুলিশের শরণাপন্ন হয়েছেন বলে তেমন কেউ শোনেনি। এমনকি একবার হঠাৎ একজন আধ-পাগলা যুবক আকস্মিকভাবে ফাদারের মাথায় ইট মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল। তারপরও ফাদার সেই যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে থানায় বা প্রশাসনের দারস্থ হননি। শুধু আমি ওসি হিসেবে মোংলা থানায় যোগদানের পর তিনি সকল সমস্যা সমাধানের জন্য আমার কাছে যেতেন এবং লোকজনকে আমার কাছে পাঠাতেন। ফাদারের সকল অনুষ্ঠানে আমাকে দাওয়াত দিতেন; আমিও মনেপ্রাণে হাজির হয়ে ফাদারের সাথে অনুষ্ঠান উপভোগ করতাম। মাঝেমধ্যে আমরা মোংলার প্রত্যন্ত গ্রামে চলে যেতাম।

এক বিকালের কাহিনী

শেলাবুনিয়া গীর্জার পাশ দিয়ে সাজানো বাগান, বিশাল শান বাঁধানো পুকুর, ছোটবড় ফল- ফুলের গাছ, সরু সরু ইটের ও সিমেন্টর রাস্তা। পুরা গীর্জার চারদিক অপরুপ দৃশ্য সহজেই সবার মন কাড়ে। আমরা দু’জন প্রায়ই সেখানে ঘুরে ঘুরে মনের ভাব বিনিময় করতাম ও বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করতাম।

বাগানে হাটতে হাটতে ফাদারের সাথে অন্তরঙ্গ এক মূহুর্তে হাসির ছলে একদিন বললাম,
‘ফাদার আপনিতো বিয়ে করেননি, কিন্তু কখনও প্রেম করেছেন?’
ফাদার তাঁর স্বভাবসুলভ এক গাল হাসি দিয়ে বললেন,
‘হ্যা করেছি’।
আমি কৌতুহলী হয়ে বললাম, ‘বলেননা সেই প্রেমের কাহিনী’।
ফাদারঃ আমার যখন পাঁচ বছর বয়স তখন আমার মা বলেছিলেন, তুমি বড় হয়ে কি হবে?
আমি বলেছিলাম বড় হয়ে আমি ফাদার হবো। সেই দিন থেকে আমি ঈশ্বরের প্রেমে পড়ে গেছি। আজও তাঁর সাথে প্রেম করি। মানুষের মাঝে ঈশ্বরের ছবি দেখতে পাই। তাই মানুষের সাথেও প্রেম করি।

এই কথা শুনে আমি আরো একটু বেশি করে ফাদারের প্রেমে পড়লাম।

হঠাৎ একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে গেল। আমরা দুজনে হাটছিলাম গাছের ভিতর দিয়ে কিছুটা নিজেদেরকে গাছের আড়ালে রেখে। পাশেই ছিল ফাদারের নিজ হাতে গড়া প্রাচীর বেষ্টিত ছাত্রী হোস্টেল। সেখান থেকে দু’জন ছাত্রী ঐ বাগানের খোলামেলা ছোট রাস্তায় বৈকালিক ভ্রমণ করছিলো। তারা আমাদের না দেখলেও আমরা তাদেরকে দেখতে পাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম ঐ দুটি মেয়ে একজন আর একজনকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে বলছে
‘তুই আমার ডার্লিং’।
আমি তাদের কথা তেমন খেয়াল না করলেও ফাদার ঠিকই খেয়াল রেখেছিলেন। তাদের কথা শুনে ফাদার তাদেরকে ডেকে কাছে আসতে বললেন। ফাদার তাদের দুজনের অন্তরঙ্গ আলাপ শুনে ফেলেছে বুঝে ফাদারের ডাকে সাড়া না দিয়ে বরং দৌড়ে হোস্টেলের ভিতর ঢুকে পড়লো।

ঐ দুটো মেয়ের কাউকে আমি চিনতাম না। কিন্তু ফাদার দুজনকেই ভাল করে চিনতেন। ওদের মধ্যে একজন ছিল হিন্দু ও একজন খ্রিষ্টান। মেয়ে দুটো পালিয়ে যাবার পর ফাদারের চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। তিনি বাম হাত দিয়ে চশমা খুলে চোখের জল মুছতে মুছতে কিছু সময় চুপ থেকে আমাকে বললেন,
‘আমি ওদের দুজনকেই ভাল করে চিনি। ওদের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। একজনের বাবা হিন্দু ও একজনের বাবা খ্রিষ্টান। কিন্তু ওরা দুজনের কেউ হিন্দু বা খ্রিষ্টান নয়, ওরা দুজনেই মানুষ। নইলে দুই জাতির দুইজন হয়ে একে অন্যের গলা জড়িয়ে ধরে এমনভাবে চুমু খায় কেমন করে। আর একে অপরকে ‘ডার্লিং’ বলবে কেমন করে’।

আমিও বেশ কিছু সময় ফাদারের ছলছলে চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। খানিকক্ষণ পরে আমরা দুজনেই একটু স্বাভাবিক হয়ে ঐ মেয়ে দুটির কথা আলাপ করতে লাগলাম। ফাদার আবারও বললেন, ‘এভাবে যদি সকল মানুষকে গড়ে তোলা হয় তবে মানুষ পৃথিবীতেই স্বর্গ দেখবে’।

আমিও তাঁর সাথে একমত পোষণ করে বিভিন্ন আলোচনা করতে করতে ফাদারের প্রার্থনার সময় হয়ে গেল। তিনি গীর্জায় ঢুকে পড়লেন, আমি ঐ মেয়ে দুটো ও ফাদারের কথা ভাবতে ভাবতে আমার কাজে রওয়ানা হলাম।

গীর্জার নকশার গোপন তথ্য

শেলাবুনিয়ায় ফাদারের নির্মিত গীর্জাটি যারা দেখেছেন তারা সবাই এর স্থাপত্য শিল্পের প্রশংসা করবেন। গীর্জার ভিতর বাহির ও আঙিনা অসাধারণ শিল্পকর্মে সুশোভিত। সবকিছুই চোখে পড়ার মতো। কিন্তু এই গীর্জার নির্মাণ কাজে একটি গূঢ় রহস্য লুকিয়ে আছে, যা সাধারণ চোখে ধরা পড়ার কথা নয়। এই রহস্য শুধু ফাদার রিগন জানতেন এবং আমার সাথে সেটা গোপনে শেয়ার করেছিলেন।

আরো একদিনের কথা। আমরা দু’জন ফাদারের রুমে অন্তরঙ্গ আলাপে মগ্ন ছিলাম। হঠাৎ ফাদার আমার হাত ধরে গীর্জার কাছে নিয়ে গেলেন। গীর্জার ভিতরের শিল্পকর্ম, নকশা ইত্যাদি দেখাবার পর বাইরে নিয়ে ছাঁদের চারদিকে রেলিং এর দিকে দেখতে বললেন। আমি বেশ ভাল করে দেখে বললামঃ
অনেক সুন্দর হয়েছে।
ফাদারঃ আর কিছু লক্ষ করলেন?
আমিঃ সবকিছুই খুব সুন্দর হয়েছে।
ফাদারঃএখানে আলাদা কিছু লক্ষ করলেন?
আমিঃ আমার দৃষ্টিতে সবকিছুই ভাল হয়েছে।
ফাদারঃ এখানে একটা গোপন রহস্য লুকানো আছে।
আমি সাগ্রহে বললামঃ কি সেই রহস্য?
ফাদারঃ ছাদের চারধারে রেলিং এর নকশা দেখছেন, ওটা আমার পরিকল্পনায় তৈরী হয়েছে।
আমিঃ এখানে সবকিছুই আপনার পরিকল্পনায় হয়েছে তা আমি জানি।
ফাদারঃ কিন্তু একটা জিনিস কেউ জানেনা। আজ সেটা আপনাকে দেখাবো। তবে আমি বেঁচে থাকতে কাউকে বলতে পারবেন না। তাহলে আমার অনেক ক্ষতি হবে।

আমার শুনার আগ্রহ ভীষণ বেড়ে গেল। বললামঃ প্লিজ ফাদার, আমাকে বলুন।

ফাদারঃ কাউকে বলবেননা কিন্তু। গীর্জার ছাঁদের চারদিকে যে নকশা দেখছেন তা একটু ভাল করে লক্ষ করুন। ওখানে আছে একটা চাঁদতারা, একটি ত্রিশূল ও একটি ক্রস চিহ্ন। চাঁদতারা মুসলমানদের প্রতীক, ত্রিশূল হিন্দুদের প্রতিক, আর ক্রস হচ্ছে খ্রীষ্টধর্মের প্রতিক। আমার দৃষ্টিতে এই গীর্জা সকল ধর্মকে বিশ্বাস ও সম্মান করে। তাই অনেক চিন্তা করে আমি এই প্রতিক তৈরী করেছিলাম। এটার অর্থ এখনও কেউ বুঝতে পারেনি। এই দেশে মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মের মানুষ একসাথে মিলেমিশে বসবাস করেন। এটা আমার খুব ভাল লাগে। তাই ইচ্ছে করেই এই প্রতিক বানিয়েছিলাম। আজ আপনাকে প্রথম আমার মনের কথাটি খুলে বলে হালকা হলাম। এই দেশের মানুষ অনেক ভাল। এখানকার মানুষের মাঝে ধর্মীয় সম্প্রীতি আমার খুব ভাল লাগে।

ফাদারের মুখে এসব কথা শুনে তাঁর উপর আমার শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেল।

ফাদারের সাথে ভোজন

ফাদার রিগন মাঝে মাঝে তাঁর ওখানে আমাকে খাওয়ার দাওয়াত দিতেন। খাওয়ার সময় তিনি নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করতেন এবং খাবার শেষে নিজ হাতে চা, কফি বা কাপাচিনো, এক্সপ্রেসো তৈরী করে পরিবেশন করতেন। আমি সারাজীবনে কখনও তাঁকে মদ বা বিয়ার পান করতে দেখিনি। তিনি এসব কখনও পছন্দ করতেন না।

একবার তিনি আমার পরিবারের সকল সদস্যদের দাওয়াত করলেন। আমরা সবাই তাঁর সম্মানে ভোজসভায় হাজির হলাম। তিনি হরেক রকম খাবারের আয়োজন করেছিলেন। আমরা সবাই মিলে অত্যন্ত তৃপ্তি সহকারে তাঁর পরিবেশনায় খাবার খেলাম। তিনি আমার স্ত্রী ও সন্তানদের নাম জিজ্ঞেস করে প্রত্যেকের নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন। তারপর থেকে তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তাদের নাম মনে রেখেছিলেন। তাঁর সাথে দেখা হলে বা ফোনে কথা হলেই তিনি আমার স্ত্রী ও সন্তানদের নাম ধরে কুশল জিজ্ঞেস করতেন।

আমার পরিবারের সকলেই ফাদার রিগনের ভক্ত ছিল। তাঁর মরদেহ ইতালি থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসার জন্য আমার অবদানে তারা সকলেই গর্ববোধ করে থাকে।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!