খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৪৫৮

ভারী বর্ষণে দিঘলিয়ায় মাছ চাষে ক্ষতি সাড়ে ৯ কোটি টাকা

একরামুল হোসেন লিপু

পোনা উৎপাদন এবং মাছ চাষের জন্য খুলনার অন্যতম একটি এলাকা দিঘলিয়া উপজেলার লাখোয়াটি গ্রাম। এ গ্রামের ৯০ শতাংশ মানুষ পোনা উৎপাদন এবং মাছ চাষের সঙ্গে জড়িত। লাখোয়াটি গ্রামের ঘরে ঘরে লাখপতি তৈরি হয়েছে মাছের পোনা উৎপাদন এবং মাছ চাষ করে। এখানকার উৎপাদিত মাছের পোনা খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়। এ বছর ভারী বর্ষণে লাখোয়াটি গ্রামের ৯৫ শতাংশ মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। শুধু লাখোয়াটি নয় মাছের ঘের খ্যাত পার্শ্ববর্তী বারাকপুর, বোয়ালিয়াচর, মাধবপুর, ব্রহ্মগাতী, মহেশ্বরপুর, দিঘলিয়া, সেনহাটী এবং গাজীরহাট ইউনিয়নের ৯৫ শতাংশ মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। সেই সাথে তলিয়ে গেছে ঘেরের পাড়ে লাগানো বিভিন্ন প্রজাতির সবজি। ঘের তলিয়ে যাওয়ায় এ এলাকার মাছ চাষিরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এত বড় ক্ষতি কিভাবে কাটিয়ে উঠবেন? এ চিন্তায় তাদের হতাশার ভিতর দিন কাটছে।

উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, কয়েকদিনের ভারী বর্ষণে দিঘলিয়া উপজেলার চারটি ইউনিয়নের ১৫৫ হেক্টর জমির ৫৫০ টি ঘের তলিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত ৫৫০ টি ঘেরের ১৬০ মেট্রিক টন সাদা মাছ (ফিন ফিশ), ৪৫ মেট্রিক টন চিংড়ি মাছ, ৮০ লাখ মাছের পোনা পানিতে ভেসে গেছে। ভেসে যাওয়া সাদা মাছ (রুই, কাতলা, মৃগেলসহ) অন্যান্য সাদা মাছের আনুমানিক মূল্য) ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ভেসে যাওয়া গলদা চিংড়ির আনুমানিক মূল্য ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। ৮০ লাখ পোনা মাছের আনুমানিক মূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা। এছাড়া অবকাঠামো পুকুর, ঘের, সুইচগেটসহ অন্যান্য ক্ষতির আনুমানিক পরিমাণ ৫০ লাখ টাকা। এছাড়াও অন্যান্য সব মিলিয়ে আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টাকা।

লাখোয়াটী গ্রামের মাছ চাষী ও স্থানীয় ইউপি সদস্য শেখ কামরুল ইসলাম খুলনা গেজেটকে বলেন, “খুলনার মধ্যে লাখোয়াটি গ্রাম পোনা উৎপাদনে এবং মাছ চাষের জন্য বিখ্যাত। এই গ্রামের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ মাছ চাষের সঙ্গে জড়িত। এ বছরের ভারী বর্ষায় লাখোয়াটী গ্রামের সব ঘের তলায় গেছে। কয়েক কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। এলাকার মানুষ দুঃশ্চিন্তার মধ্যে আছে।

ইউপি সদস্য বলেন, ব্রক্ষগাতী এবং লাখোয়াটী মৌজায় আমার নিজের সাড়ে ৬ বিঘের ২ টি ঘের পানিতে তলায় গেছে। ৭০/৮০ মণ চারা মাছ ছিল। সব পানিতে ভাসায় নিয়ে গেছে। ঘেরের পাড়ে বিভিন্ন প্রজাতির সবজির গাছ লাগাইছিলাম। সব তলায় গেছে। আমার নিজের প্রায় ৭/৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ঘের করতিছি জন্মের পর থেকে। আমার বাপ দাদারা সবাই মাছের চাষ করতো। ২০০০ সালে একবার বৃষ্টির পানিতে ঘের তলায় গিছিলো। ২৩/২৪ বছর পর এই বছর আবার তলালো”।

বারাকপুর ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামের মোছারুল মোল্লা। মাধবপুর বিলের অন্যতম একজন মাছ চাষী। প্রায় ১৭ একর জমিতে ২১ বছর ধরে মাছ চাষ করেন। মোছারুল মোল্লা খুলনা গেজেটকে বলেন, “১৯৯৫ সালে রুটি রুজির তাগিদে সৌদিআরব চলে যায়। ৭ বছর পর ২০০২ সালে দেশে ফিরে আসি। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া এবং নিজের ক্রয়কৃত জমি সব মিলিয়ে প্রায় ১৭ একর জমিতে ২০০৩ সাল থেকে মাছ চাষ করছি। কয়েকদিনের একটানা ভারী বৃষ্টিপাতের কারনে কামারগাতি এবং রাধামাধবপুর মৌজার আমার নিজের ৪ টি ঘেরের সবক’টি পানিতে তলিয়ে গেছে। ১০/১২ লাখ টাকার সাদা মাছ ভেসে গেছে। শুধু মাছ নয় ঘেরের পাড়ে লাউ গাছসহ অন্যান্য সবজি ফসলও পানিতে তলিয়ে গেছে। প্রতি সপ্তাহে আমি শুধু লাউ শাক বিক্রি করতাম ১০ হাজার টাকার। বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল। মাছ চাষ শুরুর পর এ বছরই প্রথম আমার ঘের পানিতে তলাইয়ে সব মাছ ভেসে গেল। শুধু আমার না মাধবপুর বিলের সব ঘের তলায় গেছে। ১২/১৪ লাখ টাকার ক্ষতি। কিভাবে পুষাবো? সেই চিন্তায় দিশেহারা হয়ে যাচ্ছি”।

একই গ্রামের মাছ চাষী সোহেল শেখ বলেন, “কামারগাতী এবং রাধামাধবপুর মৌজায় আমার ৪ টা ঘেরের তিনটা ঘের পানিতে তলায় গেছে। ভেসে গেছে ঘেরের সব মাছ। ৭/৮ বছর গলদা চিংড়ি চাষ করেছি। ৩/৪ বছর যাবৎ সাদা মাছের চাষ করছি। ভেসে যাওয়া মাছের আনুমানিক মূল্য ১২ থেকে ১৪ লাখ টাকার মতো হবে। খুব চিন্তায় আছি। এই ক্ষতি কি করে কাটায় উঠবো”?

একই গ্রামের মাছ চাষী ও স্থানীয় ইউপি সদস্য মোঃ হায়দার আলী মোল্লা বলেন, “মাধবপুর গ্রামে প্রায় আড়াই ‘শ থেকে ৩শ ‘ র মতো মাছের ঘের আছে। সব পানিতে তলায় গেছে। ভেসে গেছে ঘেরের সব মাছ। ঘেরের পাড়ের সব সবজিও তলায় গেছে। আমার নিজেরাও ৮ বিঘের ঘের তলায় গেছে। ঘেরের উপর হাঁটু পানি প্রায় দুই লাখ টাকার মাছ পানিতে ভেসে গেছে। এবছর সব দিক দিয়ে ক্ষতির মধ্যে আছি। এই ক্ষতি যে কিভাবে পুষাবানি চিন্তা করে পারতিছিনা।

তিনি বলেন, নন্দনপ্রতাপ এবং মোমিনপুর খাল সংস্কার না করার কারণে আমাদের এই এলাকার পানি ঠিকমতো সরতে পারে না। যার কারণে বৃষ্টির পানি জমে থাকে।

দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে মাছ চাষের সঙ্গে জড়িত বারাকপুর গ্রামের গাজী মুরাদ হোসেন বলেন, “বোয়ালিয়ালচর এবং বারাকপুরে ৩ টা ঘেরের মধ্যে আমার দুইটা ঘের তলায় গেছে। প্রায় দুই আড়াই লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। শুধু আমার নয় অঞ্চলের সব ঘের পানিতে তলায় গেছে। এরকম ভারী বৃষ্টি অনেক বছর দেখিনা”।

মাধবপুর বিলের আরেকজন বড় মাছ চাষী নাজমুল মোল্লা তারও ৬০ বিঘা নিয়ে ৬ টা ঘের। ঘেরে সব সাদা মাছ ছিলো। সব ভাসায় নিয়ে গেছে। তার প্রায় ১২/১৪ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। নাজমুল মোল্লার মতো মাধবপুর, লাখোয়াটী, বারাকপুর, বোয়ালিয়াচর, লক্ষীকাঠি কামারগাতী, আড়ুয়া, দিঘলিয়া, ব্রক্ষগাতী, পানিগাতী, হাজীগ্রাম, মমিনপুর বিলের সাড়ে পাঁচ শতাধিক মাছ চাষীর ঘের তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে ঘেরের সব মাছ। তলিয়ে গেছে সবজির ফসলও।

দিঘলিয়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য অফিসার মোঃ মঞ্জুরুল ইসলাম খুলনা গেজেটকে বলেন, “আমরা খোঁজখবর নিয়ে জানতে পেরেছি কয়েকদিনের টানা ভারী বর্ষণে উপজেলার চারটি ইউনিয়নের সাড়ে ৫ শতাধিক মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। এছাড়া বন্যা পরবর্তী মৎস চাষীদের আমরা বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ প্রদান অব্যাহত রেখেছি। সরকারিভাবে কোন সহযোগিতা আসলে সেগুলো দ্রুত মৎস্য চাষীদের মধ্যে বন্টন করা হবে”।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!